সাফি উল্লাহ্ : ইচ্ছা না থাকলেও সাজিদকেই যেতে হলো। ওর মনে হয়- হেডমাস্টার আর বাবার ঝামেলাগুলো নিয়ে তাদেরই বসা উচিৎ। তবুও বোনের ব্যাপারটা মাথায় রেখে গেল।
বাড়ি থেকে হেঁটেই স্কুল যাওয়া যায়। এইট পর্যন্ত হেঁটেই ক্লাস করেছে। নাইনে উঠে আটশ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একটা সাইকেল কিনেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড তো নয়-ই, ফিফথ্ হ্যান্ডেরও বেশি হতে পারে। এতে করেই আসত। কিন্তু সে অনেক আগের কথা। কম করে হলেও পাঁচ ছ’ বছর তো হবেই। আজ সাইকেল নিল না। গাঁও-গিরামের কথা, বুলা যায় না। ও তো তোর গায়ে হাতও তুইলতে পারে। সাইকেল থাকলে রিঅ্যাক্ট করতে সমেস্যা হবে। দাদা বেঁচে থাকলে এমন কথা বলত বলে তার মনে হয়।
টয়লেটে গিয়ে কমোডে বসে অনেক কথা মনে হয়েছে তার। লুঙ্গি গুছিয়ে বসার সময়ে আঁতকে উঠেছে একবার। যদি বসার সময়েই হেডমাস্টার চ্যাঁচামেচি শুরু করে, তবে কী করবে? স্কুলের অন্য মাস্টারেরা কি তার পক্ষে কথা বলবে? বলবে বলে তার মনে হয় না। সবাই বিপদে আছে। নিজেরাই আন্ধারে পথ চলতে পারছে না, অন্যকে সহযোগিতা করার সুযোগ কোথায়?
নাকে গন্ধ লাগে। পচা গন্ধ। অফিসে ইঁদুর মরে পচে পড়েও থাকতে পারে। চেয়ারে বসেই আড়চোখে তাকায় চারদিকে। টেবিলের নিচেও। নাহ্, কিছু পড়ে নেই তো। হঠাৎ হেডমাস্টার হাত উঁচিয়ে আসেন সাজিদকে মারার জন্যে। সাজিদও প্রস্তুত। একটু চিল্লানি দিলে স্কুল ফিল্ডের ওপাশের আসলামের দোকান থেকে দশ-বারো জন ছেলেপেলে দৌড়ে আসবে। ওদেরকে ও দাঁড়াতে বলেছে। এজন্য নাজিম দাদার কাছ থেকে সবার হাতে বারভাজার প্যাকেট দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থায় ডাকলে তো নিজের ইজ্জত বলে কিছুই থাকবে না। সামান্য হেডমাস্টারের জন্যে এতগুলো ছেলে ঠিক রাখার কী দরকার? তাছাড়া, হাজার হলেও শিক্ষক। আগে হলেও তো পড়িয়েছে। খারাপ আচরণ করা মোটেও ঠিক হবে না।
কিন্তু এ বয়সেও যদি স্কুলে এসে পিটুনি খেতে হয়, এটা অবশ্যই লজ্জাজনক। আবার, এ স্কুলের অনেক ছাত্রকে সে আগে পড়িয়েছে, ওরা দেখে ফেললেও মান-সম্মানের যায়যায় অবস্থা হবে। শেষে নিজের হাত দিয়েই আপাতত প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিল। মাস্টারের হাত চোয়াল সোজা আসার আগেই ডান হাত দিয়ে ধরে ফেলল। তন্দ্রা কেটে যায় তখনই। হাত ঠেকে পায়খানার প্লাস্টার করা দেয়ালে।
প্রথমে অফিসে ঢুকে সালাম দেবে কি না চিন্তা করে। না, সালাম দিতেই হবে। একটা সালাম পাওয়া মাস্টারের নৈতিক অধিকার। অন্ততপক্ষে তাকে তো পাঁচটি বছর পড়িয়েছে। সালাম সে দেবেই। উত্তর না নিলে ওয়াজিব ভঙ্গের গুনাহ্ পাবে মাস্টার। তার কী যায় আসে? সে তার দায়িত্বে অনড়। ব্যক্তিগত পারিবারিক কলহের জের ধরে শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করা তার সাজে না। সুন্দরভাবেই বলবে- স্যার, বর্ষার কাগজগুলো দিয়ে দেন। ওকে দাখিলে ভর্তি করাব।
না, এভাবে নয়। আরো ন¤্রতার সাথে বলা দরকার। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়েও যদি ন¤্রতা শিখতে না পারে, তাহলে তো জীবনের সব শিক্ষাই বৃথা।
নাকে গন্ধটা আবার স্পষ্ট হয়। এটা পচা ইঁদুরের গন্ধ না, পেট খারাপ হওয়ায় পায়খানার এ বিশ্রী গন্ধ। দ্রুত পানি খরচ করে বেরিয়ে আসে।
কী কী বলবে- মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু ফিল্ডে পা দেয়ার সাথে সাথেই সব ভুলে যায়। একটা কথাও মনে করতে পারে না। হাতের কাছে বালিশটা থাকলে ইচ্ছামত ঘুষি মারত। এতে রাগ কিছুটা কমত।
একটু হাঁটতেই প্রথমে স্কুলের টয়লেট। সাজিদদের সময় ছেলেরা ব্যবহার করত। এখন এটা অপরিচ্ছন্ন। তিনতলা নতুন ভবনে ক্লাস হওয়ায় কেউ আর হেটে এখানে আসে না। সবসময় উন্মুক্ত থাকে। সবাই ব্যবহার করে। এর পাশ দিয়ে গেলেই গন্ধ পাওয়া যায়। পায়খানার পুব দিকের দেয়ালে হেডমাস্টার অতিরিক্ত প্লাস্টার করে কালির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। স্কোর বোর্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গত ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসের স্কোর লেখা আছে এখনো। মেহগনির গাছগুলোতে ছাগলের শিঙের গুঁতা আর কাস্তের আঘাতের অসংখ্য নমুনা রয়েছে। কাছ থেকে দেখলে কিছু নাম দেখা যায়। যোগ অংকের অনুশীলনী মনে হয়। যেমন, সিফাত + রুকু, হাবিব + সালমা ইত্যাদি। তবে, কোনটাতেই সমান চিহ্ন নেই। এরা এই সব যোগের ফলাফল জানতে চায় না। এগুলোর পরিণাম নিয়ে লেখকেরা মোটেও উদ্বিগ্ন না।
এই কোনায় একটি খেরসাপাত আমের গাছ। বেশ ঝাঁকড়া। বড়ও বটে। এখানে আসতেই ক্লাস টেনের একটা ঘটনা মনে পড়ে।
সাজিদ কোনো কালেই খেলায় আগ্রহী ছিল না। কিন্তু তার সহপাঠীরা স্কুলে টুর্নামেন্টে একবার রানার্সআপ হয়েছিল। টিফিনের সময় অনেকে বাড়ি যায় না। নাজিম দাদার ভাজা খেয়ে থেকে যায়। খেলার নেশায়। আবার যদি কেউ বাড়িতেও যায়, প্রতিধ্বনির মত দ্রুত ফিরে আসে। সামনে স্কুল টুর্নামেন্ট। স্কুলের সিনিয়র ব্যাচ হিসেবে না জিতলে মানসম্মান থাকবে না। মিঠুর নেতৃত্বে রুবেল রনিরা যায় বল আনতে। সাজিদও যায়। হেডমাস্টারের এই অফিসটা তখন তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। যাহোক, তিনি তাদের বলেছিলেন, তোমাদের বাপ-মা কি কিছুই শেখায়নি? এই খাড়া দুপুরে খেলবা। মাথা ঘুরে পড়ে মরলে তো আবার আমার দোষ হবে। যাও, বল দিতে পারব না। বসে পড়গা।
শেষের বাক্য দু’টি সুন্দর হলেও আগের লাইনগুলো মনঃপুত হয়নি কারোরই। আর এই উঠতি বয়ছে বাবা-মা কে নিয়ে কটূক্তি সহ্য হওয়ার কথাও না। অতিরিক্ত বয়ানে কষ্ট পেলেও চুপ করে থাকে সবাই।
পরের দিন টিফিনে খেয়ে সবাই এই চারা আমগাছটির ডালে হেলান দিয়ে বসে থাকে। কেউ কেউ পাতা ছিঁড়ে বিভিন্ন নকশা কিংবা ফুল বানানোর চেষ্টা করে। সাদ্দামেরা ফুটবল নিয়ে খেলছে। মাঠেই। স্কুলেরই বল। দেখেই চেনা যায়। মিঠু ডাল থেকে নেমে নিচে দাঁড়ায়। গুচ্ছগ্রামের মিলন যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। হাত থেকে দা টা নিল। বল এদিকে আসতেই ধরে ফেলল। যা ভাবা, তাই করা। চার টুকরা। বলটিকে মাত্র চারটি টুকরা করল।
হৈচৈ শুরু হল। মিঠু কিন্তু পালাল না। হেডমাস্টার বেরিয়ে এলেন।
- মিঠু, বল কাটলা ক্যান?
রাগে তার কণ্ঠস্বর কাঁপা শোনাচ্ছে। হাতের আঙ্গুলও কাঁপছে। মাত্রাতিরিক্ত রাগলে এমনটি হয়।
মিঠু অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে জবাব দিল- অ্যাদের বাপ মা মাস্টারেরা মুনেহয় কিছুই শিকায়নি। তাই, একটু শিকানু আর কি। এই দুফরে খেলছে তো তাই।
সহকারী শিক্ষকেরাও হেডমাস্টারের প্রতি খুশি নন। আগ থেকেই, গ্রামের অন্য দশজনের মতোই। বল কাটায় তারা ভাবছিলেন মাস্টারকে উচিৎ জবাব দিছে। কিন্তু মিঠুর বক্তব্যে সব শিক্ষককেও কটূক্তি করা হয়েছে। তাই তাদের হাসি সহজেই মিঠুর সমালোচনার রূপ নিল।
সেদিনের ছোট্ট গাছটি আজ বেশ বড়। গাছের চারপাশে কম করে হলেও পনের-বিশটা সাইকেল। ছাত্রদের- বোঝাই যায়।
দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্কুলের মূল ভবনের দিকে। তিনতলা ভবন- ওদের সময় একতলা ছিল। নিচতলার তিনটি কক্ষের ডানদিকেরটা এখন হেডমাস্টারের। তার বাঁয়েরটার অর্ধেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক আর কেরানী বসেন। বাকি অংশে তিনজন শিক্ষিকা- হেডমাস্টারের বউ, মলি ম্যাডাম আর একজন। ওনাকে সাজিদ চেনে না। নতুন টিচার হয়েছে। বিল্ডিংয়ের শেষের রুমটা অন্যান্যদের।
ডানে-বাঁয়ে তাকালে কিছু স্টুডেন্টের সালাম পাওয়া যেত। আবার কিছু স্যার ম্যাডামকেও সালাম দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হত। সালাম দেয়া দোষের কিছু না, তবে কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। পুরনো গু আবার ঘাঁটতে আরম্ভ করবে অনেকে।
একদিন বাবাকে ডেকে রাহুল মাস্টার বলেন- হামজা, তুমি খায়্যি না খায়্যি ছেলিডাকে ঢাকা পাঠালা। আর ওখেনে যায়্যি কী কাম ডা করলো...
রাজমিস্ত্রী আবু হামজা নাম হলেও সবাই হামু বলেই ডাকে। পেটে খাবার আর পিঠে কাপড় না থাকলে নাম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এদের কিছু একটা ডাকলেই হল। তবে মাস্টার হামজা বলেই ডেকেছে। সে খুশি, তবে কথার মাথা-মু-ুু কিছুই বুঝেনি। মাস্টার হামুর ছেলেকেও পড়া বুঝায়, ওকে এটা বুঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পাত্র সে না। এবার খোলসা করে বলে,
- ঢাকাতে গিয়ে নাকি সাজিদ বিয়ে করে ফেলেছে?
বাড়িতেও কিছু না জানানোর জন্যে সেও কষ্ট প্রকাশ করে। জিহ্বা আটকে যাচ্ছিল বারবার। কথা বের হতেই চায় না। এত কষ্টের কথা কি সহজে বলা যায়!
এক মুখ দু’মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারাগ্রামে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় মিস্ত্রি। তাকে ঐকিক অংকের চেয়েও সহজ করে বুঝিয়ে দেয়- তার দিনকাল, ছেলের ভবিষ্যৎ, ঋণ শোধ না হলে কী পরিণাম হবে, ভিটার বর্তমান দাম- সমস্তকিছু। হামু মিস্ত্রির জেগে থাকা তো হারাম হয়ই, ঘুমও হারাম হয়।
মাস্টারের বক্তব্যের একাংশ ঠিক এমন- একই ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ের ফাঁদে পড়ে সে। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এ পার্ক ও পার্ক ঘুরে বেড়ায় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে। ছেলেমানুষের মন- মেয়ের ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে পড়ে নিজেও। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ধরে হাত। হাতে দু’একটা চুমু দিয়ে এগিয়ে যায় গালের দিকে, গাল থেকে ঠোঁট। তারপর একদিন দাওয়াতে যায় সাজিদ। মেয়েটার বাসায়। তারপর জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয় তাকে।
এর মাঝেও নাকি অনেক কিছু ঘটেছে, সাজিদের বাপকে সেগুলো বলতে তার শরম লাগে। তাই বলে না।
সাজিদ এগুলো প্রথমে জানে মায়ের কাছ থেকে। তারপর মোবাইলের মেসেজ, ফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে খবর পায়। যারা এ সুখবরটি বিশ^াস করতে পারেনি, তারা সরাসরি কথা বলে জেনেছে।
সাজিদ নিজেও জানে না- এত ঘটনা কবে কোথায় কীভাবে ঘটল? এরকম রোমান্টিক কিছু ঘটার পরে রটলেও ভাল লাগত।
চা স্টলের নতুন আলোচ্য বিষয়। গরম টপিক, তাত্ত্বিক আলোচনা। অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করে। যা রটে, তার কিছুটা তো ঘটেই। বা, বেচারা ছেলেটা ঢাকাতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। বা, ওকে ফান্দে না ফেললে ও কিছুতেই এ কাজ করবে না- এরকম হাজারো মন্তব্যে বিষয়টির পোস্টমোর্টেম করা হল বেশ কিছুদিন।
অনেক দিন হলেও ফ্লেভার এখনো হারিয়ে যায়নি। মড়া মাটি দিয়ে মানুষ একসময় ঠিকই ভুলে যায়, জাঙ্গিয়া ব্যবহার করে ফেলে দেয়, কিন্তু ঢাকাতে পড়তে গিয়ে বিয়ে করে ফিরে আসা উপাখ্যান ভুলার নয়, ভুলেও না।
তবে, এ ব্যাপারটি সে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। ভালো লাগে না আর। এলাকায় সামান্য আধিপত্য সৃষ্টি করার জন্যে যে তার বন্ধুরা এরকম মিথ্যা রটনা করতে পারে, ভাবলেই তার বমি আসে। কষ্টে সাজিদ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল- আমার কিছু বন্ধু আছে, যারা থাকতে আমার শত্রুর প্রয়োজন নেই।
শ্যাওলাপড়া ছোট্ট মাঠটি অতিক্রম করে সোজা উঠল হেডমাস্টারের রুমের দরজার সামনের সিঁড়িতে। কিন্তু এ কোনা থেকে মলি ম্যাডাম ডাকলে সেটা উপেক্ষা করতে পারে না। কানে ভেসে আসে
- ঢাকাত যায়ি বিয়ে কইরলা। কিছু জানালাও না তো। দাওয়াত না হয় দিলাই না, জানালে দেকতে তো যাতুক।
সাজিদ কী বলবে ভেবে পায় না। বর্ষার কাছে শুনেছে, প্রতিটা ক্লাসে মলি ম্যাডাম আগ্রহের সাথে এই গল্পটা করেছে। পড়ার ফাঁকে বিনোদন হিসেবে, আবার সতর্কবাণী হিসেবেও। সুযোগ পেলেই বেচারী গল্পটা করতে ভুলে না। ম্যাডামের জন্যে তার মায়া লাগে। কিন্তু চাপা একটা কষ্ট তাকে দুর্গন্ধের মত ঘিরে ফেলে। দুর্গন্ধটা কালো, অন্ধকারের মতো। তার কাছে এখন ভাষা নেই, শব্দ নেই, আছে শুধু কষ্টের দুর্গন্ধ। কিছু না বলেই পা বাড়ায় হেডমাস্টারের রুমে।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়াআলাইকুমুস সালাম।
“আসতে পারি, স্যার?” বাক্যটি না বলেই ঢুকে পড়ল। স্যার উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। থাপ্পড় কিংবা চটকানা দেয়ার জন্যে নয়, করমর্দনের জন্যে। মনে হচ্ছে তার আসা হেডমাস্টারের দীর্ঘদিনের কামনা। আশার বাস্তব রূপ দেখে আপ্লুত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
মাস্টারের আতিথেয়তায় তার কিছুটা বিরক্ত লাগে। তার মনে আছে, বর্ষাকে সিক্সে ভর্তি করানোর সময় সে-ই এসেছিল। তখন বর্ষার সাথে সালমার প্রাইমারি স্কুলের বিভিন্ন এপিসোড নিয়ে কথা বলেছিল। মূলত ইতিবচকগুলো নিয়ে। যদিও প্রতি পরীক্ষার আগে সালমা কর্তৃক বর্ষার বই চুরি, বোতলের পানিতে কাদা ভরে রাখা, চিরকুটে আই লাভ ইউ এর নিচে বর্ষার নাম লিখে শিবলির দিকে ছুড়ে মারার ব্যাপারগুলো বলেনি। হাজার হলেও সালমার বাপ হেডমাস্টার নিজেই। তিনিও তো লজ্জা পাবেন। তবে লজ্জাটা মূল বিষয় না, বলে খুব বেশি কাজ হবে না। এর আগেও বলেছিল ওর বাবা হামু মিস্ত্রী। প্রাইমারি স্কুলের ম্যাডাম নিজে প্রমাণ পেয়ে বিচার করেছিলেন। কিন্তু হেডমাস্টার তা স্বীকার করেননি। উল্টা স্কুলের মাস্টার আর হামুকেই অপমান করেছিলেন।
সাজিদ নিজেও ছেড়ে দেয়ার পাত্র না। অন্য শিক্ষকেরা দায়িত্ব নিয়েই ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু সেভেনে উােই ক্লাসটিচার চেঞ্জ। সালমার মা-ই ক্লাসটিচার। মা-মেয়ের যৌথ অভিযানে শক্তি যোগান দেন মাস্টার। বর্ষা এটু হাবাগোবা হওয়ায় তাদের সুবিধাই হয়েছে।
বর্ষাকে মা সহজ সরল বললেও ওর বান্ধবীরা হ্যাবলা বলে। হামু মিস্ত্রি আদর করে পাগলি বলে ডাকে। মাস্টারেরাও বলেন- বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কমই। তবে সালমার মত ছাত্রীর সাথে পাল্লা দিয়ে যৌথ ফার্স্ট হওয়ায় মাস্টারেরা তাদের ভাবনা পরিবর্তন করেছেন।
এ মুহূর্তে সাজিদ কল্পনা করে- এই মানুষটিই বর্ষা আর ওর চৌদ্দ গোষ্ঠীকে ক্লাসে ফেরাউন কাফের নমরুদ বলে গালি দিয়েছেন। মানুষ গড়ার প্রকৌশলী হয়ে কিভাবে এটা করতে পারেন- তার মাথায় আসে না। স্কুলকে হেডমাস্টার আর তার বউয়ের সম্পত্তি মনে হয়।
একটা মশার ভনভন আওয়াজে বাস্তবে ফিরে আসে। ইদানীং খুব বেশি চিন্তা করছে। মাথাটায় আগের থেকেও একটু বেশি ব্যথা। বাসায় থাকলে একটা প্যারাসিটামল খেতে পারত।
মানুষটির দিকে তাকায়। বুঝতে পারে- ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধও এখন নেই। বরং ঘৃণা হচ্ছে। কিন্তু সাজিদও চালাক কোন অংশে কম নয়। মুখে একটা হাসি লাগাতে চেষ্টা করে।
কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার পাশের ফুটপাতে জুতা কিনতে গিয়েছিল একদিন। অ্যাপেক্স স্টিকার দেখামাত্র দূরে সরিয়ে রাখে, কিন্তু পছন্দ হয়। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে- মামা, এই স্টাইলের অ্যাপেক্সের ছাড়া অন্য কোম্পানির হবে?
- হুম, হবে। খাড়ান।
তারপর ব্যাগ থেকে বে এম্পোরিয়ামের স্টিকার বের করে লাগিয়ে দিল ঐ জুতায়।
- মামা, সবডাতেই আমরা ইসটিকার লাগাইছি।
এভাবেই জোর করে হাসির স্টিকার মুখে লাগাল সাজিদ। নিজেকে কারওয়ান বাজারের ফুটপাতের দোকানদার মনে হয় তার।
জাফরের পড়াশোনা কেমন চলছে, ম্যাডাম কেমন আছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন, বাসায় ঘুমাতে পারেন কি না- এ রকম প্রশ্ন করছে সাজিদ। মাস্টার উত্তর দিচ্ছেন।
উত্তর দেয়ার ফাঁকেই পড়ছেন বর্ষার দরখাস্তটি। বিষয় হল- ছাড়পত্রের জন্য আবেদন। পড়ার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে- দরখাস্তটি আগেই পড়ে রেখেছেন।
খুব মনোযোগ দিয়ে যে পড়লেন- তা কিন্তু না। যদিও মনোযোগ দিয়ে পড়ার গুণ অর্জনের জন্যে ছাত্র-ছাত্রীদের বারবার নির্দেশনা দেন। নিজেও এটা খুব বেশি আয়ত্ব করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
তিনিও সাজিদের মত প্রশ্ন-বস্তার মুখ খুললেন। লেখাপড়া কেমন চলছে, ডিপার্টমেন্টে কি এখনো পঞ্চম আছ, পলিটিক্স কর নাকি, টিউশনি করে চলতে পার, কোন মেয়ের খপ্পরে পড়েছ নাকি ইত্যাদি কিসিমের প্রশ্ন।
হেডমাস্টারের অনুরোধে চা খেতে হয় তাকে। সামনের ইলেকশনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার জন্যে অনেকে অনুরোধ করেছেন। দল থেকে সম্মতিও আছে। সে উপলক্ষে চা। এই প্রথম হেডমাস্টারের সামনে বসে চা খেল। স্কুলের অফিসে নির্বাচনী চা চক্র- খারাপ না। একটু ইতঃস্তত লাগলেও চা মন্দ লাগছে না।
মাস্টার স্বাক্ষর করলেন। হাসিমুখেই। সাজিদের মাথাব্যথাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
বর্ষার হাত ধরে বেরিয়ে আসে। সবকিছু অন্ধকার লাগে। দিনের রাস্তাও। তবুও হাঁটছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন