এম এ খালেক : কাজলীর (৩০) আনন্দের সীমা নেই। ঘরে বসে স্বামীর পাঠানো টাকা পেতে এখন আর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শহর থেকে স্বামীর পাঠানো টাকা মুহূর্তের মধ্যেই নিরাপদে তার হাতে চলে আসছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। কাজলীর স্বামী বরিশালে চাকরি করেন। প্রতি মাসে বাড়ি আসা সম্ভব হয় না। তিনি মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে স্ত্রীর কাছে বেতনের টাকা পাঠাতেন। কিন্তু এতে অসুবিধা হচ্ছিল। যাদের মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন প্রায়শই তারা কাজলীর কাছে টাকা ধার চাইতেন। তখন তিনি বেশ অসুবিধায় পড়তেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের আশায় কাজলী স্থানীয় একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলেন। কিন্তু সেখানেও নানা অসুবিধা হচ্ছিল। ব্যাংকের শাখাটি ছিল তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যাংকে যাতায়াত করতে বেশ সময়ের প্রয়োজন হতো। ব্যাংকে গিয়ে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হতো। এছাড়া ব্যাংকে আসা-যাওয়ার জন্য অর্থ ব্যয় হতো। উপরন্তু একবার ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে বাড়ি আসার পথে তার টাকা ছিনতাই হয়ে যায়। একদিন পার্শ্ববর্তী বাড়ির মলি ভাবি কাজলীকে পরামর্শ দেন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য। মলি ভাবি কাজলীকে মোবাইল ব্যাংকিং সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিলেন। স্থানীয় এক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের কাছে গেলে তিনি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা-অসুবিধা কাজলীকে বুঝিয়ে বলেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, এক কপি ছবি এবং একটি মোবাইল নাম্বার দিলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাজলীর নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া হয়। এখন কাজলী মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তার স্বামীর প্রেরিত টাকা খুব সহজেই উত্তোলন করতে পারছেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে মোবাইল ব্যাংকিং সাম্প্রতিক সময়ের এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং চালু করা হয়। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল। ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী। মোবাইল ব্যাংকিং অত্যন্ত সহজ এবং ঝুঁকিমুক্ত বলে তা সাধারণ মানুষের মাধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে মোট ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হাত বদল হয়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট ৭ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তা ১১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। একই বছর ডিসেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৬ হাজার ১২৫ কোটি টাকা হাত বদল হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে প্রতি মাসে গড়ে ১৩ হাজার ১৪৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা হাত বদল হয়। ২০১৪ সালে এটা ছিল গড়ে ৮ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রæত বিকশিত হচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগে শহর থেকে গ্রামে অর্থ সঞ্চালিত হতো। আর এখন গ্রাম থেকে শহরে অর্থ যাচ্ছে। গ্রামের মানুষের হাতে এখন প্রচুর অর্থ যাচ্ছে। সেই অর্থ তারা নানা ধরনের ভোগ্য পণ্য ও বিলাসজাত পণ্য ক্রয় এবং শহরের শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ করছে। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিটেন্স। এছাড়া গ্রামীণ নারীরা শাকসবজি চাষ, ছাগল পালন, গবাদিপশুর খামার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২০১৫ সালে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ দেশে প্রেরণ করেছে। এই অর্থ প্রথমে শহরে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আসে। তারপর সেখান থেকে মোবাইল ব্যাংকিং এবং অন্যান্য মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে অবস্থানরত স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিদের কাছে পৌঁছে যায়। গত বছর দেশে ৩ দশমিক ১৯ কোটি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট ছিল। প্রতি বছর মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের সংখ্যা গড়ে ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সাহায্যে আর্থিক লেনদেন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বিল, ফিস এবং চার্জ প্রদান করা যায়। যেমন, টেলিফোন বিল, গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ইত্যাদি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রদানের সুযোগ রয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টগণ এসব বিল মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সাহায্যে প্রদান করছে।
২০১৫ সালে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে আর্থিক লেনদেন হয় তার মধ্যে ২৭ হাজার ৮৭৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা লেনদেন হয় ব্যক্তি পর্যায়ে। যা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট লেনদেনকৃত অর্থের ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ব্যবহারের সহজীকরণের কারণে এটা অত্যন্ত দ্রæত সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। ইউএসএআইডি তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিশ্বের নিবন্ধিত মোট মোবাইল অ্যাকাউন্টের ৮ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশের অধিকারে রয়েছে। বাংলাদেশ ২০১১ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। মাত্র ৫ বছরের মধ্যে এটা বিশ্বের শীর্ষস্থান দখল করেছে। এ পর্যন্ত মোট ২৮টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি লাভ করেছে। এরমধ্যে ২০টি ব্যাংক ব্যবসায় পরিচালনা করছে। শীর্ষ স্থানীয় দু’টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং বাজারের ৯০ শতাংশ দখল করে আছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের একটি বড় অবদান হচ্ছে এর মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আগে যারা বেকার ছিলেন তাদের অনেকেই এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান করেছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন এর মাধ্যমে প্রেরিত টাকা ভুল নাম্বারে গেলে সেই টাকা উদ্ধার করা বেশ কঠিন। এছাড়া সন্ত্রাসীরা তাদের আর্থিক দুর্বৃত্তায়নের কাজে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আশ্রয় নিতে পারে। যে কোনো ধরনের অবৈধ আর্থিক লেন-দেন মোবাইল ব্যাংকিং এ সম্পাদিত হাতে পারে। তবে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ও মোবাইল ব্যাংকিং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সহজ এবং গতিশীল করেছে।
মোবাইল ব্যাংকিং অত্যন্ত সহজ এবং স্বল্প খরচবাহী ক্যাশ মুদ্রা ট্রান্সফার পদ্ধতি। এর মাধ্যমে একবারে ১০ হাজার টাকা এবং বছরে একক অ্যাকাউন্ট থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রেরণ করা যায়। প্রতি হাজার টাকা প্রেরণ করতে ব্যয় হয় মাত্র ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। অন্য কোনো মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো এত সহজে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টাকা প্রেরণ করা যায় না। এটা সহজে পরিচালনাযোগ্য একটি পদ্ধতি। অন্য যে কোনো পদ্ধতিতে টাকা লেনদেন করার চেয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করা কম ঝুঁকিপূর্ণ। তাই দিন দিন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে গ্রামীণ নারীরা এর সুফল পাচ্ছে।
(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন