বাংলা কবিতায় বাঁক পরিবর্তনে ও দেশাত্মবোধে যে কবি অনন্য ভ‚মিকা পালন করেছেন তার নাম হাসান হাফিজুর রহমান। সাহিত্যের সবদিকেই তার পদচারণা রয়েছে। তিনি একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। তাঁর কবিতা যেমন সাধারণ মানুষের নিরাভরণ জীবনচেতনা সমস্ত প্রতিরোধের ক্লান্তির অবরোধ অন্ধকার অপসারিত করে তেমনি তার ছোটগল্প জীবনের মাধুর্য, বেদনাবোধ, মমত্বহীন দ্বিখÐিত সমাজের মুখোশ উন্মোচন করে। তাঁর সকল প্রকার লেখনি মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমে উপস্থাপিত। বাক্য-বিন্যাস ও শব্দনৈপুণ্যতা অসম্ভব ক্ষমতাও তাঁর রচনার অনন্য বৈশিষ্ট্য।
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৩২ সালের ১৪ জুন জামালপুর শহরে (মাতুলালয়ে) জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার কুলকান্দি গ্রামে। বাবার নাম আবদুর রহমান এবং মার নাম হাফিজা খাতুন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। ১৯৫৮ সালের ১৭ এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মফিজ উদ্দিন ফকিরের কন্যা সাঈদা হাসানের সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের নাম হাসান সাঈদ দিশা, মেয়ের নাম এশা হাসান মুন্নী।
১৯৩৮ সালে ঢাকার নবকুমার স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে তার বাবা বরিশালে বদলি হয়ে গেলে তিন বছর জামালপুরের সিংজানী হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৪২ সালে তাঁর বাবা পুনরায় ঢাকায় বদলি হয়ে এলে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশোনা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৪৮ সালে হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বি.এ. অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে ১৯৫১ সালে তিনি পাস কোর্সে বিএ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৫ সালে তিনি বাংলায় এমএ পাস করেন। তিনি মেডিকেল কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু ডাক্তারি পড়া অসমাপ্ত রেখেই তিনি শিক্ষা বিভাগে চাকরি নেন। চাকরি জীবনের প্রায় পুরো সময় তিনি ঢাকা শহরেই অতিবাহিত করেন। এর মধ্যে তিনি ১৯৩৯-১৯৪২ সাল পর্যন্ত বরিশালে কর্মরত ছিলেন।
১৯৪৬ সালে তিনি যখন সবেমাত্র মাধ্যমিক পাস করেছেন তখন তার ছোটগল্প ‘অশ্রæভেজা পথ চলাতে’ প্রকাশিত হয় ‘সওগাত’ পত্রিকায়। এর দুই বছর পর সোনার বাংলায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অবদান রাখেন। একুশের চেতনার ওপর ভিত্তি করে তার কবিতা অমর একুশে প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালেই। এটিসহ আরো কিছু লেখা একত্র করে ১৯৫৩ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংকলন গ্রন্থ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রকাশ করেন। হাসান হাফিজুর রহমানের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায়, ১৯৪৯ সালে। ১৯৫০ সালে ‘পূর্বাশা’য় তার কবিতা ‘যে কোনো সর্বহারার প্রার্থনা’ ছাপা হলে একজন তরুণকবি হিসেবে রাতারাতি আলোচিত হয়ে ওঠেন সাহিত্যাঙ্গনে।
১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে একুশে ফেব্রæয়ারি সংকলন প্রকাশিত হয় এবং তা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় ২০ ফেব্রæয়ারি সন্ধ্যায়। বাবার জমি বিক্রয়ের টাকা এনে একুশে ফেব্রæয়ারির প্রথম স্মরণিকা প্রকাশ করেছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। প্রথম একুশে ফেব্রæয়ারি সংকলন সম্পাদনার ক্ষেত্রে হাসান হাফিজুর রহমানের ভ‚মিকা কতটা অগ্রণী ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সংকলনের প্রকাশক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কর্মীপুরুষ মোহাম্মদ সুলতানের ভাষ্য থেকে :
তেপ্পান্ন সালের প্রথম দিকে হাসান প্রস্তাব দিল ৫২-ও উত্তাল ভাষা আন্দোলনের সময়ে আমাদের দেশের সুধী লেখক সমাজ কলমের আঁচড়ে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, পুস্তকাকারে তা প্রকাশ করা যায় কিনা। আজকের দিনে অনেকেই ভাবতে পারেন, কাজটি কত সহজ। মুসলিম লীগের শাসন, চতুর্দিকে সা¤প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, বামপন্থী মাত্রই রাষ্ট্রদ্রোহী, পূর্ব-পাকিস্তানি তরুণদের আর্থিক অসচ্ছলতা, সরকারের গণবিরোধী শাসনের স্টিমরোলার সব কিছুকে অস্বীকার করেই এমন একটি দুঃসাহসিক কাজ করতে হবে। আমরা যারা রাজনীতি করতাম, ৮ পয়সা থেকে ১২ পয়সা পেলে রাজভোগ খাওয়া হতো মনে করতাম। সেই সময়ে একুশে ফেব্রæয়ারি বইটা বের করতে সেই মুহূর্তেই ৫০০.০০ টাকার প্রয়োজন। আমার আর হাসানের হাতে ৫০ টাকাও নেই। সমাধান করে দিল হাসান। বাড়িতে গিয়ে জমি বেচে সে টাকা নিয়ে আসবে। যা ইচ্ছা, যা চিন্তা, হাসান তাই করল (রহমান ১৯৮৩ : ৬২-৬৩)
১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে নূরুল আমিনের রক্তচক্ষু, মুসলিম লীগের দুঃশাসন, সা¤প্রদায়িকতা; বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে কাতারবন্দি কায়েমী স্বার্থের সন্ত্রাস যখন চলমান, ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সচেতনতা সৃষ্টি হয় এই সচেতনতা ধরে রাখার প্রবল ইচ্ছার সৃষ্টি ‘একুশের সংকলন’ যা আজ এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল।
বাবার জমি নয় মায়ের সোনার গহনা বিক্রি করে নাকি একুশের সংকলন হয়েছে-এ রকম তথ্য আরো একজন লেখকের লেখায় পাওয়া যায়। মনি হায়দার লিখেছেন, ‘...সব লেখা প্রেসে। কম্পোজ চলছে। কিন্তু টাকা কোথায়? টাকা না হলে সংকলন প্রকাশ করবেন কীভাবে? তিনি ছুটলেন বাড়ি, জামালপুরে। মাকে বললেন তাঁর সমস্যা। মা পুত্রের হাতে তুলে দিলেন নিজের পঁয়ত্রিশ ভরি সোনার গহনা। পুত্র চলে এলেন ঢাকায়। বিক্রি করলেন মায়ের গহনা। দায় মিটল প্রেসের, কাগজ কেনা হলো। ছাপা হলো অমর একুশের অমর সংকলন “একুশে ফেব্রæয়ারি”। বাঙালি পা রাখল চেতনার নতুন এক মহীসোপানে। সেই সোপানের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা হাসান হাফিজুর রহমান। (সূত্র : একুশের চেতনার মশালবাহী হাসান হাফিজুর রহমান-প্রথম সোপান ‘একুশে ফেব্রæয়ারি’ ও লিটল ম্যাগাজিন, মনি হায়দার, দৈনিক ইত্তেফাক ২১ ফেব্রæয়ারি ২০১৪)
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রখ্যাত গবেষক ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘একুশে ফেব্রæয়ারি’ হাসানের মহত্তম অবদানে বের হলো, প্রশংসিত হলো, বাজেয়াপ্ত হলো। আমরা উত্তেজিত হলাম। কিন্তু প্রেসের বাকি শোধ হলো না। এ নিয়ে হাসান খুব বিপদগ্রস্ত হলেন। অপমানিত হয়ে একদিন বাড়ি চলে গেলেন। হয় জমি নয় গুড় বিক্রি করে টাকা নিয়ে ফিরে এসে দায় থেকে উদ্ধার পেলেন।’
হাসান হাফিজুর রহমানের প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট শাহ আহমদ রেজা তার ‘স্মৃতিতে অ¤øান : হাসান হাফিজুর রহমান’ লেখাতে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে (হাসান হাফিজুর রহমান) সম্মানের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পের পরিচালক পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন।
হাসান হাফিজুর রহমানের পেশাজীবন খুব বৈচিত্র্যময় ছিল। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় ১৯৫২ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি একাধারে সওগাত (১৯৫৩), ইত্তেহাদ (১৯৫৫-৫৪) ও দৈনিক পাকিস্তান (১৯৬৫) এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলায় সম্পাদক মÐলীর সভাপতি নিযুক্ত হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ১৯৫৭-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭৩ সালে মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলর পদে দায়িত্ব পালন করেন।
হাসান হাফিজুর রহমানের রচনার মধ্যে বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩), আর্তশব্দাবলী (১৯৬৮), আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫), মূল্যবোধের জন্যে (১৯৭০), অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮), যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২), শোকার্ত তরবারী (১৯৮২), প্রতিবিম্ব (১৯৭৬), আরো দুটি মৃত্যু (১৯৭০) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষায় হোমারের ওডিসি অনুবাদও করেছেন তিনি। হাসান হাফিজুর রহমান বেশি পরিচিত তার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ১৬ খÐের দলিলপত্রের (১৯৮২-৮৩)।
হাসান হাফিজুর রহমানের পাকিস্তান লেখক সংঘ পুরস্কার (১৯৬৭), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭১), সুফি মোতাহার হোসেন স্মারক পুরস্কার (১৯৭৬), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), সওগাত সাহিত্য পুরস্কার ও নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮২), মরোণোত্তর একুশে পদক (১৯৮৪) ইত্যাদি সম্মাননা পেয়েছেন।
বাংলা কবিতায় বাঁক পরিবর্তনে হাসান হাফিজুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। একুশের প্রথম সংকলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থের সম্পাদনা তার অমর সৃষ্টি। দেশ ও জাতির কল্যাণে তার কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ সুস্পষ্ট নিদর্শন। অসাধারণ পাÐিত্য, সহজ সরল উদার মন তাকে প্রিয় করে তুলেছিল সবার কাছে। পঞ্চাশ দশকের দিগভ্রান্ত তরুণদেরকে একত্র করে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের দিশাও দিয়েছিলেন তিনি। আমাদের কবিতার অন্তরের প্রতিবাদের আগুন আবিষ্কারের কাজটিও তারই। তার ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ (১৯৬৫) আমাদের কবিতার প্রথম মানচিত্র। তাই সাহিত্যাঙ্গনে তার অবদান অসামান্য। এই মহান কবি ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল মস্কো সেন্ট্রাল হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন