কুতুবউদ্দিন আহমেদ : আবু হেনা মোস্তফা কামাল বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শক্তিমান কবি। তার প্রায় চল্লিশ বছরের কবি জীবনে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে মাত্র তিনটি : আপন যৌবন বৈরী [১৯৭৪], যেহেতু জন্মান্ধ [১৯৮৪] এবং আক্রান্ত গজল [১৯৮৮]। আর এই তিনটি গ্রন্থেই তিনি শক্তিমান কবি হিসেবে বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্থান নিশ্চিত করে রেখেছেন।
‘আপন যৌবন বৈরী’র পঞ্চম কবিতাটির শিরোনাম ‘কবি’। কবিতাটিতে একজন প্রকৃত কবির স্বরূপ উদঘাটন করা হয়েছে। মোস্তফা কামাল দেখিয়েছেন একজন কবির কবিতা সৃষ্টির কী মর্মান্তিক কাতরতা। জীবনের কতটুকু রক্ত ব্যয় করে একজন কবি শব্দমালা তুলে আনেন কলমের নিবে; কতটুকু দুঃখ হজম করে কিনে আনেন একেকটি কবিতার প্লট। একেকটি কবিতার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে থাকে কবির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালোবাসা-ঘৃণা। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল এই কবিতায় ঈশ্বরকেও কবির খাতায় নাম লিখিয়েছেন; তবে ঈশ্বর সৌখিন কবি, সুখের কবি, সুন্দরের কবি। কিন্তু একজন মানুষ যখন কবি হয়ে ওঠেন; তখন তাকে জীবনের দুঃখ ছেনে, অন্ধকার অলি-গলি চিনে এসে কবি হতে হয়; তার চলার পথ থাকে কণ্টকে ভরা। পাঠকের জ্ঞাতার্থে এই অসাধারণ কবিতাটি উল্লেখ করছি :
ঈশ্বর আপনিও কবি, কবিদের অনেকেই এরকম বলে।
কেননা আপনার হাত পাহাড়ে সূর্যাস্ত আঁকে
আকাশের বিস্তৃত পাতায়
পাখিদের চোখের পাতায় নক্ষত্রের স্বপ্ন লিখে রাখে
এবং আপনার স্বরলিপি মেঘের অর্গানে বাজে প্রথম বাদলে।
এ সবি আমার শোনা কথা। কেননা কখনো এ শহর
ছেড়ে, এই অন্ধকার গলি আর রোয়াকের দুর্বোধ্য কুহক
অস্বীকার করে কোথাও যাইনি, আচ্ছা, বলুন ঈশ্বর,
কবিতার জন্যে আপনি কোনোদিন যন্ত্রণার জ্বলন্ত নরক
ঘেঁটেছেন? হেঁটেছেন চেনা পথে বারবার, কোনো তরুণীর
মুখ শব্দে ফোটাবেন বলে জেগেছেন অর্থহীন রাত?
তাহলে বলুন কবি, বলুন ঈশ্বর
আপনিও রক্তাক্ত তবে? আপনারো হৃদয়
একটি উপমার জন্যে অনুপম ক্রৃশবিদ্ধ হয়?
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতার স্বাদ নিতে গেলে পাওয়া যায় দার্শনিকতার ঘ্রাণ। কবিতা বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে তিনি যেন কখনও-সখনও দার্শনিক হয়ে উঠেছেন। দার্শনিকের চোখে দেখেছেন তিনি মানুষের সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :
মানুষ মানে কি তবে ঘরবাড়ি? ঝকঝকে দেয়াল, মেঝে,
গালিচা, কিংবা ওয়ার্ডরোব?
মানুষ মানে কি তবে গর্বিত দেয়াল আর তোরণে সুদৃশ্য গাড়ি,
সাবধানী কুকুর?
[ হাসানের ঘরবাড়ি : যেহেতু জন্মান্ধ]
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায় প্রায়ই ফুটে উঠেছে অচরিতার্থ প্রেমের হাহাকার। কবিতার শব্দে শব্দে খুঁজেছেন হারানো নারীকে। হারানো নারীর খোঁজে তিনি অসংখ্য শব্দের মালা গেঁথেছেন। কখনও তিনি ভুগেছেন নষ্টালজিায়; হারানো বন্ধুর খোঁজে কখনও কাতর হয়েছেন। এমনই হারানো বন্ধুদের খোঁজে মন খারাপ করা কয়টি পঙ্ক্তি :
মধুর রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে
আমরা সবাই চলে গেলাম যে যার পথে
কেউ সচিবালয়ে তোপখানায়,
কেউ ইসলামাবাদে
কেউ প্যারিসে রোমে
অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রামে-গঞ্জে
রোঁয়া-ওঠা ইস্কুলে-কলেজে---
দড়ির আগুন থেকে সিগারেট ধরিয়ে
আমরা যারা শীতের রাতে ঘনিষ্ট অভিজ্ঞতার গল্প
বিনিময় করেছি
তাদের কারো সঙ্গে কারো আর যোগাযোগ নেই
কেউ গুলশানে বিশাল বাড়ি রেখে
বনানীর সংক্ষিপ্ত আঁধারেই ঘুমিয়ে পড়েছে
দূরারোগ্য রাজনৈতিক ব্যাধি নিয়ে কয়েকজন গা ঢেকে বেড়ায়
কারো চিবুকে সচ্ছলতার দ্বিত্ব
আবার কেউ তার অতীতের প্রেতচ্ছায়া অভাবে অভাবে
আমার বিশ্বস্ত কোনো আয়না নেই
কার কাছে জানতে চাইব
আমি কি খুবই বদলে গেছি?
মধুর রেস্তোরাঁয় হঠাৎ কোনো পৌষের সকাল ১০টায়
এক পেয়ালা চা কি আগের মতোই মদির!
[মোহানা থেকে ফেরা : আক্রান্ত গজল]
আবু হেনা মোস্তফা কামালের সমস্ত জীবন ঘেঁটে এতোটুকু উপলব্ধি করা যায় যে, কবি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অসাধারণ রোমান্টিক। এই রোমান্টিকতাই তাকে কবিতার পথে টেনে এনেছে। প্রবন্ধের হাত তার মন্দ ছিল না। এই প্রবন্ধ লিখেও তিনি সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা পেতে পারতেন। কিন্তু তার সমস্ত সত্তা ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন নির্মোহ কবি। এবং তার কবিতায় সমাজ, সংসার, রাজনীতি, অর্থনীতি সমস্তকিছু বাদ দিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে ঐ রোমান্টিকতা। তার কবিতার অন্তরজুড়ে রয়েছে রোমান্টিকতার ছোঁয়া :
তুমি সেই রহস্য-উতল বনভ‚মি যার
অচেনা সুন্দর তরুপল্লবের ভাষা আমি কখনও বুঝি না
ফুটন্ত গোলাপ যেন তুমি সেই প্রজাপতি
সমস্ত কৈশোর যাকে কোনোদিন ধরতে পারিনি।
একটি নিঃসঙ্গ গাছ যেমন নীরবে ঝুঁকে থাকে
সারাদিন স্বচ্ছ নীল দীঘির ওপরেÑ
তেমনি আমি : বারবার হেরে যাই তবু ফিরে আসি
আর তোমাকেই দেখিÑ পাতা ঝরে ঝরে
সব নিঃস্ব হয়ে গেলে তবু নিজেকেই দেখি
আমি তোমার দর্পণে?
[তোমার ওপরে ঝুঁকে থাকি]
আরেকটি কবিতায় তিনি লিখেছেন :
কতোটুকু ঝুঁকি নিতে পারি, জানতে চাওনি তুমি নারী
আমিও বলিনি;
চন্দনগাছের গায়ে কোনো নামফলক নেই
তবু তার হৃদয় থেকে সুবাস ওঠে
নিঃশব্দে নীরবে;
নির্দয় অরণ্য দস্যুরা যখন তীক্ষè কুঠারে
ব্যবচ্ছেদ করে সেই সবুজ ভালোবাসা
ঠাÐা স্পর্শে
[অগ্রন্থিত কবিতা]
আরেকটি কবিতায় লিখেছেন :
আমার সময় খুবই মেঘলা যাচ্ছে আজকাল
অসহ্য গুমোট
ঘরে; তুমি দুই চোখে নিয়ে এসো রোদ
আর কিছু হাওয়া শুভ্র হাসির উচ্ছ¡াসে
বিনিময়ে দেবো, সবি দেবো
[অগ্রন্থিত কবিতা]
আরেকটি কবিতায় লিখেছেন :
অনেক পাখির নাম নদী ও ফুলের নাম
লতা ও বৃক্ষের নাম
এখনো জানি নাÑ কী করে এখান থেকে যাবো?
পাখিদের দেশান্তরে চলে যেতে হয়
নদীকেও সমুদ্রের দিকেÑ তুমি বললে Ñ কুসুম পূর্ণতা পায়
ফলে, আর প্রখর সূর্যের তাপে লতা
ক্রমশই কুঁকড়ে যায়, বৃক্ষই কি চিরজীবী?
[অগ্রন্থিত কবিতা]
আবার লিখেছেন :
সমস্ত দরোজা তুমি বন্ধ করে দিলে :
এখন তো ফিরতেই হবে।
অসময়ে এই ফেরা, একটিও হোটেল নৈশাবাস
জেগে নেই, জনশূন্য পথ শুয়ে
উদ্বাস্তুর মতো এলিয়ে শরীরÑ
সব যানবাহন পলাতক। বড়ো
অসময়ে এই ফেরা। অথচ ফিরতেই হবে
সমস্ত দরোজা তুমি বন্ধ করে দিলে।
[অগ্রন্থিত কবিতা]
আরেকটি কবিতায় :
স্বৈরিণী, তোকেই ভালোবাসি বলে
এ-পাড়ার স্বাস্থ্যরক্ষী মহোদয়গণ
সম্প্রতি আমার নামে নিন্দার পোস্টার
এঁটেছেন দেয়ালে দেয়ালে। আর তাদের শ্লোগান:
এটা ভদ্রপাড়া, এখানে নিষিদ্ধ সব কোকিলের গান।।
[ইস্তাহার সাম্প্রতিক : আপন যৌবন বৈরি]
আবার লিখেছেন :
বলো তুমি কার জন্যে ভোরের দর্পণে মুখ দেখে
এলোচুল বেঁধেছিলে ত্বরিত দু’হাতে, টিপ
পরেছিলে নিটোল কপালে, খাতা বই
ছুড়ে ফেলে বলেছিলে, যাবোই, যাবোই।
বলো তুমি কার জন্যে পাখির গানের সঙ্গে গলা
সেধে সুর বেঁধেছিলে মদির বিকেলে, চোখ
ভরেছিল মায়াবী কাজলে, অহংকার
ছুড়ে ফেলে বলেছিলে, কী হবে আমার!
অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আবু হেনা মোস্তফা কামাল রোমান্টিক কবি হোন আর যাই হোন, তার জন্ম হয়েছিল কেবল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবা দেয়ার জন্যে; একজীবনে তিনি সেবা দিয়ে গেছেন। জীবনটা খরচ করেছেন তিনি বাংলা সাহিত্যের পেছনে। জীবনে তিনি দিয়েছেন অনেক কিন্তু পেয়েছেন কতটুকু; সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
জীবৎকালে তিনি যেখানেই থেকেছেন, যেভাবেই থেকেছেন বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেছেন। তার চিন্তা-চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষ তাই তার কাছে বিশেষ ঋণী; যে ঋণ কখনও পরিশোধযোগ্য নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন