স্টাফ রিপোর্টার : সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর/ কত বর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে/ অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়-পুরু/ আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর....। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে এমনি রস মিশিয়ে এই সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ পঁচিশে বৈশাখ। বাঙালির প্রাণপুুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিস্ময়কর প্রতিভা। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রবর্তক। রবীন্দ্রনাথ সেই আধুনিকতাকে বিচিত্র বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সহজ ও সুগমভাবে উপস্থাপন করেছেন সকল বাঙালির হৃদয়স্পর্শী করে। তাঁর ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। আর তাঁর সঙ্গীত সুরপিয়াসী বাঙালির মনে বাজে নানা মাত্রায়। বাংলা ভাষার প্রতিটি শাখায় তাঁর বিচরণ অনন্য। সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষাকে করেছেন সহজ ও সর্বজনবোধ্য এবং একই সঙ্গে গতিশীল। যে ভাষাকে নিয়ে বাঙালি আজ বিশ্বপরিমন্ডলে গৌরব করে সে ভাষা সৃষ্টির উৎসশক্তিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন অনন্ত জীবন এবং প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখন্ডরূপে। তাই তার গানে জীবন ও জগতের সুর বাজে এভাবেই- “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ-দহন লাগে/ তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে”। বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য এই কবির ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। মানবিকতা, প্রেম ও শুভবোধের কবি আদর্শ পুরুষ রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসার অর্ঘ্য প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করছে নানা অনুষ্ঠান।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৫৫ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রবক্তা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের মূল নায়ক কাব্যগীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, দ্রষ্টা ও ঋষি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁর লেখা, দর্শন, চিন্তা, চেতনা তথা বহুমাত্রিক আলোকচ্ছটায়, ঔজ্জ্বল্য ও মহিমায় বাঙালি জাতিসত্তা হয়েছে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত। সেই কবিরই ১৫৬তম জন্মজয়ন্তী আজ। আর তাই বাঙালির প্রাণে লেগেছে ভিন্ন হাওয়া। দিনটিও বাঙালি উদযাপন করবে হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দিবসটি আজ পালিত হবে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে।
বাঙালির এই কবি এমন এক সময় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন, চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর, বাংলাভাষা ছিল অপরিণত। তিনিই একাধারে এই ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তাজগতে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। বাঙালির মানস গঠনে পালন করেছেন অগ্রদূতের ভূমিকা। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা যোগানোর মধ্য দিয়ে বাঙালি মননকে বিশ্বমানে উন্নীত করে জাতিকে চিরকৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ করে গেছেন।
তিনি বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন কথা, সুন্দর দেখার দৃষ্টি ও জন্মভূমিকে ভালবাসার বোধ। শিখিয়েছেন কেমন করে বাসনা করতে হয় লালন, আশায় বাঁধতে হয় বুক এবং মানুষ ও প্রকৃতিকে করতে হয় আপন। কল্পনার প্রজ্ঞা দিয়েছেন, সৃষ্টির প্রেরণা দিয়েছেন, দিয়েছেন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের বন্দনা বাণী। প্রেম-ভালবাসায়, প্রতিবাদের ভাষায়, আন্দোলনের অঙ্গীকারে ও স্রষ্টার আরাধনার একনিষ্ঠতায় সর্বক্ষেত্রেই পাওয়া যায় তাকে। গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে আত্মশক্তিরূপে এবং দেশমাতৃকার জন্য আপনাকে উৎর্সগ করার ব্রত বোধেও তিনি অগ্রদূত। কবিতা, কথাশিল্প, নাটক, অনুবাদ, চিত্রকলা, সঙ্গীত, সুর সর্বক্ষেত্রেই তাঁর পথচারিতার পদচিহ্ন প্রবল প্রতাপে লেগে আছে বাঙালির জীবন, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে। এনেছেন সৃষ্টিশীলতা, চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সফলতা। তিনি একসঙ্গে উনিশ ও বিশ শতকের দায়কে সামনে রেখে সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সুর প্রভৃতি। কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে সরকারি পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠান। পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র, চ্যানেলগুলো প্রচার করেছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত নওগাঁর পতিসরে। এদিন বিকাল ২টা ৩০ মিনিটে নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ির দেবেন্দ্র মঞ্চে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মানুষের ধর্ম : রবীন্দ্রনাথ ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা’। এ বিষয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ। আলোচনার পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ৩০ মিনিটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগসহ ঢাকায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে।
অবিচার বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায় রবি ঠাকুরের লেখনি -বেগম জিয়া
সমাজের অনাচার, অবিচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনি অনুপ্রেরণা যোগায় বলে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল (রোববার) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বাণীতে তিনি একথা বলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আমাদের জাতীয় জীবনের সকলক্ষেত্রে বিশ্বকবির অপরিসীম প্রভাব বিদ্যমান। এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিরল সম্মান অর্জনকারী রবীন্দ্রনাথ তার উপন্যাস, কবিতা ও গানে গভীর জীবনবোধ, প্রকৃতির সাথে সংলগ্নতা স্বর্গীয় আনন্দের আবহ তৈরী করে। বাণীতে তিনি আরো বলেন, তার সৃষ্টির মধ্যে প্রাণ-প্রকৃতি এক অনন্যরূপ ধারণ করে। আমরা গর্ববোধ করি তার রচিত গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পেয়ে। তার অনন্য সৃষ্টিতে চিরাচরিত ধারার বাহিরে স্বাতন্ত্র্যধর্মের পরিচয় মেলে। ধর্ম-লোকাচার, রাজনীতি ও সমাজচিন্তা এবং বিশ্বভাবনায় এই স্বাতন্ত্র্যবোধ তার বিশাল সাহিত্য সংস্কৃতির পরিমন্ডলে বাংলা ভাষাভাষির মানসলোক নির্মানে নূতন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্বকবি, স্বপ্নদ্রষ্টা, কারও জীবনকে বহমান ও নানা বৈচিত্র্যে উদ্ভাসিত করতে তিনি স্বপ্নের কথা আনেন শিল্পমন্ডিত ঐশ্বর্য্য। বাণীতে তিনি উল্লেখ করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অনাবিল সৃষ্টিতে একদিকে যেমন স্বজাতির মুঢ়তা, স্থবিরতার বিপন্ন ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন, আবার অন্যদিকে তিনি জাতীয় জীবনের সব অচলায়তন ভেঙ্গে বিশ্বের অতি অগ্রসর জাতিসমূহের কীর্তিময় অর্জনগুলোকে গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছিলেন। আবার স্বজাতির অনিন্দ্য সুন্দর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপাদান সমূহ এবং মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ সূর ও বাণীর অনন্য ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলেছেন তার প্রতিভাদীপ্ত সৃষ্টিকর্মে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন