শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহিলা

সমস্যার ঘেরাটোপে মণিপুরি তাঁতশিল্প

প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেহরিন কুইন

ঐতিহ্যবাহী সুতার কাজ ও আদি পেশাকে অবলম্বন করে এগিয়ে যাচ্ছেন ৩৪ বছর বয়সের মণিপুরি নারী নোংপকলৈ সিনহা। মণিপুরি এদেশের অতিসুপরিচিত ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম। এ জনগোষ্ঠীর রয়েছে একটি প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ১০ বছর যাবৎ এ পেশার সাথে জড়িয়ে আছেন তিনি। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। সমাজকর্মে অনার্সসহ মাস্টার্স পাস করেছেন নোংপকলৈ। এখনও বিয়ে করেননি, বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করবেন বলে জানালেন তিনি। সিলেটের পশ্চিম শিবগঞ্জের তামাবিল রোডে মণিপুরি তাঁতশিল্পজাত পণ্যের ব্যতিক্রমী সম্ভার মোইরাংয়ে কাজ করছেন। নোংপকলৈ জানান গ্রামের প্রতিটি মণিপুরি পরিবারেই রয়েছে হস্তচালিত তাঁত। নিজেদের পরিধেয় বস্ত্র ‘ফানেক’, ‘ইন্নাফি’, ‘লৈফানেক’ ছাড়াও প্রতিটি পরিবারের নারীরা বিভিন্ন ধরনের কাপড় বোনে। তাদের উৎপাদিত পণ্যের কদর ও বাজার দেশে-বিদেশে প্রসারিত হয়েছে। তবে পুঁজি, সুতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে এই শিল্প এখন সমস্যার ঘেরাটোপে বন্দি। রতœা সিনহা মইরাংয়ের অন্য একজন কর্মকর্তা। ডিগ্রি পাস করে মইরাংয়ের মৌলভীবাজার শাখা অফিসে প্রজেক্ট কমিউনিটি অর্গানাইজার হিসেবে কাজ করছেন। রতœা জানান, মণিপুরি মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেদের কাপড় যেমন-ফানেক, চাদর, টুপি নিজেরাই তৈরি করতে শেখে। ক্রমে তারা হয়ে ওঠে নিপুণ শিল্পী। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৯০ শতাংশ মণিপুরি নারীই এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। ফানেক তাদের জাতীয় পোশাক। বাড়িতে রতœার মা এই পেশাক তৈরি করেন। রতœা জানান, বাড়িতে বয়স্করা বসে সূতাগুলি তৈরি করে আর মেয়েরা সেই সুতা দিয়ে কাপড় বুননের কাজ করে। শাড়ি, ওড়না, উল বা কটনের তৈরি মাফলার, চাদর, থ্রিপিস ইত্যাদি। সুতি, তাঁতজাত এবং খাদি বিভিন্ন কাপড়ে তৈরি করা হয় মেয়েদের ফতুয়া এবং স্কার্ট টপস। পোশাকে রঙের ব্যবহার বেশ আকর্ষণীয়। এ সত্ত্বেও অনেকটা হতাশ রতœা। কারণ, স্বাবলম্বী হয়ে মেয়েরা অন্য পেশায় বা চাকরি করতে চলে যাচ্ছে বিধায় আদি পেশা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। তিনি জানান, ঐতিহ্যবাহী সুতার কাজ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। রতœার বাবা মাঠে কৃষিকাজ করেন। ক্ষেতের আলু বা সবজির চাষাবাদ করে যা উৎপাদিত হয় তা দিয়ে সংসারের খাবারের যোগান হিসেবে ব্যবহার করা যায়, ফলে সারা বছরে বাজার থেকে তরিতরকারী কেনা লাগেনা। আড়ং-এর ফ্যাসন ডিজাইনার চন্দ্র শিখর সাহাও মোইরাংয়ে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানান, কারখানায় প্রায় ১০০ জন তাঁতজাত শিল্পকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। মহিলারা বাসার গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি পোশাক বুননের কাজ করে। তাদের মাথে আলাপ করে জানা যায়, এই শিল্পের প্রধান সমস্যা পুঁজি। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া গেলেও সুদের হার বেশি। হস্তশিল্পে স্বল্প সুদে ব্যাংক-ঋণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। উৎপাদিত পণ্যের বিদেশে বাজার সৃষ্টি এবং কারিগরদের প্রশিক্ষণে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। মোইরাংয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মণিপুরি নৃত্যের যেমন বিশ্বব্যাপী পরিচিতি রয়েছে, তেমনি মণিপুরি ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পজাত পণ্য যেমন, শাড় লুঙ্গি, ওড়না, থ্রিপিস, চাদর, গামছা, বেডশিট, ইত্যাদি ইতোমধ্যে বেশ সমাদৃত হয়েছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী মণিপুরি পণ্যের নামে দেশের অন্য এলাকায় উৎপাদিত পণ্যকে মণিপুরি পণ্য হিসেবে বিক্রি করায় ক্রেতা সাধারণ প্রতারিত হচ্ছেন। যার ফলে অধিকাংশ ক্রেতাই বর্তমানে সঠিক মণিপুরি পণ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। তাই ক্রেতা সাধারণের নিকট সঠিক এবং গুণগত মানসম্পন্ন মণিপুরি তাঁতশিল্পজাত পণ্য পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই মৌলভীবাজার জেলা ও সিলেট শহরের শতাধিক দক্ষ মণিপুরি তাঁতশিল্পীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ‘মোইরাং’য়ের অগ্রযাত্রা।
স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এর উদ্যোগে দেশীয় ঐতিজ্যবাহী এ শিল্পের মাধ্যমে মণিপুরি নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটি একটি সামাজিক উদ্যোগ। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ‘মোইরাং’ থেকে উৎপাদিত মণিপুরি তাঁতশিল্পজাত পণ্য রুচিশীল ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে।
মোইরাং!-এর উদ্যেশ্য
১. সত্যিকারের মণিপুরি তাঁতশিল্পজাত পণ্য ক্রেতা সাধারণের নিকট সহজলভ্য করা।
২. ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের মাধ্যমে মণিপুরি তাঁতশিল্পীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সঞ্চায়ক ভূমিকা রাখা। মউরাং-এর উৎপাদিত তাঁতশিল্পজাত পণ্যের বৈশিষ্ট
১. সকল প্রকার পণ্য উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে আমাদের দক্ষ একদল কর্মী দ্বারা যথাযথভাবে মনিটরিং করা হয়। যার ফলে পণ্যের সঠিক মান নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
২. বর্তমান বাজারে প্রাপ্ত মণিপুরি তাঁতশিল্পজাত পণ্য সমূহের অধিকাংশই পলেস্টার বা টেট্টন সুতা দিয়ে তৈরি। কিন্তু আমাদের মোইরাং থেকে উৎপাদিত সকল পণ্যই শতভাগ (১০০%) সুতির সুতা দিয়ে তৈরি হওয়ায় সকল ঋতুতে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার উপযোগী।
৩. বর্তমান বাজারে প্রাপ্ত সাধারণ পণ্যের পরিমাপের তুলনায় আমাদের উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যের পরিমাপ সঠিক ও যথাযথ মানসম্পন্ন হওয়ায় তা ব্যবহারে অধিক আরামদায়ক। সুতরাং মোইরাংয়ের মাধ্যমে মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প থেকে উৎপাদিত সঠিক মণিপুরি পণ্য ক্রয় করে এবং মণিপুরি নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন