স্বাধীন পারভেজ
অভিমানে আমার পেট ফুলে আছে। রাগে গা কাঁপছে থরথর। আহলাদে গুমগুম করছে হৃদয়। পেয়ে নিই না তোমাকে হাতের কাছে! পিটিয়ে তক্তা বানাবো। কিলিয়ে আলু ভর্তা করব, খামচে রক্ত বের করে দেব। কি ভাবো কি তুমি আমাকে হ্যাঁ? রাক্ষুসী, পেটুক? শুধু খেতে, পড়তে আর খরচ বাড়াতেই তোমার সংসারে এসেছি?
ওগো, শোনো না। কেন এমন করো বল তো? আমার কি খারাপ লাগে না? একটু আমার কথাটা ভাবো। আমি তো তোমারই স্ত্রী। তোমার জীবনসঙ্গী। তোমার ভালমন্দ দুটোই তো আমার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ তোমাকে নিয়ে জীবনভর এই সুখ দুঃখের সমান অংশীদার হওয়া। আর তোমাকে এগিয়ে নেয়া, যতটা সম্ভব পাশে থেকে উৎসহ দেয়া। সান্ত¡না দেয়া, আবার শাসনও করা। কিন্তু কি কপাল আমার দেখো? তুমি তো আমাকে তোমার কাছেই ঘেঁষতে দাও না। সেই বিয়ের দুদিন পর থেকেই দেখে আসছি, তুমি কেন যেন আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে মেশো না। দূরত্ব বজায় রাখো। প্রথমদিকে ভাবতাম যে অনভ্যস্ততার কারণেই বুঝি তুমি এমনটি করেছো। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক তো হয়নি কিছুই, বরং দিনে দিনে আরো দূরে সরে যাচ্ছ তুমি। আমি বিষয়টা নিয়ে ভাবতাম, খুব ভাবতাম জানো? কিন্তু ভেবে পেতাম না যে কেন তুমি আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারছো না। এভাবে দূরে সরে থাকছো। অবশেষে সেই কারণটা জানতে পারলাম, তা ও আবার তোমার বোনের মুখ থেকে। এ জন্য তোমার ওপর অভিমানী রাগটা আমার আরো বেশি তৈরি হয়েছে বুঝলে? পেয়ে নিই না তোমাকে হাতের কাছে, ঘাড় মটকাবো তোমার। কি ভেবেছো কি হ্যাঁ? নিজের বোনের কানে কানে ফিশ ফিশ করে মনের কথা ঠিকই বলতে পারো, আমাকে বলতে কি হয়? আমি কি তোমার ভাসুর না শ্বশুর যে আমাকে সবকিছু বলতে লজ্জা লাগে?
ওগো, শোনো না। কেন এমন করো বল তো?। আমার বুঝি কষ্ট লাগে না? আমি তো তোমারই বৌ। দূরের মানুষ তো নয়, তাহলে আমাকে সবকিছু বললে না কেন? আজই মেজআপুর কাছে থেকে জানতে পারলাম যে, ঢাকা যাওয়ার আগে তুমি তার কাছে বলে গেছো যে, তুমি ভাল চাকরি কর না, বেশি বেতন পাও না, তাই হীনমন্যতাবোধ করো। আমার আন্যান্য বোনের স্বামীদের মত তোমার অতটা আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় লজ্জায় আমার সামনে নিজেকে ঠিকভাবে উপস্থাপনও করতে পারো না। তাই এভাবে দূরে দূরে থাকো। জেনে লজ্জায় মরে যাই আমি। নিজের অতীত আচরণের ত্রæটিগুলো খুঁজতে থাকি। কি এমন ভুল করেছিলাম আমি? যে কারণে তুমি আমাকে এতো বেশি ভুল বুঝলে? কিন্তু বিশ্বাস করো, এমন কোন কিছুই মনে পড়ছে না আমার। যার কারনে তুমি কষ্ট পেয়ে এমনটি ভাবতে পারো। আর মনে পড়বেই বা কিভাবে? তোমার সঙ্গে বিয়ের পরে এই দু’মাসে কতক্ষণই বা সময় কাটাতে পেরেছি আমি? খালি তো দূরে দূরেই থাকতে। এবার কাছে পেয়ে নিই না তোমাকে, আঁচলে গিঁট দিয়ে রাখবো। কোত্থাও যেতে দিব না। দরকার হলে নিজে উপার্জন করে তোমাকে খাওয়াবো। তবুও তোমার সম্পূর্ণ ভালবাসা আমি আদায় করেই ছাড়বো। কি ভেবেছো আমায় তুমি, আমি খুব দুর্বল? মোটেও না। মির্জা বাড়ির মেয়ে আমি, চিনো আমাকে হুঁ?।
ওগো, শোনো না। তুমি যেমনটি ভাবছ ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তেমন কিছু নয়। আমি কিন্তু কোনদিন ভাবিনি যে আমার স্বামী কতো বেশি উপার্জন করবে বা আমাকে কতো বেশি বিলাসিতায় রাখবে। এমনকি আজও সেসব ভাবি না। আমি শুধু ভাবতাম তার মন মানসিকতা নিয়ে। তার সততা, দায়িত্ববোধ আর নীতি নৈতিকতা নিয়ে ভাবতাম। তুমি জানো, আজকালকার দুনিয়াতে কেউ কারো কাছে টাকা পয়সা চায় না। চায় শুধু একটু ভাল ব্যবহার। একটু নির্ভরতা, আস্থা আর বিশ্বাসে পূর্ণ দুটি হাত। তোমার সেই হাত দুটিকে চিনতে পেরে সেই কবেই তো নিজে কে সঁপে দিয়েছি ওই দুটি হাতে। অথচ কি বোকা তুমি দেখো। বাচ্চা মেয়েটাকে একলা একা ফেলে রেখে দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াচ্ছো তুমি। আচ্ছা, বল তো, আমি কি খুব চটপটে? অতিরিক্ত চঞ্চল প্রকৃতির? ভাললাগে না তোমার আমাকে? ভয় পাও? সুন্দর করে তোমার চাহিদাগুলো আমায় বুঝিয়ে বলো। দেখবে আমি ঠিক নিজেকে নিজের মত করে গড়ে নেব। একেবারে তোমার মনের মত হয়ে যাব। আর যদি তুমি তা না পার, আমিই তোমাকে নিজের মত করে গড়ে নেব। কি মনে কর তুমি আমাকে হ্যাঁ? আমি অবলা নারী? কিছু করার ক্ষমতা নেই আমার? মোটেও না। রমজান হাজির নাতনি আমি। চেনো আমাকে? আমি তোমায় দখল করেই ছাড়ব, হুম।
ওগো, শোনো না। একটি বার বাড়িতে আসো। মাত্র দু‘দিনের ছুটি নিয়ে। আমায় সামনে নিয়ে একদÐ বসো। তোমার যা মন চায় সব আমাকে বলো। মনের সমস্ত কথা উগড়ে দাও। দেখবে ভাল লাগবে। হালকা বোধ করবে। আমি তো তোমারই, তোমার একান্ত একজন মানুষ। আমায় আপন করে নাও। আমাকেও তোমায় আপন করে নেওয়ার সুযোগ টুকু দাও। দেখবে, তোমার সব জড়তা কেটে যাবে। কত গল্পের বইয়ে পড়েছি এমনটা। কত মানুষের মুখেও শুনেছি, নতুন বৌয়ের চতুর স্বামীরা কিভাবে বৌকে সহজ করে নেয় নানা কৌশলে। অথচ কি কপাল আমার দেখে, বৌ হয়ে স্বামীকে বোঝাতে হচ্ছে। আমি তবুও ক্লান্ত নই। তুমি গ্রামে আসো। তোমার এই অসুন্দরী অশিক্ষিতা বৌটির সামনে একটুক্ষণ বসো। কথা দিচ্ছি, তোমার সমস্ত যন্ত্রণা আমি শুষে নেবো। দুজনে মিলে দারুণ প্রগাঢ় বন্ধুত্ব করবো। তারপর কিভাবে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা যায়, সংসারটাকে আরো ভালভাবে সামনে এগিয়ে নেয়া যায় সেই সব পরিকল্পনা করবো। এরপর দেখবে তুমি যা-ই উপার্জন করবে তাই নিয়েই দেখবে কত সুন্দরভাবে সংসারটা চালাবো। আমার উপর বিশ্বাস রাখো। দূরে থেকে আর আমাকে সাজা দিও না। একটি বার গ্রামে আসো। তোমার খুলে রাখা শার্টের কাপড়ে নাক ডুবিয়ে আমাকে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে দাও। দরজার আড়ালে লুকিয়ে ঘুমন্ত তোমার চাঁদমুখখানা দুচোখভরে দেখতে দাও, প্লিজ!
চিঠি পাওয়ার পরও যদি বাড়ীতে না আসো, এতো কিছু বলার পরও যদি এভাবেই লুকিয়ে থাকো, ঢাকা গিয়ে ধরে নিয়ে আসবো তোমায়। কি ভেবেছো তুমি আমাকে, গ্রামের বোকা মেয়ে? যা করবে তাই ই মেনে নিবো? মোটেও না। মৌমিতা ইয়াসমিন নাম আমার। চিনো আমাকে? তোমায় আমি আপন করেই ছাড়বো। একেবারে তাবিজ করে হাতের বাজুতে বেঁধে রাখব তোমাকে, হুম।
অর্ধাঙ্গিনীর চিঠি এসেছে। চিঠি তো নয়, যেন অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট। গ্রেফতারি পরওয়ানা। হুমকি, ধামকি, আবেগ, আহলাদ, অধিকার, অভিমানে টইটুম্বুর তার প্রতিটি বর্ণ। শব্দ। বাক্য। আমি হাতের আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেখি কথাগুলো। বারবার। কি আশ্চর্য, কালো কালির আঁচড়ে লেখা কথাগুলোর ছোঁয়াতে দারুণ অভিভূত হয়ে যাই আমি। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
টেবিলের ওপর ভাঁজ করে রাখা চিঠিটা হালকা বাতাসের ছোঁয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেদিক তাকিয়ে থাকি আপনমনে। বড় সুখবোধ হয় কাগজখানার সেই দুলুনিটুকু দেখতে। এভাবেই হয়তো কাঁপছে তার আচঁলখানা। বাতাসে উড়ছে তার বিশাল হলুদ ওড়নাটা। কল্পনায় দেখি- ঠোঁট উল্টে, মুখ বাঁকিয়ে হাত পা নেড়ে নেড়ে যাচ্ছেতাইভাবে নাজেহাল করে ছাড়ছে সে আমাকে। তবুও আমার ভাললাগে। তাকে নিয়ে ভাবতেও ভাল লাগে আমার।
ধীরে ধীরে এগিয়ে অফিসের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। শীতল দৃষ্টি বিছিয়ে দেই সম্মুখে। শহরটাকে আজ বড় ভালো লাগছে। দারুণ মায়াময় মনে হচ্ছে কংক্রিটের এই অসহ্য উদ্যানকে। আমি চেয়ে থাকি। জানালার গ্রিলে হেলান দিয়ে দূর দিগন্তপানে চেয়ে থাকি। নিজেকে বড় পরিপূর্ণ, বিরাট ধনী বলে মনে হতে থাকে আমার। আগে তো কোনোদিন এমনটি মনে হয়নি। মৌমিতা, কতটা সম্পদশালী করে দিলে তুমি আমাকে, নিমিষেই...!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন