রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

ধ্বংসের মুখোমুখি তামাইয়ের তাঁতশিল্প

অযত্ম অবহেলায়

| প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আকন আবদুল মান্নান তামাই থেকে ফিরে : দিনের অগ্রভাগ বাসজার্নি করায় শরীরটা বেশ ক্লান্তই হয়ে পড়েছিল। গত ৭ মে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গন্তব্যস্থল তামাই পৌঁছি। জুম্মার নামাজ আদায় করে সারোয়ার মুসুল্লির বাসায় খাবারের পর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখ ভরে ঘুম চলে আসে। আসরের আজানে ঘুম ভাঙে। বারান্দায় যেতেই বৃষ্টির শব্দ। চারদিকে বৈশাখের উত্তাপ। মাথার ওপর দিগন্তজোড়া নীলাকাশে গনগনে সূর্য। এর মধ্যে বৃষ্টির শব্দে কিছুটা অবাক হলাম বৈকি। খোঁজ নিয়ে জানলাম এটি একটি মেশিনের শব্দ। টুয়িস্ট মেশিন। তাঁতশিল্পে অন্যতম সহযোগী মেশিন টুয়িস্ট। সুতা প্রক্রিয়াকরণ ও ববিন করা হয় এই টুয়িস্ট মেশিন দিয়ে। তামাইয়ের রাস্তায় নামলেই যে কেউ টুয়িস্ট মেশিনের ঝিরি ঝিরি শব্দে বিমোহিত হবেনই।
এতক্ষণ যে তামাইয়ের কথা বলছিলাম সেটি নিতান্তই অজপাড়া গাঁয়ের অবহেলিত একটি সম্ভাবনাময় শিল্পসমৃদ্ধ গ্রাম ‘তামাই’ । যমুনা সেতু থেকে প্রায় ১২ কি.মি. দক্ষিণ পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার ৭/৮ বর্গ কি.মি. আয়তনের ছোট্ট একটি গ্রাম তামাই। প্রায় শতবর্ষ পূর্বে ব্রিটিশ আমলে তামাই গ্রামে একান্তই নিজস্ব ও পারিবারিক প্রয়োজনে স্থানীয় ভাষায় ‘খটখটি’ মেশিনের মাধ্যমে এ গ্রামে আজকের সমৃদ্ধ তাঁত শিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। এরপর যুগের চাহিদানুযায়ী কালের পরিক্রমায় চিত্তরঞ্জন তাঁত, পিটলুম (হ্যান্ডলুম) এবং আজকের এই যন্ত্রচালিত পাওয়ার লুমে তাঁতশিল্প উন্নীত হয়। তবে খটখটি আর চিত্তরঞ্জন তাঁত তামাইয়ে নেই। প্রায় ১৫ হাজার পাওয়ার লুম ও প্রায় ২ হাজার হ্যান্ডলুম মেশিন এবং এর সহযোগী টুয়িস্ট মেশিনসহ অন্যান্য মেশিননারীজ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘তামাই তাঁতপল্লী’। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় তামাই তাঁতপল্লী কেন্দ্র করে সম্পুর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দিনে দিনে তামাই হয়ে উঠেছে ছোটখাটো একটি শিল্পসমৃদ্ধ শহর। শুধু তামাইয়ের ব্যবসার দিকে লক্ষ্য করে জনতা ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারসহ লক্ষাধিক লোকের বসবাস এ গ্রামে। তাদেরই প্রয়োজনে বর্তমানে ৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের কোমলমতি শিশুরা পড়াশুনা করছে। এর পাশাপাশি রয়েছে ৮টি কেজি স্কুল, ২টি হাই স্কুল, ১টি ফাজিল মাদরাসা, ১টি কওমি মাদরাসা, হাফিজিয়া মাদরাসা ৩টি, মসজিদ ৩৯টি, কবরস্থান ৫টি এবং ৫টি ঈদগাহ রয়েছে তামাই গ্রামে। এর পাশাপাশি সহ¯্রাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য রয়েছে ২টি মন্দির। এই লক্ষাধিক লোকের জন্য বৃহৎ পরিসরে দৈনিক কাঁচাবাজার রয়েছে ২টি। আছে বহু সংখ্যক দোকানপাট,ব্যবসা-বানিজ্য প্রতিষ্ঠান, সুদৃশ্য সুপরিসর মার্কেট। সত্যি বলতে এ এক অবিশ্বাস্য শিল্পসমৃদ্ধ গেঁয়ো জনপদ। এ জনপদের উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধি দেখে সরকার তামাইকে অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছিল বেলকুচি পৌরসভায়। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বসিন্দারা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন,‘আমরা বেশ আছি, ভালো আছি, পৌরসভায় যাওয়ার আমাদের দরকার নেই।’
অতিরিক্ত করের বোঝা আর নিরন্তর অযাচিত ও বারতি ঝামেলার ভয়ে তারা ‘ভালো আছি’ বলে পৌরসভা প্রস্তাব পত্রপাঠ বিদায় করলেও আসলে তারা মোটেও ভালো নেই। তামাইয়ের তাঁতশিল্প এলাকায় ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ৭/৮ মেগাওয়াট। কিন্তু লোডশেডিং আর অসহনীয় বিদ্যুত বিভ্রাটের কারনে উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা কখনোই পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অভিযোগ রয়েছে, ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি লাইন নিতে বিদ্যুত বিভাগের লোকজনকে ‘নগদ নজরানা’ দিতে হয় ৪/৫ লাখ টাকা। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, কারো মিটার অথবা ট্রান্সফর্মা পুড়ে গেলে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁতশিল্প মালিকদেরই কিনে নিয়ে পুনঃস্থাপন করতে হয়। উল্লেখ্য, একটি পাওয়ার লুম মেশিন চালাতে ১ কিলোওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এর পাশাপাশি ভারতীয় পন্যে বাজার সয়লাব, সুতার অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি ও ব্যাংক ঋনে উচ্চহারে সুদ, সর্বোপরি সরকারি সহযোগিতার অভাবে এ শিল্প আজ ভয়াবহ রকমের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তামাই ছাড়াও সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, মাধবদী, নরসিংদী, জয়পাড়া, মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২ লক্ষাধিক পাওয়ার লুম ও প্রায় ১ লাখ হ্যান্ডলুম মেশিন রয়েছে। কিন্তু উপরোল্লিখিত নানান কারনে দেশজুড়ে তাঁতশিল্প আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছেছে। অনিশ্চিত পথযত্রার পথচারী হওয়ার আশংকা রয়েছে কয়েক কোটি মানুষের। যাদের জীবন জীবিকা এ তাঁতশিল্পকে ঘিরেই আবর্তিত।
এ প্রসঙ্গে হ্যান্ডলুম এন্ড পাওয়ার লুম ওনার্স এসোসিয়েশনের তামাই শাখা ট্রেজারার শেখ আবদুল্লাহ বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষ ও তাদের পরিবারের জীবন জীবিকার স্বার্থেই তাঁত শিল্প রক্ষা করতে হবে। এ শিল্পের বর্তমান দুরবস্থা আর অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করে অনেক শিল্প মালিক এরই মধ্যে বিকল্প আয় উপার্জনের পথ খুঁজছেন। অনেকে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে চাকরি বাকরির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। সময় থাকতে এ ব্যবসা পরিত্যাগই তাদের লক্ষ্য। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ শিল্প রক্ষা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, তামাই এক শান্তির জনপদ। এখানে মুসলিম হিন্দু জনগোষ্ঠী পরষ্পর মিলে মিশেই আছি আমরা। তামাই গ্রামে কোনো মারামারি হানাহানি, দাঙ্গা হাঙ্গামা নেই, সন্ত্রাস চাঁদাবাজি নেই। সিঙ্গাপুরের মতই শিল্পসমৃদ্ধ ছোট্ট এক অবারিত শান্তির জনপদ হিসেবেই গড়ে উঠেছে তামাই। বাইরের কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ এখানে এসে মাস্তানি করার সাহস করে না। এমন এক শান্তির জনপদ তামাই সরকারি সহযোগিতা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়াবেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন