মো. মাছউদুর রহমান
॥ এক ॥
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তার আকৃতি-প্রকৃতি, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের দিক থেকে বিপরীতমুখী হরেক রকম করে সৃষ্টি করেছেন। একারণে স্বভাবগতভাবেই একজন তার জীবনে আক্বীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও মতের দিক থেকে তার ভিন্ন মতের আরেকজনের সম্মুখীন হতে পারে। এ অবস্থায়, ভিন্ন মতালম্বীদের সাথে আচরণ করতে গেলে তার সামনে দুটি রাস্তা খোলা থাকে। প্রথমটি হলো, জোর-জবরদস্তি, কঠোরতা ও রূঢ়তার মাধ্যম অন্যকে পরাভূত করা। দ্বিতীয়টি হলো, সংলাপ ও উৎকৃষ্ট পন্থায় যুক্তি-তর্ক পেশ করা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সুস্থ বিবেকের অধিকারী একজন মানুষকে তার স্বভাব-চরিত্র, বিবেক-বুদ্ধি প্রথম পদ্ধতিকে ঘৃণা ও পরিত্যাগ করে দ্বিতীয় পদ্ধতি তথা সংলাপকে অনুসরণ ও তার আশ্রয় গ্রহণের দিকে নিয়ে যাবে। এজন্য সংলাপই হচ্ছে অন্যকে সঠিক বুঝটি বুঝিয়ে দিতে, তার আচরণ পরিবর্তন করতে এবং ইসলামের সঠিক রূপ রেখা তার কাছে পৌঁছে দিতে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। আজ সংলাপ শব্দটি বিভিন্ন কারণে আমাদের কাছে সুপরিচিত। ইতোমধ্যে সংলাপের আওয়াজ বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি, গোষ্ঠী থেকে তুলে ধরা হয়েছে। চলমান নিবন্ধে ইসলামে সংলাপ ও এর গুরুত্ব নিয়ে আলোকপাত করবো। ইনশাআল্লাহ
সংলাপ হচ্ছে অনুধাবনের রাস্তা, সফলতার পথ, আর পারস্পরিক সম্মতি ও ঐকমত্যের মূল ফটক। সত্যকে জানা এবং সে পর্যন্ত পৌঁছার ক্ষেত্রে সংলাপকে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয়। যারা ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক আচরণ করে এবং এর বিভিন্ন বিষয়ে অমূলক সন্দেহ ছড়ায়, তাদের মোকাবেলায় সংলাপই সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। চিন্তাসমূহের মাঝে সমন্বয়, ভুল এবং সঠিকের মধ্যে ফায়সালার ক্ষেত্রে সংলাপের ভূমিকা অপরিসীম।
সংলাপ হচ্ছে মানবীয় এমন এক প্রয়োজন, যার গুরুত্ব গঠনমূলক সংলাপের পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে, অন্যের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং দলের সাথে একীভূত হয়ে মানুষের প্রয়োজন পূরণ করা। সংলাপ অন্যের সাথে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত ও যৌথ প্রয়োজন পূরণে ভারসাম্য নিশ্চিত করে। এমনিভাবে জাতি ও সম্প্রদায়ের আধুনিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার চিত্র তুলে ধরে। মানবীয় মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যশীল আধুনিক ও প্রাচীনসভ্যতায় জাতীয় মর্যদাকে সমুন্নত করে।
সেমিনার, সমাবেশ, সম্মেলন, পারিবারিক সাক্ষাৎ এগুলোকে কার্যকর অর্থবহ সংলাপ অনুশীলনের মাধ্যমসমূহের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। যার দ্বারা আধুনিক যুগের মানুষেরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়, তার সমাধান সহজেই বের করা যায়।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমাদের নিকট এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়টির প্রশস্ততাও অনেক। যার শাখা-প্রশাখা বিভিন্ন দিককে আওতাভুক্ত করে। ইসলাম, দেশ-জাতি ও মানবতার উপর এর ইতিবাচক প্রভাব এবং এর প্রতিবন্ধকতাসহ আরো অনেক কিছু এ বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত।
আল কোরআনে সংলাপ
আল কোরআনুল কারীম সংলাপকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে তিন জায়গায় শব্দটি এসেছে। সূরা কাহাফের দুই জায়গায় তথা আয়াত ৩৪ এবং ৩৭, আর সূরা মুজাদালার প্রথম আয়াত। কোরআনে কারীমে সংলাপের বহুমুখী ব্যবহার স্থান পেয়েছে। নি¤েœ তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো :
ফিরিশতাদের সাথে আল্লাহ তা‘আলার সংলাপ। (সূরা বাক্বারা : ৩০-৩৩) ২. নবী-রাসূলগণের সাথে আল্লাহ তা’আলার সংলাপ। (সূরা বাক্বারা : ২৬০) ৩. নিজ কওমের সাথে নবী-রাসূলগণের সংলাপ। (সূরা ইবরাহীম : ৯-১২) ৪. জান্নাত ও জাহান্নামীদের পারস্পরিক সংলাপ। (সূরা আরাফ : ৪৪) ৫. পাখির সাথে মানুষের সংলাপ। (সূরা নামল : ২০-২৫) ৬. নবী-রাসূলগণের সাথে আল্লাহ তা’আলার সংলাপ, যাতে তিনি শেষ নবীর জন্য বাইআ‘ত-এর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। (সূরা আল ইমরান : ৮১) এ জাতীয় বিভিন্ন রকমের সংলাপ পবিত্র কোরআনে স্থান পেয়েছে।
হাদীসে সংলাপ
প্রিয় নবীর জীবন চরিত এবং মুখ নিঃসৃত হাদীসসমূহের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে বাস্তবায়নকারী গঠনমূলক সংলাপ সমৃদ্ধ। এতে বিস্মৃত হবার কিছু নেই। তিনি তো কল্যাণের শিক্ষা আর উন্নত চরিত্র পরিপূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কাজেই সংলাপের ব্যবহার তো তার অমীয় বাণীতে থাকবেই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে : ১. হাদীসে জিব্রিল, যা হজরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। (মুসলিম : ৯) ২. হোসাইন বিন ইয়াবুদের সাথে প্রিয় নবীর সংলাপ, যা তিনি তাকে ইসলামের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য করেছেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল রাসূল (সা.) সংলাপের চূড়ান্ত রূপ। ইমরান বিন হোসাইন থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতাকে বলেছেন : হে হোসাইন! এক দিনে কতজন মাবুদের ইবাদত কর? আমার পিতা বললেন, সাতজনের। ছয় জন জমিনের, আর একজন আসমানের। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন : এদের কাকে মনে কর তোমার আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারবে? তিনি বললেন : যিনি আসমানে আছেন তিনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : হে হোসাইন! তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তাহলে তোমাকে এমন দুটো কথা শেখাব, যা তোমার অনেক উপকার করবে। ইমরান বলেন, হোসাইন ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলের নিকট থেকে কথা শিখতে চাইলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বলো- ‘আল্লাহুম্মা আলহামানী রুশদী ওয়া আ’য়াজ্জানী মিন শার্রি নাফসী’।
সংলাপের প্রয়োজনীয়তা
জাতি এবং সম্প্রদায়ের মাঝে সংলাপের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। মহান আল্লাহ তা’আলার বাণীর আলোকেই মূলত তা দেয়া হয়েছেÑ
‘হে নবী! আপনি আপনার মালিকের পথে মানুষকে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করুন’। (সূরা নহল : ১২৫) গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বানের জন্যে, প্রজ্ঞা এবং সংলাপের আহ্বানের গুরুত্ব বোঝাতে এ আয়াতে কারীমা উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতি এক প্রজ্ঞাময় নির্দেশ। আল্লাহর কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে, উত্তম কথার মাধ্যমে সংলাপ চালিয়ে যাবার বিষয়টি প্রতিটি মুসলিমের জীবনে অনেক মূল্য রাখে। মানুষের সাথে উত্তম আচরণ, একনিষ্ঠ আহ্বান, উত্তম শব্দের ব্যবহার, সংলাপকালে ধৈর্য এবং কোমলতা প্রদর্শন, উত্তম আদর্শের নমুনা দেখিয়ে দ্বীনের সৌন্দর্যকে সমুন্নত করার ভূমিকা অতুলনীয়।
সংলাপের উপকারিতা
অন্যদেরকে সন্তুষ্ট করতে এবং তাদের আচরণকে ভালোর দিকে নিয়ে যেতে সংলাপকে সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয়। অন্যের মতকে সম্মান দিতে, নিজের ভুল স্বীকার করে নিতে এবং নিজেকে অন্যের সমালোচনা সহ্য করতে অভ্যস্ত করার ক্ষেত্রে সংলাপ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। নিয়মতান্ত্রিক সংলাপ আমাদের নিকট সঠিক বিষয়টি পৌঁছে দিতে সাহায্য করে, এমনকি সংলাপকারী নিজেকে সংশোধনের সুযোগ পায়, সে তার চিন্তা এবং সঠিক উপস্থাপনের ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করে। তাকে তার আত্মা এবং তার জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ শেখায়। ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা এবং সঠিক ফায়সালা করার যোগ্যতা বৃদ্ধি করে; যা তাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় অন্যদের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলে। মানসিক প্রবৃদ্ধি, রাগসংবরণ, নিজেকে দ্বন্দ্ব, রুদ্রাচরণ ভয়ভীতি ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখতে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন