শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

প্রসারিত হচ্ছে শিপিং বাণিজ্য

| প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নৌপথে পণ্য পরিবহন অনেক সুলভ : বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ : আরও সুযোগ আটকে আছে
শফিউল আলম : নৌপথে পণ্য পরিবহনের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এই খাতে চাহিদা ও চাপ সামাল দিতে গিয়ে প্রসারিত হচ্ছে শিপিং বাণিজ্য। সমগ্র পৃথিবীতে সাগর-মহাসাগর, উপসাগর ও উপকূলীয় নৌ-রুটে অর্থাৎ শিপিংয়ে নৌপথে পণ্যসামগ্রী পরিবহন ব্যাপকভাবেই সুলভ। সেই তুলনায় সড়ক ও রেলপথে পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল, ঝুঁকি ও ঝামেলাপূর্ণ। বিশেষত জ্বালানি খরচ সাশ্রয় করার জন্য সাম্প্রতিককালে সমগ্র বিশ্বেই নৌপথ ব্যবহার তথা শিপিংয়ে আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম পরিচালনার নির্ভরতা অনেকাংশেই বেড়ে গেছে।    
শিপিং বাণিজ্যের মূল দিকটি হচ্ছে কম জ্বালানি ব্যয় করে অধিকতর পরিমাণে কন্টেইনারসহ খোলা সাধারণ (ব্রেক বাল্ক) পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে কন্টেইনার বোঝাই পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে কন্টেইনার পরিবহন খাতে গত বছর ২০১৬ সালে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ। নৌপথে পণ্য পরিবহন সুলভ হওয়া ছাড়াও তুলনামূলক নিরাপদ। এতে সময় সাশ্রয়ও হচ্ছে অনেক বেশি। তাছাড়া নৌপথের সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে বেশ ব্যাপক। সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের আওতা, পরিসর বা পরিধি বেড়ে গেছে। কেননা এরফলে বাংলাদেশের সমুদ্রপথ আরও উন্মুক্ত হয়ে গেছে। আরও অধিক সংখ্যক জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ব্যবহার করতে পারছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিপিং বাণিজ্য আরও প্রসারিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে বিভিন্নমুখী সহায়ক উদ্যোগ ও পদক্ষেপের অভাবে আরো অবারিত সুযোগ-সম্ভাবনা আটকে আছে।
শিপিংখাতের অভিজ্ঞজনেরা জানান, মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) উপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে করে জ্বালানি তেল, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, নিত্য ও ভোগ্যপণ্য সামগ্রী যদি আরও বেশি পরিমাণে বাণিজ্যিক জাহাজবহরে যোগান দিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্র আহরণের পথও হবে সুগম। বাংলাদেশের ব্যাপক আয়তনের সমুদ্রসীমা বা মেরিটাইম বাউন্ডারি স্বীকৃত হওয়ার ফলে আন্তঃদেশীয়, আন্তঃমহাদেশীয় এবং দেশের অভ্যন্তরে নৌপথেও জাহাজ, ট্যাংকার, ফিডার জাহাজ, কার্গোজাহাজ, কোস্টার, বার্জ, ফেরিসহ বিভিন্ন ধরণের ছোট-বড়, মাঝারি আকারের নৌযানের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে জাহাজ নির্মাণ শিল্পখাতে কর্মচাঞ্চল্য আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে।      
এদিকে দেশের সামগ্রিক পণ্য ও গণপরিবহণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বর্তমানে সড়কপথ নির্ভর অর্থাৎ একমুখী অবস্থায় সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আমদানি-রফতানিমুখী বিশেষ করে কৃষি-খামারজাত উৎপাদিত দেশজ পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত সুবিধা প্রসার, জনসাধারণের নিত্যপণ্য পরিবহনে খরচ কমানোর জন্য একমাত্র বিকল্প পথ হলো অভ্যন্তরীণ নৌ-রুটগুলো সচল করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি সঞ্চার করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্য যে কোন উপায়ে পরিবহন যোগাযোগের তুলনায় সমুদ্র উপকূলীয় নৌ-পথে পরিবহন খরচ অনেক আর্থিক সাশ্রয়ী এবং সহজতর। সড়কপথ, রেলপথ ও নৌ-পথে পণ্যসামগ্রী পরিবহনে আনুপাতিক খরচ সম্পর্কে পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণলয়ের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, সড়ক মহাসড়ক পথে নিত্য ও ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ যে কোন ধরণের পণ্যসামগ্রী পরিবহন বাবদ ‘প্রতি মেট্রিক টনে প্রতি কিলোমিটার’ হারে খরচ পড়ছে গড়ে সোয়া ৪ টাকা থেকে ৫ টাকা ৫০ পয়সা। রেলপথে সেক্ষেত্রে খরচ হয় আড়াই টাকা থেকে ৩ টাকা ২৫ পয়সা। অন্যদিকে নৌপথে পণ্যসামগ্রী কিংবা যাত্রী পরিবহনে ব্যয় হয় গড়ে মাত্র এক থেকে দেড় টাকা পর্যন্ত।      
নৌ-প্রকৌশলীরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে। সমুদ্র উপকূলীয় নৌপথগুলো সচল করা হলে পণ্য ট্রানজিট ব্যবস্থায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলক্ড) এ অঞ্চলে প্রথমদিকে সম্ভাব্য পরিমান হতে পারে পর্যায়ক্রমে বার্ষিক ৫শ’ থেকে ৮শ’ জাহাজ ও ১ থেকে ৪ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং ৪০-৫০ লাখ মেট্রিক  টন থেকে ১ কোটি মেট্রিক টন মালামালের ডেলিভারি পরিবহন। শিপিং ও পরিবহন সেক্টরে ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানের দিগন্ত খুলে যাবে।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে শিপিং পরিবহনের মাধ্যমে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ ও পেটেন্ট সামগ্রী, ভেষজ দ্রব্য, শাড়ী, বস্ত্র্র ও তৈরিপোশাক, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রট্রিক পণ্যসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, প্লাস্টিকজাত দ্রব্যাদি, আসবাবপত্র, কৃত্রিম অলংকার-গহনা, তথ্য-প্রযুক্তি, আসবাবপত্র, হালকা ও মাঝারি আকৃতির কার্গো কোস্টার নৌযান, হালকা যন্ত্রপাতি, কেবলস, লোহা ও স্টিল সামগ্রী, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও বেকার্স খাদ্যদ্রব্য, খেলনা প্রভৃতি পণ্যসামগ্রী ও সেবা পণ্য রফতানির পথ হবে আরও সুগম।
এদিকে শিপিং বাণিজ্যের বিশাল দরজা উন্মোচনের জন্য প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সাথে একটি পুনঃচুক্তি জরুরী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ দীর্ঘকালের ঐতিহ্যে লালিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে আকিয়াব (বর্তমান নাম সিটুই) ও রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) বন্দরের সেতুবন্ধন দেড়শ’ বছরেরও বেশিকালের পুরনো। শিপিং সার্কেলে জানা গেছে, নিকটতম এই দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে কোস্টাল এন্ড মেরিটাইম শিপিং স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটিতে কোন নবায়ন ক্লজ নেই। এ কারণে সর্বশেষ গত ২০০৮ সালের ২০ মার্চে চুক্তিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। চুক্তিটিতে নবায়ন ক্লজ না থাকায় পুনঃচুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন রয়েছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট নৌ প্রটোকলটিও নবায়ন করতে হবে। তবে আপাতত দ্বিপাক্ষিক শিপিং এবং স্থল সীমান্ত বাণিজ্যে এ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কোন বাধা নেই। অভিজ্ঞ শিপিং সূত্র মতে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিপিং পরিবহনের সুযোগকে সম্প্রসারণের জন্য ‘কোস্টাল এন্ড মেরিটাইম শিপিং’ চুক্তির সাথে ‘নন-কনভেনশনাল ভেসেল শিপিং’ অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন