শাহনাজ পলি : নারী-পুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা’ এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী পালিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর সমঅধিকার আর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী পথ পরিক্রমণে বাংলাদেশের নারীরাও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, পুলিশ প্রশাসন, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃতে আছেন নারী। এবারে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পাঁচজন সফল নারীকে সম্মাননা দিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে তাদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয়। সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জকারী শার্লি মেশৈ প্রæ, শিক্ষা ও চাকরিতে হোসনে আরা, সফল জননী হিসেবে ফিরোজা বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন জীবন গঠনে মর্জিনা বেগম ও সমাজ উন্নয়নে আরিফ ইয়াসমিন ময়ূরী। প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, মেয়েদের বিয়ে ১৮ বছরের নিচে হবে না। ১৮ বছরের নিচে কারো বিয়ে হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে উত্তরাধিকারে, সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাসের সামনে ৯ তারিখ সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত মানববন্ধনের আয়োজন করে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র। এছাড়া সকল গণমাধ্যমে সাংবাদিকতায় নারীদের নিয়োগদান, তাদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন, যৌন হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পেশাজীবী নারী সমাজের সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম, বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের নীলুফার বানু, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু, কোষাধ্যক্ষ আকতার জাহান মালিক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক শাহজাহান মিয়া, সিনিয়র সাংবাদিক সেলিম সামাদ ছাড়াও বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সদস্যরা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে নারীর অবস্থান শীর্ষক সেমিনারে একথা বলেন প্রধান তথ্য কমিশনার বেগম কামরুন নাহার। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট নিজ কার্যালয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করে। দেশের সকল গণমাধ্যমে নিয়োগ বিধিমালা থাকা জরুরী। এটি না থাকলে যখন তখন চাকরি চলে যাওয়ার পরিস্থিতি থেকে সাংবাদিকরা রেহাই পাবে না বলেও জানান তিনি। সাংবাদিকতা অত্যন্ত মহান পেশা। এটাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার) শাহজাদী আঞ্জুমান আরা বলেন, বর্তমানে সরকার সম্প্রচার নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে সকলেই পরামর্শ দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারে। সবার পরামর্শ পেলে নীতিমালাটি সমৃদ্ধ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহ. অধ্যাপক শবনম আজিম বলেন, মনে হয় যে নারী সাংবাদিকরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাস্তবে নারী সাংবাদিকরা সংখ্যায় অনেক কম, অনেক খারাপ অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার প্রায় ৫শ নিউজের মধ্যে দেখা যায় যে, ১১৭টি নিউজে পুরুষ রিপোর্টারের বাইলাইন (নিজ নামে) ছিল, সেখানে নারীর ছিল ৩টি বাইলাইন। সংবাদে নারী উপস্থাপিত হয়েছে ১৪ শতাংশ আর পুরুষ উপস্থপিত হয়েছে ৮২ শতাংশ। বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, অবশ্যই ৩৩ শতাংশ নারীর গণমাধ্যমে কাজ করা নিশ্চিত করতে হবে। যৌন হয়রানি বন্ধে কার্যকরী কমিটি থাকতে হবে। গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য অবশ্যই নীতিমালা থাকতে হবে। বিশেষ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেন নারীরা কাজ করার সুযোগ পায় এর জন্য কোটা বেঁধে দিতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র, পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা, সকল প্রকার হয়রানি বন্ধ করে কাজের সুন্দর পরিবেশ রাখার দাবী করেন। সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নী বলেন, জাতীয় প্রেসক্লাবে নারী সদস্য মাত্র ৭২ জন, পুরুষ ১২৫২ জন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে নারী ২১৫ জন প্রায়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ১৫শর মধ্যে মাত্র ১০৪ জন নারী। ২০০ গণমাধ্যমের সম্পাদক মাত্র ৬ জন নারী। যারা মালিকানা সূত্রে সম্পাদক। ২৮টি টিভি চ্যানেলের ১ জন হেড অব নিউজ নারী, ১ জন চিফ নিউজ এডিটর ও ১ জন বার্তা সম্পাদক নারী- এই পরিসংখ্যানগুলোই বলে দেয় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারীর অবস্থান কোথায়? বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকরা নারীদের নিয়োগ দিতে চান না। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক শাহানা শিউলি বলেন, কুড়িগ্রামের সাংবাদিক লাইলী বেগম এবার সাংবাদিকতায় রাঁধুনী কীর্তিমতি সম্মাননা পেয়েছে। এখনও যেসব নারী এই পেশায় আসতে চায় তাদের আমাদেরই সুযোগ করে দিতে হবে। এসময় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক শাহ আলমগীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে গত বুধবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের উদ্যোগে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। র্যালি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন প্রাঙ্গণে সমাপণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ। ঢাকার বাইরেও দিবসটি যথাযথভাবে পালিত হয়। নারী-পুরুষের সমতা উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা এই ¯েøাগান কে সামনে রেখে জয়পুরহাটের কালাইয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস এর র্যালি ও আলোচানা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার আয়োজনে বুধবার সকাল ১০.৩০ মিনিটে উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে র্যালি বের হয়ে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে গিয়ে শেষ হয়। নানা আয়োজনে বান্দরবানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে। গত বুধবার এ উপলক্ষে জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বর থেকে সকালে বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। র্যালিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা অংশ নেয়। র্যালিটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে জেলা প্রশাসনের মুক্তমঞ্চে আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক। সারা দেশের ন্যায় রাজশাহীর পবায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে। ৮ মার্চ বুধবার বেলা ১১টায় উপজেলা চত্বরে র্যালি ও হলরুমে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বেগম খায়রুন্নেছা এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড ভিশন পবা এডিপি ম্যানেজার ডায়মন্ড জেস্পার ঘাগ্রা। এ সময় স্বাগত বক্তব্য রাখেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হুসনা লাইলা। দিবসটি উপলক্ষে গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) নারী বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা শোভাযাত্রা বের করেন। বিএআরআইয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি ক্যাম্পাসের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ শেষে প্রশাসনিক ভবনের সামনের চত্বরে শেষ হয়। এরপর সেখানে আলোচনা সভা হয়।
মানিকগঞ্জ জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে জেলা শহরে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। নারী অগ্রগতির পাশাপাশি নারীর প্রতি বৈষম্য আর নির্যাতন, অবিচার, অত্যাচারের চিত্রও কম চোখে পড়ে না। থামলে তো চলবে না, এগিয়ে যেতেই হবে। যা কিছু করতে হবে তা দৃঢ়তা নিয়েই করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন