ড. গুলশান আরা
বাংলা সাহিত্যের এক প্রিয় নাম জসীম উদ্দীন। রবীন্দ্র প্রতিভা যখন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে মধ্যগগনের সূর্যের মত-নজরুল এলেন বিদ্রোহের বাণী কণ্ঠে নিয়ে মাৎ করে দিলেন সারাদেশ, সাহিত্যের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আরেক কবির সৃষ্টি কর্মে চমকিত হলেন সাহিত্যামোদী বিদগ্ধ পাঠক তিনিই আমাদের প্রিয় কবি জসীম উদ্দীন। যিনি এলেন নিভৃত পল্লীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার বিচিত্র কথা মালা নিয়ে।
ছাত্রাবস্থায় ‘কবর’ কবিতা লিখে সুধীজনকে মোহিত করেন। তার সৃষ্টিকর্মের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য হন পাঠক ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এর বেদনাবিধূর কাব্যপাঠে। ‘রাখালী’ লিখে চমৎকৃত করেন গুণমুগ্ধ পাঠককে। বলতে গেলে চোখের পলকে জনপ্রিয়তা পেলেন জসীম উদ্দীন- যা একমাত্র নজরুল ইসলামের বেলায় ঘটেছিল। এরপরই নজরুলের সমালোচনা শুরু হয়, একবৃত্তে ঘুরছেন কবি এই অভিযোগে। হয়তো জসীম উদ্দীনকেও ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনিও বোধ করি ভাবলেন পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমি থেকে বের হয়ে আসবেন। কিন্তু এটি লেখকের জন্য যে কতটা কষ্টের তা লেখক মাত্রই জানেন। জানলেন জসীম উদ্দীনও। নিজের কথা নিজের মত করে বলতে চাইছেন অথচ পারছেন না। কে যেন তাকে পুরনো পথেই টানছে। সেই দ্বিধান্বিত মনস্কতার বর্ণনা দিতে গিয়ে জসীম উদ্দীন লিখেছেন- “এই পুস্তক রচনার সময়ে রাতের পর রাত আমি ঘুমাইতে পারিতাম না, আহার করিতে পারিতাম না। আল্লাহ্্র কাছে প্রার্থনা করিতাম, খোদা তুমি আমার কবিত্ব শক্তি লইয়া যাও।” (‘বালুচর’ কাব্য রচনার সময়)
এ প্রসঙ্গে জেনৈক সাত্যি সমালোচকের একটি মূল্যবান মন্তব্য মনে পড়েÑ ‘অ ঢ়ড়বঃ পধহহড়ঃ ৎিরঃব ঃযব ঢ়ড়বঃৎু যব ধিহঃং ঃড় ৎিরঃব নঁঃ ড়হষু ঃযব ঢ়ড়বঃৎু ঃযধঃ রং রিঃযরহ যরস.’ কবি আপন ইচ্ছামত কবিতা লিখতে পারেন না, কেবল যে কবিতা তার স্বভাবে আছে, তাকেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন। যে কোন সত্যিকার কবির রচনাই এ সত্যের বাইরে নয়। জসীম উদ্দীনের কাব্য সাধনায়ও এ সত্য প্রমাণিত হলো ‘বালুচর’ রচনার সময়। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সমালোচনা করে বললেন, “তোমার ‘বালুচর’ পড়তে গিয়ে বড়ই ঠকেছি হে। ‘বালুচর’ বলতে তোমাদের দেশের সুদূর পদ্মাতীরের চরগুলির সুন্দর কবিত্বপূর্ণ বর্ণনা আশা করেছিলাম। কেমন চখা-চখি উড়ে বেড়ায়, কাশফুলের গুচ্ছগুলি বাতাসে উড়িয়া যায়। কিন্তু কতকগুলি প্রেমের কবিতা দিয়ে তুমি বইখানাকে ভরে তুলেছ।” (ঠাকুর বাড়ীর আঙীনায়- জসীম উদ্দীন)
প্রেমের কবিতার আধিক্য থাকলেও জসীম উদ্দীন কিন্তু এ কাব্যেও তার বিশিষ্ট রচনাশৈলী থেকে একেবারে সরে আসতে পারেননি। ‘বালুচর’, ‘ধানখেতে’, ‘লাউয়ের পাতার জাঙলা’, ‘ঢাকাই সীমের আঁচল কবিতাগুলোতে পল্লী প্রকৃতি যেন আপনি এসে ধরা দিয়েছে। ‘উড়ানীরচর’ কবিতাখানি তো ‘বালুচর’ কাব্যের নাম ভূমিকার সার্থক রূপায়ন।
‘উড়ানীর চর ধূলায় ধূসর যোজন জুড়ি
জলের উপরে ভাসিছে ধবল বালুর পুরী’।
বাংলাদেশের নদীবিধৌত চরের এমন কাব্যিকরূপ বাংলা সাহিত্যে খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। ধবলবালুর রাশিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় ঐ বালুরাশি বুঝি জলের উপর ভাসছে। পাখ-পাখালীর আগমনে চর হয়ে ওঠে মুখর- ‘ঝাকে আসে পাখি-ঝাঁকে উড়ে যায়’- এমন দৃশ্য দেখে কবির মনে হচ্ছে ওরা বুঝি ‘বালুয়ার গানে বেড়ায় মাতি।’ চড়ে খড়ের ঘর বেঁধেছে কৃষাণ বধূ। ঘরের চলে ঢাকাই সীমের বাহারী ফুল ফুটে বাতাসে উড়ছে। কিন্তু কবির চোখে ঐ সাধারণ দৃশ্যও অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। তাঁর মনে হয় ঘরের চালের মাথায় ‘ঢাকাই সীমের উড়িছে আঁচল মাখার পর। তখন এই চিত্ত কল্প পাঠকের চোখেও ধরা দেয় অপূর্ব ব্যঞ্জনায়। কবি জসীম উদ্দীন লাউয়ের পাতার জাঙলায় লাউ ঝুলতে দেখে ভাবেন লাউ নয়, ‘লক্ষ্মী যেন দুলিছে দোলায়। এখানেই সাধারণের দেখায় আর কবির দেখায় পার্থক্য। ফাল্গুনের হাওয়ায় কলা পাতায় নাচন লাগে কবি প্রত্যক্ষ করেন কলাপাতা কাঁপে না যেন নাচে। ‘ফাগ্লুনের হাওয়ার নাচন’ দেখে কবি উল্লসিত হন। অনুভব করেন অপার্থিব আনন্দ। কলা পাতার নাচনের সঙ্গে নেচে ওঠে কবি-মন। যে প্রেমের কবিতার কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন তা মূলত সাধারণ প্রেম নয় লোকজ প্রেমও নয়। প্রেম-ভাবনার ক্ষেত্রে কবি বেছে নিয়েছেন বাংলার ধর্মভিত্তিক প্রেম- সাধনার ঐতিহ্য। এদেশের আউল-বাউল-বৈরাগী সূফী সাধকের সাধনায়। প্রেমের যে উদার, মাহত্য বর্ণিত বা গীত হয়ে আসছে যুগ-যুগান্তর ধরে সেই প্রেমতত্ত্বই উঠে এসেছে জসীম উদ্দীনের প্রেমের কবিতায়। এদিক দিয়ে ‘প্রতিদান কবিতাটি উল্লেখযোগ্য-কবিতার প্রথমেই উচ্চারিত হয়েছে প্রতিহিংসাহীন উদার মনস্ক অমিয়বাণী-
‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।....
যে মোরে, দিয়েছে বিষে ভরা বান,
আমি দেই তারে বুকভরা গান।
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনমভর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।’
বিভিন্ন উপমায় এই ধারণা আরো বিস্তৃত হয়েছে। যে উদার মানসিকতার কাল থেকে কালান্তরে এদেশের মানুষসহ অবস্থানে থাকছেন সৌহার্দ্যরে সেই মর্মবাণী কবিতাজুড়ে। যে কবিকে হেনেছে ‘বিষে ভরা বান’ কবি বিনিময়ে দিয়েছেন ‘বুকভরা গান’ এ যেন সেই ঔদার্য বা যিশুখৃস্ট সম্বন্ধে প্রচলিত যদি কেউ তোমার এক গালে চড় মারে- তুমি আরেক গাল পেতে দাও, তবু তুমি প্রতিহিংস হবে না।
‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থের মত ‘বালুচর’ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেনি বটে, তবে একেবারে যে সুধিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি তা বলা যাবে না। ‘উড়ানীর চর’, ‘প্রতিদান’, ‘মুসাফির’ প্রভৃতি কবিতার প্রশংসা করেছেন অনেকেই। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার তার সংকলিত কাব্যগ্রন্থ ‘কাব্য মঞ্জুষা’য় সংযোজন করেছেন প্রতিদান, ‘মুসাফির’ কবিতা দুটি। ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ নামে আবু সায়ীদ আইয়ুব একখানা কবিতা সংকলন প্রকাশ করেন তাতেও তিনি ‘বালুচর’-এর ‘একখানি হাসি’ও প্রতিদান কবিতা দুটি স্থান দিয়ে কবিতা এবং কবিকে সম্মানিত করেছেন, মূল্যায়ন করেছেন কবিতার।
কাব্যগ্রন্থ সমালোচনা বলতে যা বুঝায় ‘বালুচর’ সম্বন্ধে তেমনটি হয়নি। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ ‘বালুচর’ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তাকে সাহিত্য সমালোচনা বলা কষ্ট- বরং একে বলা চলে আবেগাপ্লুত স¯েœহ প্রশংসা। তিনি যা লিখেছেন তা এরকমÑ ‘বিজলীতে আমরা জসীমের ‘নক্সী কাঁথার মাঠের অন্তরের সৌন্দর্য তার আঁকা পদ্মাপারের গ্রামের সুষমার ছবি খুলে দেখেছিলাম। ‘বালুচরের’ কবি সেই সুরে, সেই ছবি, সেই রূপরেখা আবার জাগিয়েছেন।
‘বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়াছে বালুর চরে
কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া গাঁয়ের ঘরে?
কোথায় খেলার সাথীরা আমার কোথায় ধেনু
সাঁঝের হিয়ায় রাঙিয়া উঠিছে গোখুর রেণু
সাঁঝের শিশির দুটি পাও ধরে কাঁদিয়া ঝরে,
বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়াছে বালুর চরে।’
জিতা রহো ভাই, বাঙলার কবি! কে বলে তুমি মুসলমান, কে বলে তুমি হিন্দু, তুমি ত অত ছোট নও যে ধর্মের ময়ুরপঙ্খী দাঁড়কাক সাজবে। বাঁশী তোমার চিরদিনই হারিয়ে যাক ঐ পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের বালুর চরে, বালুর চরজুড়ে উঠুক তোমার রূপের রেখা, ধ্যানের গীত প্রাণের দরদ আমবনের মায়া, ঢাকাই সীমের আঁচল, চিরদিনই সেই হারান বাঁশীর সুরে।...
“তোমায় অভিশাপ দেব, এই হারানো বাঁশী ইহ জন্মে আর যেন তুমি খুঁজে না পাও, তবেই না পল্লী লক্ষ্মীর ছবি খানি আমাদের চোখ ভরে মর্মজুড়ে তোমার সুরে ফুলে উঠবে।” ইত্যাদি।
‘বালুচর’ কাব্য সতেরটি কবিতা নিয়ে ১৩৩৭ সালে প্রকাশিত হয়। এ কাব্যে ধরা পড়ে জসীম উদ্দীনের কাব্যভঙ্গির একটি বিশেষ রূপ সেটি হলো কবিতার বহির্মুখী দৃষ্টিকে কিছুটা হলেও অন্তর্মুখী করেছেন, তবে প্রেমের ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা পথেই হেঁটেছেনÑ নতুন বক্তব্য পেশ করেননি। দুর্বিষহ যাতনা ভোগ করেও যে প্রেম নিঃস্বার্থ হবার মন্ত্র শেখায়- আজও বৈষ্ণব-বাউল কবিগণ এ দেশবাসীকে সিক্ত করে রেখেছেন জসীম উদ্দীন সে ঐতিহ্য থেকে সরে আসেননি। উচ্চশিক্ষা, আধুনিক জীবন যাতনা তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। তাই তার প্রেমের কবিতায় পাওয়া যায় না আধুনিক প্রেমের যন্ত্রণাক্লিষ্টতা। বরং মরমী সুফি সাধকের মত তিনি সহজ-সরল ভাষায় এবং বক্তব্যে পেশ করেন মরমীবাদ। এ যেন ঐতিহ্য সচেতন জসীম উদ্দীনের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমূল্য রতœ।
বিষয় নির্বাচন, রচনাশৈলী, ছন্দ ব্যবহার সব কিছুতেই একঘেয়েমীর প্রশ্ন তোলেন সমালোচকেরা। বালুচরের অনেক কবিতা ত্রিপদী ছন্দে লেখা সমালোচকরা তাকে ছন্দ পরিবর্তন করতে বলেনÑ এ প্রসঙ্গে জসীম উদ্দীন স্মৃতিচারণ করেছেনÑ
“সমালোচকরা বলিতে লাগিলেন, তোমার কবিতা একঘেয়ে হইয়া যাইতেছে। ছন্দ পরিবর্তন কর।”
(ঠাকুর বাড়ীর আঙীনায়Ñ জসীম উদ্দীন)
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পরামর্শ দিয়েছিলেন জসীম উদ্দীনকে ‘ওসব বাজে লোকের কথা শুনো না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয় তাই ব্যবহার কর। ইচ্ছে করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখীর বোলের মত। তাতে কোন প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।” (ঠাকুর বাড়ীর আঙীনায়)
জসীম উদ্দীন যে সমস্ত উপমা ব্যবহার করেছেন সেগুলোর উপাদান গ্রাম থেকে সংগৃহীত কিন্তু উপমার ব্যাখ্যা সূত্র নাগরিক, বুদ্দিদীপ্ত আধুনিক কবিতার লক্ষণাক্রান্ত। যা সাধারণত তার কাব্যে লক্ষ্য করা যায় নাÑ যেমন বাংলার শালীন কাব্যধারার সঙ্গে নজরুল ইসলামের একটা সম্পর্ক আছে কিন্তু জসীম উদ্দীনের সম্পর্ক মূলত চ-ীমঙ্গল, ময়মনসিংহ গীতিকা এবং গ্রামের অজস্র কাব্য গীতিকার সঙ্গে। গ্রামীণ জীবন ও পরিবেশ তার কাব্যের উপাদান জোগালেও অথবা কবিতার কলাকৌশলে গ্রাম্য আবহ মূর্ত হয়ে উঠলেও জসীম উদ্দীন পরিপূর্ণ গ্রাম্য কবি নন। উপমা ব্যবহারের চমৎকারিত্বে সার্থক কবিতা পঙ্ক্তি লেখায় তিনি পারঙ্গম। বালুচর এও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
বাংলা সাহিত্যের এই প্রথিত যশা কবি ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তাম্বুলখানা গ্রামে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯ মার্চ ১৯৭৬ সালে ঢাকায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন