ড. গুলশান আরা : জীবেন্দ্র সিংহের মতে, ‘ব্রজাঙ্গনা’ মধুসূদনের প্রতিভার খেলা। কিন্তু সেই খেলাকে লঘুবাচক মনে করার কোন কারণ নেই। কাব্যের কাননে স্বচ্ছন্দ বিহারের প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন যিনি, মিত্র ও অমিত্র ছন্দে তাঁর সমান অধিকার থাকা স্বাভাবিক। মধুসূদনের বিশ্বাস ছিল, অমিত্রাক্ষরেই বাংলা কাব্যের মুক্তির পথ নিহিত। ‘ব্রজাঙ্গনা’র মিত্রছন্দ সেই বিশ্বাসের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের ভাবিয়ে তোলে। মিত্রছন্দে তাঁর পক্ষপাত ছিল না তাই ‘ব্রজাঙ্গনা’ তাঁর প্রতিভার খেলা। যথার্থ শিল্পনিষ্ঠা নিয়ে সৃষ্টির আসরে নেমে ছিলেন বলেই মধুসূদনের প্রতিভার কাজ ও খেলায় শক্তির সমান র্স্ফুতি বলে মনে করি।’
‘ব্রজাঙ্গনা’র কাব্যরীতির বিচারে ছন্দের কথা ছাড়াও আরো কথা উঠতে পারে। যেমন মহাজন কবিদের পদাবলী প্রসঙ্গ। পদাবলী মূলত গান- তার সঙ্গে যুক্ত আছে সুরের যোগ। তাই কথা ও সুর মিলিয়ে সেখানে রয়েছে ভাব ও রসের পূর্ণতা। আছে ভক্তের আন্তরিক আকুতি। কবি এবং সাধক সেখানে একাকার। কিন্তু আজকের দিনে বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদের জগৎ থেকে পাঠক অনেক দূরে সরে এসেছেন। রাধাকৃষ্ণ বেঁচে আছেন শুধুমাত্র রসিকজনের চিত্তে-সৌন্দর্যের অম্লান প্রতীক রূপে। মধুসূদন তা ভালই উপলব্ধি করে ছিলেন- তাই রাধা তাঁর মনে রসসম্ভবা, সৌন্দর্য বিভূষিতা নারীমাত্র। ধর্মের ধূম্রজাল থেকে উদ্ধার করে রাধাকে নূতন যুগের মানুষের কাছে নূতন রোমান্টিকতায় ডিপস্থাপন করাই মধুসূদনের উদ্দেশ্যে ছিল। রাধাকে নিয়ে কবি ওপিই জাতীয় যে গীতি কবিতা রচনার প্রয়াস পেয়েছেন তা আমাদের শ্রুতিসৌন্দর্য ও রসবোধকে তৃপ্ত করে-
কেন এত ফুল তুলিলি, স্বজনি
ভরিয়া ডালা?
মৃঘা বৃত হলে পরে কি রজনী
তারার মালা?
আর কি যতনে কুসুম রতনে
ব্রজের বালা?
নূতন ধরনের স্তবক রচনায় মধুসূদন যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, আমরা তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারি না।
আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন বৈষ্ণব পদাবলী এবং ‘ব্রজাঙ্গনা’র মধ্যে তুলনা করার প্রশ্নই আসে না- কারণ অন্তর্মুখী পরিচয়েই যে বৈষ্ণব পদাবলী ও ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য এক নয়- তাই না- এদের মধ্যে বহির্মুখী পরিচয়ও পরস্পর স্বতন্ত্র।
বৈষ্ণব পদাবলীতে সাধারণত শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার পূর্ব রাগ, অভিসার, মিলন, মান, আক্ষেপ, বিরহ, ভাব সম্মিলন ইত্যাদি বিষয় বর্ণিত। ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যে কেবলমাত্র বিরহই বর্ণিত হয়েছে। আর কোন বিষয় বর্ণিত হয়নি। তবে মধুসূদনের কাব্যে পদাবলীর বিরহের মত আক্ষেপানুরাগ এবং পরিণতিতে ‘ভাব সম্মিলনের বর্ণনা নেই। তাঁর বিরহ যেন লৌকিক বিরহ। যে সূক্ষ্মভাব চেতনায় বৈষ্ণব কবির লেখায় অখ- তৃপ্তির সুর বেজে ওঠে মধুসূদনের বিরহে তা নেই। আমরা জানি বাংলাদেশে ‘কানু ছাড়া গীত নাই’-কিন্তু কানুবিষয়ক গীত মাত্রই এদেশে বৈষ্ণব কবিতা নয়- তেমনি ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য ও বৈষ্ণব কবিতা না।
‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যে আঠারটি গীতি কবিতা আছে, মধুসূদন প্রত্যেকটির একটি করে শিরোনাম দিয়েছেন যা আধুনিক রোমান্টিক কবিতার বৈশিষ্ট্য। বৈষব কবিদের পদগুলো মধুসূদনের গীতি কবিতা থেকে আকারে ছোট- এগুলোর পরিচয় বহির্মুখী বিস্তারে নয়-অন্তর্মুখী গভীরতার। মধুসূদনের কবিতায় সেই অন্তর্মুখী গভীরতা নেই বলে বহির্অঙ্গ দীর্ঘতর হয়েছে।
বৈষ্ণব কবিতার অনুসরণে মধুসূদন তাঁর কাব্যে ব্রজবুলি অর্থাৎ মৈথিলী বাংলা বা মিশ্রভাষা ব্যবহার করেননি। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গীতি কবিতার স্বাভাবিক ভাষাতেই তাঁর কাব্য রচনা করেছেন।
গৌরচন্দ্রিকা ব্যতীত বৈষ্ণব কবিতা হয় না- কিন্তু মধুসূদন এই রীতি অনুসরণ করেননি- তিনি বরং প্রত্যেক কবিতার শেষে নিজের নামের ভণিতা ব্যবহার করেছেন। এটি বৈষ্ণব পদাবলীর একটি নিজস্ব রীতি হলেও প্রাচীন যুগ হতে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত প্রায় কবিই ভণিতা ব্যবহার করেছেন। সুতরাং মধুসূদনের উপর এই প্রভাব বৈষ্ণব পদাবলীর যতখানি তারচেয়ে ভারতচন্দ্রের প্রভাব- অনেক খানি বলে মনে করা যায়। বৈষ্ণব পদাবলীতে ‘বংশীধ্বনি’ পূর্বরাগের বিষয়, বিরহের বিষয় না। কারণ যেখানে বিরহ সেখানে শ্রীরাধার বংশীধ্বনি শোনার কথা না- তবু দেখা যায় বিরহের বহু পূর্বে বংশীধ্বনি শুনে শ্রীরাধার মনে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রথম অনুরাগের সৃষ্টি হয়। বৈষ্ণব কবিগণ এমনকি বড়ুচন্দ্রী দাস তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বংশী খ-ের বহু পূর্বে বর্ণনা করেছেন-
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।....
দাসী হআঁ তার পাত্র নিশিবো আপনা।
কিন্তু মধুসূদন তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্য রচনায় বিরহের মধ্যেই ‘বংশীধ্বনি’ নামক একটি পদে লিখেছেন-
কে ও বাইজাইছে বাঁশী, সজনি,
মৃদু মৃদু স্বরে নিকুঞ্জ বনে?
নিবায় উহারে, শুনি ও ধ্বনি
দ্বিগুণ আগুন জ্বলে গো মনে?
এতে মনে হতে পারে বৃন্দাবনে হয়তো অন্য কেউ বাঁশি বাছাচ্ছে অথচ বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত অন্য কারো বাঁশি বাজাবার কথা নয়। কৃষ্ণর বংশীধ্বনি শুনেই শ্রীরাধার হৃদয় সর্বদা ব্যাকূল। কারণ শ্রীকৃষ্ণ সেখানে সাধারণ প্রেমাখ্যানের নায়কমাত্র নন- তিনি পরমআত্ম। কিন্তু মধুসূদনের শ্রীকৃষ্ণ পার্থিব সংসারের একজন প্রেমিকমাত্র। সুতরাং ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য কয়েকটি রোমান্টিক গীতি কবিতার সমষ্টিমাত্র, এটা বৈষ্ণব পদাবলী না।
বৈষ্ণব পদাবলীতে বিভিন্ন ঋতুতে রাধার মনের ফুল ফুটেছে সত্য, তবে মনো বিন্যাসে রসসূত্রটাই প্রবল। প্রকৃতি সেখানে গৌন ভূমিকা রেখেছে মাত্র। কিন্তু ‘ব্রজাঙ্গনা’য় রাধার মনের সঙ্গে প্রকৃতির অঙ্গাঅঙ্গি সম্বন্ধ-প্রকৃতির আরশিতে যেন সেই মনের সত্যিকারের প্রতিফলন।
ফুটিছে কুসুম কুল মাজু মঞ্জু বনে, রে,
যথা গুন মনি!
হেরি মোর শ্যাম চাঁদ, পীরিতের ফুল-ফাঁদ
পাতেলো ধরণী।
কি লজ্জা! হা ধিক তারে ছয় ঋতু বরে যারে,
আমার প্রাণের ধন লোভে যে রমণী?
(বংশী ধ্বনি)
বৈষ্ণব কবিতায় ‘বসন্তঋতু’ মিলনোৎসবের ঋতু, এতে বেদনা-বিচ্ছেদ অভাবনীয়। মধুসূদন বসন্তঋতুর প্রসঙ্গ এনেছেন সত্য কিন্তু তার ভিতর দিয়ে বিরহের বেদনা অনুভব করেছেন-
‘ফুটিল বকুল ফুল কেন গো গোকুলে আজি
কহ তা সজনি?
আইলা কি ঋতুরাজ ধরিলা কি ফুলসাজ
বিলাসী ধরণী?
মুছিয়া নয়ন জল চললো সকলে চল,
শুনিব তমাল তলে বেনুর সুরব
আইল বসন্ত যদি, আসিবে মাধব।’
এ কাব্যে কবি মধুসূদন রাধা-বিরহের গান গেয়েছেন-তত্ত্ব বা রূপক-সম্বলিত বৈষ্ণব ভাব এখানে নেই, সহজ লিরিকে ভাবটাই এখানে প্রধান। বলা যায় এটা বৈষ্ণব মহাজন-পদাবলীর আধুনিক পরিণতি। রাধা-কৃষ্ণ বিষয়য় খ- কাব্য।
খ- কাব্য হলেও ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্যের মধ্যেই মধুসূদনের গীতি কবিতা রচনার শ্রেষ্ঠ গুণ বিকাশ লাভ করেছে। কারণ তাঁর ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ প্রাচীন পদ্ধতির মহাকাব্যের ছায়াতলে রচিত। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলীর মধ্যেও ছন্দ ও মিল সম্পর্কিত নিয়মের যে নিগড় বন্ধন রয়েছে তাও অনেকাংশে গীতিকবিতার স্বাধীন রসস্ফূর্তির অন্তরায় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্যে’ এইসব ত্রুটি নেই।
জীবেন্দ্র সিংহের ভাষায় আবার বলতে হয় ‘কেউ কেউ বলেছেন, কবিতাগুলো সম্বন্ধে মধুসূদনের আগ্রহ অপেক্ষা কৌতুক বেশি। আমরা বলি, হ্যাঁ, কৌতুকই, তবে সত্যিকারের কবি মানসের কাব্য কৌতুক, লঘুচিত্তের তরলমতিত্ব নয়।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন