রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

ইংল্যান্ড ও জার্মানির নারীবাদী কণ্ঠস্বর

| প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শাহরিয়ার সোহেল : পৃথিবীর সর্বত্রই রয়েছে আহাজারি, এক বিষণœ ক্রন্দনের সুর। সে সুর অন্য কোথাও নিয়ে যায় আমাদের। আমরা অন্যভাবে নিজেদের ভাবতে পারি। সে সুর মনের গহীনে বাজে মৃদুলয়ে, কখনো উচ্চকিত, কখনো ক্ষোভ, ঘৃণা, ভালবাসা, সংগ্রামের সাথে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীবাদী শক্তিশালী কণ্ঠস্বরের মতো ইংল্যান্ড ও জার্মানিতেও রয়েছে নারীবাদী শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। তাদের চেতনা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন নয়। পৃথিবীর যে কোন জায়গার অনুভ‚তিই এক, প্রকাশ ভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে।
এলিজাবেথ জেনিংস-এর জন্ম ১৯২৬ সালে লিঙ্কন শায়ারে। অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক করেছেন। লাইব্রেরিতে ও প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করে এক পর্যায়ে পূর্ণকালীন লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৬৭ সালে তার কালেক্টেড পোয়েমস প্রকাশিত হলে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পান। তার অপর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ মুমেন্ট অব গ্রেস ১৯৭৯ সালে প্রকাশ পায়।
ভালবাসার পৃথিবীতে কষ্টের শেষ নেয়। হয়তো টুনটুনি পাখি বা কবুতর ভালোবেসে সুখিই থাকে। কিন্তু মানুষ ভালবেসে বিয়ে করলেও দু’দিনেই দু’জন পুরনো হয়ে যায়। এক ছাদের নিচে থাকে, তবু কতো আলাদা, এক সময়তো কতো মোহ ছিল, ধ্রæব আকর্ষণ ছিল, না ছেগেড় যাওয়ার প্রতিশ্রæতি ছিল। কিন্তু সময় পার হবার সাথে সাথে সব কিছুই বড় অচিন-পর হয়ে যায়। এমন বেদনার অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন কবি এলিজাবেথ জেনিংস ‘নবাগত’ কবিতায়।
‘তার জানলার কার্নিশে দুটো
কবুতর ভালবাসায় নিমগ্ন।
পৃথিবীর সব শব্দ তাদের কাছে
এসে থেমে যায়। ক্ষণে আসা
ক্ষণে যাওয়া এই পাখিদের মনে হয়
তার সব ঘৃণা আর ভালবাসা
থেকে কত না সুদূর, মুক্ত।’
১৯৩২ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটেনের নারীবাদী কবিদের মধ্যে অন্যতম জেনি জোসেফ। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের ভেতর রয়েছে, ‘দ্য আনলুকড ফর সিজন (১৯৬০), রোজ ইন দ্যা আফটারনুন (১৯৭৪) ও দ্য থিংকিং হার্ট (১৯৭৮)।
যখন তরুণী বয়স, যেন কিছুই করার থাকে না সামাজিক চাপে। এ রকম পোশাক পরো, এ ধরনের পার্টিতে যেওনা, অন্যের দিকে ওভাবে তাকিয়ো না, কতো যে ঝামেলা! আর বিয়ের পরতো স্বামীর দ্বারা মানসিক এবং কখনো কখনো শারীরিক অত্যাচার। মনটা বিষিয়ে ওঠে। সব কিছুর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে চায়। কিন্তু অক্ষম। ব্যর্থতা ডানা কাটা পাখির মতো অবরুদ্ধ করে রাখে সর্বদা। যখন বয়স হবে এসব নিষেধাজ্ঞা শিথিল হবে। কেউ আর সেভাবে ফিরে তাকাবে না। বিধি-নিষেধ ম্রিয়মান হয়ে উঠবে। তখন প্রতিশোধ নেবে কবি। তরুণী অবস্থায় যা করতে ইচ্ছে হতো তাই করবে বৃদ্ধাবস্থায়। আর প্রতিশোধ নেবে সমাজ-সংসারের প্রতি। এমন ভাবনা ভেবেছেন কবি জেনি জোসেফ তার ‘হুমকি’ কবিতায়।
‘বুড়ো হলে আমি বেগুনি রঙের জামা গায়ে
দিয়ে মাথায় চড়াবো বয়সের জন্য বেমানান টুপি।
আর পেনশনের টাকা ওড়াবো ব্রান্ডি আর গ্রীষ্মের
দস্তানা আর মখমলের চপ্পল কিনে, তারপর
বলব মাখন কেনার কোনো পয়সা নেই আমার।
হয়রান হয়ে গেলে ফুটপাথে বসে পড়ব, দোকানের
মাগনা মিষ্টি গিলব গপাগপ, বাজিয়ে দেব
পাগলাঘন্টি, রেলিঙে গুঁতাবো ছড়ি দিয়ে,এভাবে
তরুণীবেলার যত ভালোমানুষির শোধ তুলব।’
১৯৬৬ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি নেলি সাকস-এর জন্ম জার্মানিতে ১৮৯১ সালে। নাৎসি অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৯৪০ সালে তিনি স্টকহোমে চলে যান এবং ১৯৭০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। তার প্রধান কাব্যগ্রন্থের ভেতর রয়েছে, ‘ও দ্যা চিমনিস’,‘ইন দ্যা হ্যাবিটেশনস অব ডেথ’, ‘দ্যা সিকার এন্ড আদার পোয়েমস’ প্রভৃতি।
পুরুষের কতো স্বাধীনতা, তা দেখে ক্ষোভ জাগে নারীর মনে। বাজারের ভেতরে দাঁড়িয়ে পুরুষ চিৎকার করতে পারে; কিন্তু নারীর সব দরজাই বন্ধ। এক বিমর্ষ পরাধীনতা ঘিরে থাকে নারীদের। পুরুষের উচ্ছ¡াস এজন্য নারীদের ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। কবি নেলি সাকস ‘তাকিয়ে দেখ’ কবিতায় এমন মনোভাব পোষণ করেছেন।
‘তাকিয়ে দেখ
বাজারের মাঝখানে
পুরুষ ভেঙে পড়ে,
তুমি কি তার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছ,
নিয়তি থামিয়ে দিয়েছে সময়ের চাকা,
মহানগরী চপ্পল পায়ে তার শরীর ঘিরে দাঁড়ায়,
তার নিশ্বাসের ছন্দে ছন্দে নিজেকে দোলায়।
আয়নায় ঘেরাটোপে পণ্যের ঝলসানি,
বায়ু শ্মশানের মাঝে চিমনিতে ওড়ে
কালো পতাকা।
আহ, ধ্বনি তুলে সে পুরুষ
ঋজু মোমবাতি বেয়ে
রাত্রির শিখরে উঠে যায়।’
সারা কির্শ-এর জন্ম ১৯৩৫ সালে পূর্ব জার্মানিতে। জার্মান ভাষার প্রধান কবিদের একজন। চারণকবি ভোলফ বিয়ারমানকে সমর্থন করার অপরাধে পূর্ব জার্মানি থেকে বহিষ্কৃত হন। তার উলেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থসমূহ হল ‘কনভারশেসন উইথ দ্যা সাউরিয়ান’ এবং ‘পোয়েমস’।
পৃথিবীজুড়েই শুধু যন্ত্রণা। ভালবাসা ভেঙে যায় শিরদাঁড়া ভেঙে। একদিন থাকে দূরন্ত গতি, টগবগে লাল ঘোড়া, বেশি দিনের দূরত্ব নয়, ঘোড়া বৃদ্ধ হয়ে আসে, যৌবন বার্ধক্যে রূপান্তরিত হয়। বৃষ্টি হয়ে ওঠে ধূসর। সৈকতের পাথরের গায়ে জমা হয় ফসিল। এমন এক ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা ফুটে উঠেছে কবি সারা কির্শ এর ‘শীত সঙ্গীত’ কবিতায়।
‘একদা লাল ঘোড়া
দুর্বার গতি, যা চেয়েছি
তাই পেয়েছি দু’হাত ভরে।
এখন ধূসর আমি ধূসর বৃষ্টি
আমি কল্পনায় গ্রীনল্যান্ডের মতো
দূর দেশ অব্দি গেছি।
সৈকতে পাথর চমকায়
তার গায়ে লেখা ‘কেউ ফেরেনা’
সে পাথর আমার জীবন খর্ব করে দেয়।
পৃথিবীর চার দিগন্তই
যন্ত্রণায় ভরা। ভালবাসা
বুঝি শিরদাঁড়া ভেঙে যাওয়া।’
ইংল্যান্ড ও জার্মানির নারীবাদী কবিরা শক্তিশালী কণ্ঠে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। নারীদের প্রতি ধর্ষণ, অত্যাচার, বৈষম্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। নারীদের জেগে ওঠার আহŸান রয়েছে তাদের কবিতায়। যেসব পুরুষদের জন্য নারীরা অবহেলিত, তাদের বিরুদ্ধে এ সকল কবিদের রয়েছে দারুণ ঘৃণা-ক্ষোভ। নারীরা নিষ্পেষিত, নির্যাতিত। এ অবস্থা থেকে তাদের উত্তরণ দরকার। শুধু বসে বসে অশ্রæ ফেলা নয়। অশ্রæই যেন হয়ে ওঠে শক্তিশালী বারুদ আর অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে পারে যথাযথভাবে। এটাই ইংল্যান্ড ও জার্মানির নারীবাদী কবিতাগুলোর মূল সুর। মূল ধ্বনি, মূল সুর একাকার হয়ে মিশেছে মনের সত্য সাগরে।
তথ্য সহায়ক
# নির্জন নিশ্বাস-অনুবাদ-আলম খোরশেদ
# ঃ *প্রকৃত শিল্পের স্বরূপ সন্ধান-ড. আব্দুস সাত্তার
* সমকালীন শিল্প ও শিল্পী- নজরুল ইসলাম
* মডেলের সন্ধানে-প্রদোষ দাশগুপ্ত
* কিউবিজম ও অনুসঙ্গ-ম. রফিকুল আলম
* লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-মোবাশ্বের আলী
* জন সিঙ্গার সার্জেন্ট-কবীর চৌধুরী
* সান্দ্রো বতিচেলি : জীবন ও কর্ম-কবীর চৌধুরী
* রদ্যাঁ-কবীর চৌধুরী
* গয়্যা- কবীর চৌধুরী
* পল সেজান ও মাতিস- কবীর চৌধুরী
* দেশজ আধুনিকতা : সুলতানের কাজ-বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর,
* রবীন্দ্রনাথের চিত্র শিল্প-আহমেদ রফিক
* ছবি কাকে বলে- অশোক মিত্র।
# এলিজাবেথ জেনিংস-এর কবিতা
# জেনি জোসেফ-এর কবিতা
# নেলি সাকস-এর কবিতা
# সারা কির্শ-এর কবিতা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন