অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান : মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরতœ (জন্ম ২২ জানুয়ারি ১৮৬০, মৃত্যু ১৮ অক্টোবর ১৯২৫) প্রধানত কথাসাহিত্যিক হিসাবে সুপরিচিত। কিন্তু প্রথম জীবনে তিনি প্রবন্ধ রচনা শুরু করেন এবং দু’টি প্রবন্ধগ্রন্থও প্রকাশ করেন। তিনি একজন শক্তিশালী গদ্য লেখক এবং তার লেখায় ইতিহাস ও সমাজ-সচেতনতার পরিচয় ফুটে ওঠে। এছাড়া, যুক্তি-তত্ত্ব-তথ্য ও মননশীলতার দিক থেকেও তার প্রবন্ধ রচনা সুসমৃদ্ধ। কিন্তু তার প্রথম জীবনের গদ্য রচনাসমূহ দু®প্রাপ্য হওয়ায় সে সম্পর্কে অনেকেই অনবহিত এবং তার আলোচনাও বড় একটা দেখা যায় না। তবে নজিবর রহমান যে সমাজমনষ্ক ব্যক্তি ছিলেন, তা এসব রচনাবলী থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই এগুলো বাদ দিয়ে নজিবর রহমানের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
ছাত্রজীবন থেকে বিশেষভাবে বলতে গেলে, ঢাকায় নর্মাল পড়ার সময় থেকে তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ঢাকায় নর্মাল পড়াকালে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করে তার শিক্ষকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। এসময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও তার লেখা ছাপা হয়। তবে সেগুলো পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে কিনা, তা জানা যায়নি। বিশিষ্ট গবেষক ডক্টর গোলাম সাকলায়েন প্রদত্ত তথ্যমতে ‘ইসলাম প্রচারক’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম তার তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ তিনটির শিরোনাম : ‘পবিত্র নিদর্শন, মুসলমানের সপ্তরতœ’, ‘তীব্বতে মুসলমান এবং তীব্বতবাসীর আচার ব্যবহার’ ও ‘পূর্বস্মৃতি- কুতুবুদ্দিন আয়বেক’। শেষোক্ত রচনাটি ১৯০১ সালের জুলাই-আগস্ট (৪র্থ বর্ষ, ১ম-২য় সংখ্যা) ইসলাম প্রচারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ যাবৎ প্রাপ্ত তার রচনার মধ্যে এটিই প্রথম। এটি একটি ইতিহাস বিষয়ক রচনা। এটি বা প্রথমোক্ত দুটি রচনার কোনটিই তার কোনো গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তিনি আজীবন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষক হিসাবে ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায় বা চরিত্র সম্পর্কে তার মনে কৌতূহল বা আগ্রহ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। এ কারণে তিনি তার শেষোক্ত রচনাটি লিখে পত্রিকায় প্রেরণ করেছিলেন বলে অনুমিত হয়। তবে এ ধরনের আরো প্রবন্ধ বা গ্রন্থ তিনি এর আগে বা পরে লিখেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য তিনি যে ইতিহাস-সচেতন ব্যক্তি ছিলেন এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তার রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘চাঁদতারা’ বা ‘হাসন-গঙ্গা বাহমণি’।
নজিবর রহমানের পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়ে উপন্যাস রচনা করেন। কিন্তু ইতিহাসের নামে তিনি মূলত ইতিহাসের বিকৃতি সাধন ও চরম সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্রয় দিয়েছেন। ঐ সময় মীর মশাররফ হোসেন ও মহাকবি কায়কোবাদও ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে যথাক্রমে ‘বিষাদ সিন্ধু’ ও ‘মহাশশ্মান’ কাব্য রচনা করেন। বিষাদ সিন্ধুতে কিছুটা অতিরঞ্জন থাকলেও মহাশশ্মান কাব্যে কোন রকম বিকৃতি বা অতিশয়োক্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে, নজিবর রহমান এক্ষেত্রে কায়কোবাদকেই আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন।
ডক্টর সাকলায়েন উল্লেখ করেন, নজিবর রহমানের ‘বিলাতীবর্জ্জন রহস্য’, সাহিত্যিক, ১২শ বর্ষ, বসন্ত সংখ্যা, ১৩৮৪, পৃ-১৭৫ ছাপা হয়। যেহেতেু নজিবর রহমানের পূর্বকৃত কোনো রচনার সন্ধান পাওয়া যায়নি, অতএব উপরে বর্ণিত শেষোক্ত প্রবন্ধের প্রকাশকাল থেকে তার মৃত্যু অবধি কমপক্ষে চব্বিশ বছরকে তার সাহিত্যচর্চার কাল ধরা যায়। তেষট্টি বা পঁয়ষট্টি বছর আয়ুষ্কালে নজিবর রহমান মাত্র বাইশ/চব্বিশ বছর সাহিত্যচর্চা করেছেন। এ সময়কালকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯০১-০৫ প্রথম ভাগ। তারপর ১৯১৪ সালে ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস প্রকাশিত হবার সময় থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দ্বিতীয় ভাগ। এ সময় তিনি অত্যন্ত সৃষ্টিমুখর ছিলেন এবং এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তার রচিত ছোট-বড় মোট তেরটি গ্রন্থের এগারটি অর্থাৎ গড়ে বছরে একটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন।
উপরোক্ত দু’ভাগে বিভক্ত সময়ে রচিত তার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যও এক নয়। প্রথমভাগে রচিত তার সব সাহিত্যই প্রবন্ধ-নিবন্ধ জাতীয় রচনা। এ সময় তিনি কোনো গল্প-উপন্যাস রচনা করেননি। দ্বিতীয় ভাগে তিনি কোনো প্রবন্ধ রচনা করেননি। এ সময়কার সব রচনাই উপন্যাস ও গল্প। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে তার রচিত সব উপন্যাস ও গল্পের আঙ্গিক প্রায় একই রকম। এখানে বৈচিত্র্য বা ক্রম-উৎকর্ষ তেমন একটা চোখে পড়ে না। তাই তার প্রথম রচিত উপন্যাসই তার শ্রেষ্ঠ রচনা হিসাবে গণ্য হয়ে থাকে। পরবর্তী রচনাসমূহ মূলত প্রথম রচনারই অনুবর্তন বা অনুসরণ বলা যায়। এছাড়া, তার প্রথম ভাগের রচনায় রাজনীতি ও সমাজ-উন্নয়নের বিষয় সরাসরি স্থান লাভ করেছে কিন্তু দ্বিতীয় ভাগের রচনায় রাজনীতির প্রসঙ্গ অনুপস্থিত।
প্রথম ভাগের রচনায় উপর্যুক্ত তিনটি প্রবন্ধ ছাড়া উল্লেখযোগ্য দুটি প্রবন্ধ-গ্রন্থ হলো : ‘সাহিত্য-প্রসঙ্গ’ (প্রকাশকাল বাংলা ১৩১১, ঈসায়ী ১৯০৪) ও ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ (প্রকাশকাল : বাংলা ১৩১১, ঈসায়ী ১৯০৫)। দু’টি গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। গবেষক বুলবুল ইসলাম তার ‘বাংলা সাহিত্যে নজিবর রহমান সাহিত্যরতেœর অবদান’ শীর্ষক নিবন্ধে সাহিত্য-প্রসঙ্গ সম্পর্কে বলেন : “বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জাতিসত্তার আলোকে সাহিত্য সৃষ্টি, সাহিত্য-শিল্পের প্রতি সমকালের শিক্ষিত মুসলমানদের অনীহা এবং তার পরিণাম, স্বাধীনতা এবং মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য সাহিত্যিকদের কর্তব্যবোধ, সর্বোপরি ভৌগোলিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলামী উম্মার ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব এবং যৌক্তিকতা নিরূপণই ‘সাহিত্য-প্রসঙ্গ’ গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধমালার মৌল বিষয়।” (বুলবুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্য নজিবর রহমান সাহিত্যরতেœর অবদান)।
‘সাহিত্য-প্রসঙ্গ’ বইটিতে শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিম সমাজের উন্নতির বিষয় আলোচিত হয়েছে। মুসলমানদের অবনতির মূল কারণ অশিক্ষা, পরাধীনতা ও মুসলমানদের প্রতি ইংরাজ ও হিন্দুদের চরম বিদ্বেষ ও ঈর্ষাপরায়ণতার উল্লেখ থাকায় বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়।
নজিবর রহমানের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম এলাকা নিয়ে এক নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। নতুন প্রদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন মুসলিম। ঢাকায় রাজধানী স্থাপিত হওয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার রাস্তাঘাট ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়। নতুন প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হওয়ায় এখানে সর্বদা মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। হিন্দু প্রতিপক্ষ এটা মেনে নিতে পারে নি। তাছাড়া, হিন্দু জমিদারদের জমিদারী এ এলাকায় হলেও তাদের অধিকাংশের বসবাস ছিল কলকাতায়। নতুন প্রদেশ গঠিত হওয়ায় কলকাতার হিন্দু জমিদার-মহাজন ও বাবুশ্রেণির আধিপত্য যে বহুলাংশে খর্বিত হবে, এ আশংকায় তারা শুরু থেকেই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে। বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য তারা অসহযোগ আন্দোলন, বিলাতি দ্রব্য বর্জ্জন ইত্যাদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। মূলত ভারতের স্বাধীনতার দাবি হিসাবে তারা অসহযোগ আন্দোলন, বিলাতি বর্জ্জন ইত্যাদির কথা বললেও তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গভঙ্গ রদ। নজিবর রহমান এটা উপলব্ধি করেই ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। মুসলমানরা যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সেজন্য তিনি বিলাতি দ্রব্য বর্জ্জনের আসল রহস্য জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। বত্রিশ পৃষ্ঠার অনতিদীর্ঘ গ্রন্থের মুখবন্ধে লেখক বলেন :
“বিলাতী বর্জ্জন রহস্য প্রকাশিত ও প্রচারিত হইল। ইহাতে গবেষণা যুক্তি প্রমাণ কিছুই নাই। নিত্য প্রত্যক্ষ সত্য দৃষ্টান্তই ইহার মূল ভিত্তি। দ্রুততা ও সময়ের অভাববশতঃ ভাষা ও বর্ণশুদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখিতে পারা যায় নাই। সর্ব্ব সাধারণ যাহাতে বুঝিতে পারে তৎপ্রতি লক্ষ্য ছিল। অতএব প্রার্থনা-মহাদয়বিদ্বান পাঠক তজ্জন্য কপাল কুঞ্চিত করিবেন না। এই সামান্য পুস্তকে সমাজের সামান্যটুকু উপহার হইলেও শ্রম সার্থক বিবেচনা করিব।” (ডক্টর গোলাম সাকলায়েন : মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরতেœর ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’, সাহিত্যিকা, ১২শ বর্ষ, বসন্ত সংখ্যা, ১৩৮৪, পৃ. ১৫৭)।
লেখক বইটি উৎসর্গ করেন সিরাজগঞ্জ জেলার সাতটিকারী নিবাসী মুন্সী মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনকে। উৎসর্গ পত্রটি এরূপ : “মাননীয় সুহৃদ, সমাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যায়, প্রায় সকল লোকই নিরন্তর স্ব স্ব স্বার্থ সাধনে ব্যস্ত আছে, ক্বচিৎ বিরাম বিশ্রামের সময়টাও তাহারা বাহুল্য পচালে, হাসি-তামাশায় ও তাস পাশায় ক্ষেপণ করে। কিন্তু আপনাকে সেরূপ দেখিনা। আপনি, কিসে পতিত মুসলমান জাতির পুনরুন্নতি হইবেÑ কিসে সমাজের প্রকৃত মঙ্গল সাধিত হইবে, কিসে নিরক্ষর সরলপ্রাণ কৃষককুল পেট ভরিয়া একমুঠা পাইবে ইত্যাদি মনুষ্যোচিত চিন্তায় ও কার্যে অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করিয়া থাকেন। তাই আজ আমি আমার সাধের এই ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ স্বদেশী তরঙ্গের যুগে আপনার স্বদেশ ও সমাজ হিতৈষিতার কর্মঠ উদার হস্তে অর্পণ করিলাম। সাধের সামগ্রী সামান্য হইলেও সুহৃদের নিকট উপেক্ষণীয় নহে, ইহাই ভরসা। ইতি।” (প্রাগুক্ত পৃ. ১৫৭)।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে বৃটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার্থে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্বাঞ্চলে একটি প্রদেশ গঠন করে। দীর্ঘ অবহেলার কারণে সর্বদিক দিয়ে এ অঞ্চলের জনগণ অত্যন্ত দরিদ্র-বঞ্চিত ও দুর্দশার সম্মুখীন হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে এ অঞ্চলের উন্নতি ত্বরান্বিত হয় এবং নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে এ পশ্চাদপদ এলাকা দ্রুত উন্নতি লাভ করতে থাকে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ লোক যেহেতু মুসলিম, সেহেতু এ অঞ্চলের উন্নতির অর্থ মুসলমানদের উন্নতি। উপরন্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হওয়ায় এ অঞ্চলে প্রশাসনিক ক্ষমতা মুসলমানদের হাতেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া, এ অঞ্চলের হিন্দু জমিদারদের অধিকাংশই তখন কলকাতায় বসবাস করতো। বঙ্গভঙ্গের ফলে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে। একারণে হিন্দু সম্প্রদায় শুরু থেকেই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে। এমনকি, ইংরাজ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদে বাধ্য করার জন্য মহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসাবে ভারতীয় কংগ্রেস বিলাতী দ্রব্য বর্জ্জনের আহ্বান জানায়। অসহযোগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইংরাজ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদে বাধ্য করা। হিন্দুদের এ আন্দোলনের মূল রহস্য উদ্ঘাটন করে নজিবর রহমান মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তার ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ গ্রন্থ রচনা করেন।
‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ সম্পর্কে নজিবর রহমানের জীবনী-লেখক তার স্নেহধন্য ছাত্র ও পরবর্তীতে জামাতা খন্দকার বশিরউদ্দিন বলেন : “তৎকালে বিলেতী কাপড়, বিলেতী লবণ এবং আরও অন্যান্য বিলেতী পণ্যদ্রব্য ব্যবহার না করার জন্যে হিন্দু কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ যে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন তার ফলাফল নিয়েই তিনি ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ নামক পুস্তিকাটি লিখেন। এ গ্রন্থের ভাষা ও বিষয়বস্তু এতই সত্য ও তীক্ষè যে, মুসলিম-বিদ্বেষী হিন্দুদের প্রাণে এর ফলে তীক্ষè শরের মত আঘাত করেছিল। সেই জন্যেই তারা এর বিরুদ্ধে প্রোপাগা-া চালিয়ে ইংরেজ সরকারের নিকট আবেদন করে এবং তৎকালীন ইংরেজ শাসনকর্তা কর্তৃক এটা বাজেয়াপ্ত হয়। এই পুস্তিকায় নজিবর রহমান ইংরেজ ও মুসলিম-বিদ্বেষী হিন্দুদের সম্বন্ধে অপ্রিয় অথচ উচিত ও সত্য কথা লিখেছেন। অপরদিকে মুসলিম সমাজে জাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এদেশের মুসলিম সমাজকেও ধিক্কার প্রদান করেছিলেন। এ পুস্তিকার এক স্থানে তিনি মুসলিম সমাজকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনÑ যে নক্ষত্র ভূমিতলে হয় নিপতিত/তাহা হতে নিম্নে তুমি পড়েছ নিশ্চিত।” (খন্দকার মো. বশিরউদ্দিন : মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরতœ, এপ্রিল ১৯৮৭, পৃ. ৩৩-৩৪)।
সাহিত্য-প্রসঙ্গ এবং বিলাতী বর্জ্জন রহস্য বই দুটি প্রকাশের পরই তৎকালীন সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়, একথা আগে উল্লেখ করেছি। এর ফলে ঐ সময়কার রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দ্বারা মুসলমানদের নিগ্রহ ভোগের পরিচয় ফুটে ওঠে। বই দু’টি বাজেয়াপ্ত হবার পর ‘উত্তরবঙ্গে মুসলমান সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে হামেদ আলী লেখেন : “১. বিলাতী বর্জ্জন রহস্য, ২. সাহিত্য-প্রসঙ্গ। সলঙ্গা মাইনর স্কুলের হেড প-িত মুন্সী নজিবর রহমান প্রণীত। ভাষা সাধু বাঙ্গলা। বাঙ্গলা ভাষার প্রতি ইহার বেশ অনুরাগ আছে, ইনি আরও পুস্তক লিখিতেছেন।”
নজিবর রহমান যখন উপরোক্ত গ্রন্থদু’টি রচনা করেন, ঐ সময় তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। সলঙ্গায় ‘আঞ্জুমানে ইসলাম’ সমিতি গঠন, অত্যাচারী হিন্দু জমিদার কর্তৃক মুসলিম প্রজা-পীড়ন রোধ, গো-কোরবানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য প্রতিবাদ সভার আয়োজন, ১৯০৬ সালে শাহবাগে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে যোগদান এবং সেখানে মুসলমানদের গরু কোরবানির ওপর অত্যাচারী হিন্দু জমিদারের নিষেধাজ্ঞা ও মুসলিম প্রজাপীড়নের বিষয় তুলে ধরা, বড় লাটের কাছে এ ব্যাপারে দরখাস্ত প্রেরণ এবং সরকার কর্তৃক গো-কোরবানি পুনঃপ্রবর্তন ইত্যাদি কাজে তখন তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। প্রজাপীড়ক অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের দ্বারা জীবননাশের ভয়ে এসময় তার আত্মগোপনে থাকা ইত্যাদি নানা ঘটনা ও আন্দোলন-সংগ্রামের দ্বারা বোঝা যায়, এ সময়টি তার জীবনের সর্বাধিক সংগ্রামমুখর এক কঠিন দুঃসময়। তার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিষয় ও মুসলিম সমাজের দুরবস্থা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে তিনি যে ঐ সময় গভীরভাবে চিন্তা করেছেন, তার প্রতিফলন ঘটেছে উপরোক্ত দু’টি প্রবন্ধ গ্রন্থে। তাই সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপস্থাপনা ও স্বসমাজের উন্নয়নে তার আন্তরিক প্রচেষ্টার বিষয় এ দু’টি গ্রন্থে ফুটে উঠেছে। এ কারণে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন