সেঁজুতি শুভ আহমেদ : সাহিত্যসেবীদের একটি অংশের ধারণা এই যে, হোমার, সফোক্লিস, ভার্জিল, শেক্সপিয়র, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, ফেরদৌসীর মতো ধ্রুপদী কবি সাহিত্যিকদের মাধ্যমে ইতোমধ্যে সব মৌলিক চিন্তা আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। অতএব মৌলিক চিন্তাটিন্তা বাদ দিয়ে কলাকৈবল্যবাদের নামে অর্থহীন হ-য-ব-র-ল চর্চা জোরসে চালাও। সাহিত্য প্রতিভূদের দিয়ে হয়তো মৌলিক চিন্তার অধিকাংশ আবিষ্কৃত হয়ে গেছে ঠিক কিন্তু এখনো সাহিত্যে মৌলিক চিন্তা আবিষ্কারের ক্ষেত্র ফুরিয়ে যায়নি। একটা সময় হয়তো সাহিত্যে এই মৌলিক চিন্তা আবিষ্কারের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। সে সময়েও সাহিত্যে বেঁচে থাকবে মৌলিক চিন্তাগুলোর সংশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন চিন্তার অন্তহীন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া; কিন্তু অন্তঃসারশূণ্যতা কোনো কালের সাহিত্যেই সমর্থন লাভ করবে না।
যে সমস্ত মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জীবনের অর্থের প্রয়োজন নেই, তাদের কাছে কবিতাতেও কোনো অর্থের প্রয়োজন না থাকতে পারে। সৃষ্টির আদি থেকে অর্থপূর্ণ যা কিছু ঘটেছে, তাই টিকে থেকেছে বহুকালব্যাপী আর অর্থহীন যা কিছু ঘটেছে তা খুব বেশিদিন টিকে থাকেনি। প্রকৃতিতে সব কিছু অর্থপূর্ণভাবে ঘটে বলে তা আজও টিকে আছে এবং পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে বলে আশা করা যায়। প্রকৃতিতে এমন কোন কিছু যদি লক্ষণীয় হয়, যা অর্থহীনভাবে ঘটে বলে আমাদের ধারণা দেয়; তবে তা সত্য উদ্ঘাটনে প্রয়োজনীয় চিন্তা ও গবেষণার অভাবজাত ধারণামাত্র। প্রাচীন ইনকা সভ্যতার কিছু জ্যামিতিক রেখাচিত্রের অর্থ অদ্যাবধি উদ্ধার করা যায়নি কিন্তু এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ওগুলোর অর্থ রয়েছে। এজন্য প্রতœনিদর্শন হিসেবে যত না তার অধিক আগ্রহের বিষয়বস্তু হিসেবে মানুষ সেগুলোকে টিকিয়ে রাখছে এবং রাখবে। এজন্য দেখা যায় ধ্রুপদের মর্যাদা লাভ করা কবিতাগুলো প্রায়ই অর্থদ্যোতনা সমৃদ্ধ।
কবিতা নিছক শব্দ বা বাক্যের খেলা নয় যে একটার পর একটা সঙ্গতিহীন বাক্য বসিয়ে একটা কিছু দাঁড় করালেই তা কবিতা হয়ে উঠবে। কেবলমাত্র প্রকরণ, আঙ্গিক বিচার, নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে স্বার্থক ছড়া হতে পারে, গান হতে পারে এমনকি কিছু পদ্যও হতে পারে, কবিতা হয় না। যত বিতর্কই থাকুক না কেন, এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে শাশ্বত সত্য, আবেগ নিবিষ্টতা, মগ্নচৈতন্য, সংজ্ঞা, জীবনবোধ প্রভৃতির প্রয়োগ ও সমন্বয় কবিতা সৃষ্টিতে অপরিহার্য। হাট্টিমাটিম টিম/তারা মাঠে পাড়ে ডিমÑএ ধরনের ননসেন্স ছড়াতেই শোভা পায়। কবিতাকে কেবল কানের খাদ্য তৈরি করলেই চলে না, মনের খাদ্যও তৈরি করতে হয়। যে কবিতা কান দিয়ে মনে প্রবেশ না করলো, তাকে স্বার্থক কবিতা বলি কি করে?
আমরা যদি কবি ও শব্দশিল্পীর মধ্যে পার্থক্য করতে শিখতাম, তবে লোকে কখনো ব্যঙ্গ করতে পারত না যে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি।
সাহিত্যাঙ্গনে একটি দল আছে যেটি সাহিত্যের চেয়ে সাহিত্যান্দোলনে বেশি গতিশীল, কবিতার চেয়ে কবিতা উৎসবে অত্যুৎসাহী এবং বইয়ের চেয়ে বই মেলার প্রতি বেশি মনোযোগী। এই দলের সদস্যরা চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের পূর্বের কবি সাহিত্যিক সম্পর্কে এমন ভাব দেখায় যেন তাদের সাথে জমিজমা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে। আর এদের বাছ বিচারহীন অনাসৃষ্টির দিকে যে-ই নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাকায়, তাকে প্রাচীনপন্থী বলে গালি দিয়ে বসে। অপরপক্ষে আরেকটি দল আছে যারা নতুনত্ব, নতুন কাব্য প্রয়াস কিংবা নবীন কবির দাবিনামাকে বিশেষ অবজ্ঞার চোখে দেখে। তাদের অনেকেই ব্যতিক্রম চিন্তা ধারার অনুসারীদের ভালো মন্দ বিচার না করেই রিরংসাস্পৃষ্ট, নেতিবাদী বলে গালি দিয়ে অপবিত্র কবির তালিকায় রেখে নিজেদেরকে পরিচ্ছন্নতার উত্তর সাধক বলে ঘোষণা করেন। ছোট কাগজ, বড় কাগজ, গদ্য-পদ্য, ছন্দ, ছন্দপতন ইত্যাদি বিষয়ে বিতর্কের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে উভয় দল যতটা যতœশীল, এসবের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টায় ততটাই উদাসীন। এই সমস্ত কবি সাহিত্যিকরা যেন দলাদলি ও গালাগালিকে সাহিত্যের একটি নতুন শাখা হিসেবে খুলে বসেছেন। সাহিত্যের এই শাখার(?) কোন উপযোগিতা নেই বরং তা দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বিশেষ করে কাব্য সাহিত্যে প্রচীনকাল থেকে বর্তমানকালের পরম্পরায় একটি ধারাবাহিক যোগসূত্র রয়েছে বৈকি। মনে হতে পারে যে মধ্যযুগের সাথে একটি মেলবন্ধন থাকলেও প্রাচীন যুগের সাথে বর্তমান ধারার কোন যোগাযোগ নেই। কিন্তু বর্তমান ধারার সাথে যে কোন সূত্রেই প্রাচীন যুগের একটি যোগসূত্র রয়েছে কেননা মধ্যযুগীয় ধারার সাথে তার আবার যোগাযোগ রয়েছে। তিনের সাথে দুয়ের সম্পর্কটা দেখলেই শুধু চলে না, দুইয়ের সাথে এক এর যে সম্পর্ক রয়েছে; সেটাও ধর্তব্য। ওই এক না হলে যে তিনের জন্মই হয় না!
আজকের যে আধুনিক মানুষ কোন দিন রিপাবলিক বা ডায়ালগ পড়েনি, তার মধ্যেও প্লেটোর চিন্তার প্রতিফলন থাকতে পারে। এই আধুনিক মানুষ প্লেটোর চিন্তার ধারাবাহিক পোষক হিসেবে কাজ করছে। মানুষের চিন্তা চেতনার পারস্পারিক স্থানান্তর ঘটে নানাবিধ সামাজিক সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্যদিয়ে। মিল্টন, কীট্স, শেলিরা কিন্তু চসার, বায়রনদের বর্জন করে কাব্য চর্চায় অগ্রসর হননি; যেমন মধুসূদন, মোহিতলাল, রবীন্দ্রনাথদের বাদ দিয়ে হননি বুদ্ধদেব, অমিয়, বিনয়, বিষ্ণুরা। তারা অন্তত এটি ভালোভাবে বুঝেছিলেন যে প্রত্যেক প্রকৃত কবি সাহিত্যক তার সমকালে আধুনিক থাকেন। আর ধ্রুপদী সৃষ্টিকর্ম তো সর্বকালে আধুনিক।
সাহিত্যান্দোলনে জড়িতদের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদের ব্যাখ্যা অপব্যাখ্যা ও ভুল বোঝাবুঝির ইতিহাস বেশ পুরনো। যতই দিন যাচ্ছে, ততই জল ঘোলা বেশি হচ্ছে। অনেক সাহিত্যান্দোলনকারী কোন একটি মতবাদ ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগেই তার ঘোরতর সমর্থক হয়ে উঠছেন!
বাস্তবাদই যদি ঠিক মতো না বুঝলাম, তবে পরাবাস্তবতা নিয়ে নাচানাচির অধিকার কতটা? বাস্তববাদের জের ধরে যে পরাবাস্তবতার উদ্ভব। বিষয়টি এমন যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ না চুকিয়েই উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রবেশের হাপিত্তেশ। প্রথম সিঁড়ি থেকে এক লাফে চতুর্থ সিঁড়িতে উঠবার খায়েশ হাত-পা ভাঙার মতো বিপদ ডেকে আনতে পারে। আধুনিকতার মধ্য দিয়েই এখনো পারি দিতে পারি নাই, উত্তর আধুনিকতাবাদকে টেনে এনে কাঁধের বোঝা বাড়াবার শক্তি-সামর্থ্য পাই কোথায়? আধুনিকতার যেখানে শেষ, সেখানেই উত্তর আধুনিকতার শুরু। সুতরাং আধুনিকতা উত্তর আধুনিকতার একটি ভিত্তিÑ এদের মধ্যে রূপগত পার্থক্য থাকতে পারে, বিরোধ নেই। অথচ আধুনিকতা উত্তর আধুনিকতা নিয়ে চুল ছেঁড়াছিঁড়ির লড়াই যেন থামতেই চায় না!
অনেকে আজকাল কবিতায় পরাবাস্তবতার অর্থ দাঁড় করাচ্ছেন ‘বাক্যের অযৌক্তিক প্রকাশ’ বলে। এটি যথার্থ নয়। পরাবাস্তবতায় অযৌক্তিকতার কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে যুক্তিহীনভাবে সাহিত্যসৃষ্টিকে উপস্থাপনের কথা (ঘড়হ-ষড়মরপধষষু ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ ৎধঃযবৎ ঃযধহ রষষড়মরপধষষু)। পরাবাস্তবতা মগ্নচৈতন্যকে অর্থহীনভাবে অবোধ্যভাবে কবিতায় তুলে আনাকে সমর্থন করে না বরং কবির মগ্নচৈতন্যকে সঠিক ভাব ভাষার মাধ্যমে অর্থবহ করে রূপায়িত করাকে উৎসাহিত করে। পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা মতবাদটির সব শর্ত পূরণ করে বিনির্মিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় বিমূর্ততা রয়েছে কিন্তু অর্থহীনতা নেই। আপাত দৃষ্টিতে জীবনানন্দের অনেক চিত্রকল্পকে অযৌক্তিক বোধ হলেও, বোদ্ধা পাঠকমাত্রই ধরতে পারবেন তা কতটা যুক্তিপূর্ণ ও কতটা গভীর চিন্তা চেতনা থেকে উৎসারিত হয়েছে।
অন্যদিকে কলাকৈবল্যবাদেও অর্থহীনতা চর্চার নির্বিচার অনুমোদন মেলে নাÑশর্ত সাপেক্ষ। সে শর্ত এ মতবাদের মূল বক্তব্যেই নিহিত। এর বক্তব্যের মূলসুর হলো শিল্পী বা সাহিত্যিক আপন উদ্দেশ্যে আপন মনে আপনার জন্য নির্মাণ করবেন শিল্প সাহিত্য। সে দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতা বা শিল্প এমনভাবেও সৃষ্ট হতে পারে যার অর্থ কেবল সেই কবি বা শিল্পীই বুঝবেন, পৃথিবীর আর কারো না বুঝলেও চলে। কিন্তু শর্ত এখানেই যে তা হতে হবে কেবল এবং কেবলমাত্র ‘আপনার জন্য নির্মাণ’, উক্ত কবি বা শিল্পী ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির জন্য নয়। যখন কবিতা দ্বিতীয় কোন ব্যক্তিকে বোঝাবার উদ্দেশ্যে রচিত হবে, তখন তা আর ‘আপনার জন্য নির্মাণ’ বলে গণ্য হবে না। অর্থাৎ তখন সৃষ্টির অবশ্যই অর্থবাচকতা থাকতে হবে।
ঠিক বিজ্ঞানের মতো গাণিতিকভাবে স্পটতর না হলেও কাব্য সাহিত্যে কিছু শাশ্বত তত্ত্ব চিন্তা রয়েছে যা ভিত্তি হিসেবে এর ক্রমবিকাশকে একটি বিচারিক মানদ-ের মধ্যদিয়ে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। এই মূল ভিত্তিগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার/অপব্যবহার কাব্য সাহিত্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং একে একটি অস্থিতিশীল পরিম-লের দিকে ছুড়ে দেয়।
এসব বিষয় বিচার বিশ্লেষণ না করে সাম্প্রতিক অর্থহীনতার চর্চাকে উৎসাহিতকরণ হবে মদ্যপ ব্যক্তির সাময়িক উত্তেজনা উম্মাদনাকে সমর্থন করার নামান্তর। এ ধরনের কাব্য চর্চার দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন সাহিত্য ধারা ও মতবাদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের পাশাপাশি সেগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়সাধনপূর্বক প্রকৃত নির্যাস ছেঁকে বের করে আনতে প্রয়াসী হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন