মুহাম্মদ কামাল হোসেন : ‘মা’। অতি ক্ষুদ্র একটি শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা আর বিশালতার কাছে না আটলান্টিক না প্রশান্ত, বিশ্ব জগতের আর কোনো কিছুই তুলনীয় নয়। আবেগ, ভালোবাসার এক অফুরন্ত ভান্ডার মা। অপার নেয়ামতও বটে। মায়ের নিখাঁদ ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কাছে জাগতিক সব কিছুই তুচ্ছ ও অর্থহীন। যে মাকে ভালোবাসে না, যত্ম-আত্তি নেয় না, তাকে মানুষ তো নই, কোনো চতুষ্পদ পশুর সাথেও তুলনা করা অন্যায্য হবে। রীতিমতো অন্যায়ও বলা চলে। কারণ সৃষ্টিক‚লে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য পশুপাখির মধ্যে মাতৃত্ব ও মাতৃস্নেহ প্রবল। পশুক‚লে যেমন কুকুরের দিকেও যদি আমরা তাকাই, বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যাবে। অধম এ প্রাণীটিও এক সাথে প্রসব করা তার ডজনখানেক সন্তানদের জন্য স্নেহ-ভালোবাসার ঢালি খুলে বসে। বাচ্চারাও মাতৃস্নেহে বিভোর হয়ে সারাক্ষণ মায়ের পিছে পিছে ঘুর ঘুর করে। মায়ের হুকুম অমান্য করে কোনো অযাচিত বিপদ-আপদ ডেকে আনে না। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও একটু পরিষ্কার হবে। পক্ষীক‚লে যেমন বাবুই পাখি কিংবা চড়ুই পাখির কথা ধরা যাক। সন্তান বাৎসল্যে প্রগাঢ় ভালোবাসার এতটুকু কমতি নেই। কত আদর যতœ ও পরম মাতৃত্ব উপছে উপছে পড়ে। ছা-হারা মুরগির কী দশা হয়, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দুনিয়া ফানা করে তুলে। ছিও ছিও শব্দে অস্থির হয়ে ওঠে। পাগলপাড়া হয়ে ওঠে। এসবের মধ্যে সৃষ্টির নিগূঢ় সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটে। নির্ভেজাল স্নেহ-মায়া-মমতার অপূর্ব নিদর্শন দেখা যায়। কোন কমতি দেখা যায় না। পৃথিবীতে কালে কালে যুগে যুগে এভাবে সন্দেহাতীতভাবে এটা প্রমাণিত হয়ে আসছে। মায়ের স্বার্থহীন ভালোবাসায় কোনো কালিমা নেই। নেই কোনো খেদ। নিজে না খেয়ে মা খাওয়ায়। নিজের সকল সুখ, শান্তি, শখ-আহ্লাদ ত্যাগ করে স্বীয় সন্তানের অনাগত সুখ-সমৃদ্ধির জন্য অকাতরে বিলীন হয়ে যায়। হরওয়াক্ত তথা সব সময় সন্তানের কিসে ভালো হবে, কিসে মঙ্গল হবে সেই ভাবনা চিন্তায় বিভোর থাকে। নিজের জীবন থেকেও সন্তানকে বেশি ভালোবাসে। শুধু তাই নয়, দুরারোগ্য কোন ব্যাধিতে সন্তান আক্রান্ত হলে মা নিজের জীবনের বিনিময়ে সন্তানের আয়ুষ্কামনা করেন। গগনবিদারী আর্তনাদে খোদার আরশ ছেদিয়া ওঠে। সন্তানের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দেন। দেখার মতো চোখ থাকলে, ঠিক দেখা যায়। মায়ের ঔরসে জন্ম নিয়েও আজকাল অনেকে মায়ের সঠিক দেখভাল না করে নিরন্তর অযতœ-অবহেলা করে যাচ্ছে। মায়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলছে। চোখ রাঙাচ্ছে। ধমকি-ধামকি করছে। কখনও কখনও সীমার সর্বস্ব লঙ্ঘন করে জন্মদাত্রী মাকে মারধর করছে।
ওই ধরনের তথাকথিত দো-পেয়ে ভেক ধরা মানুষদের কোনো পশুও গ্রহণ করবে না। বিনয়ের সাথে বলবে,
-‘সরি, ওরা আমাদের দলভুক্ত নয়।’ পশুরাও তাদেরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে। মাকে প্রগাঢ় নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জগতের সমস্ত সুখ-শান্তি, সুষমা ও প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত আছে। ‘মা’ মা-ই। জাগতিক কোনো কিছুর সাথে কখনও তুলনীয় নয়। যদিও আজকাল সমাজে অনেক বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। আধুনিকতার ধব্জাধারী প্রগতিশীল দাবিদার সমাজের উঁচু স্তরের শিক্ষিত মানুষগুলো বৃদ্ধ মাকে হোমে বা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে বাসায় সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে প্রাচুর্যময় বিলাসী জীবনযাপন করছে। অর্থ, বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তুলছে। দাস-দাসী চাকরানি নিয়োগ করছে স্ত্রীর ফুটফরমায়েশ খাটানোর জন্য। স্ত্রীকে খুশি রাখার নিমিত্তে ক্ষণে ক্ষণে শপিংয়ে যাচ্ছে, নামিদামি রেস্তোরাঁয় ডিনার করছে, সিনেমা দেখছে। নতুন নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি গিফট করছে... আরও কত কী? মাসে দু-দুবার বিউটি পারলারে যাচ্ছে। জিম আর ডায়েটের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছে। শুধু সুন্দরী স্ত্রীকে তুষ্ট রাখতে, মন জোগাতে সব করে বেড়াচ্ছে। আর ওইদিকে অসহায় বৃদ্ধ মাতা মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে পাষÐ ছেলের জন্য চোখের জলে ঝার ঝার করে বুক ভাসাচ্ছে। ছেলের পথ পানে চেয়ে চেয়ে বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। এই বুঝি ছেলেটা ফিরে এলো! কিন্তু ছেলে একটিবারের জন্যও ফিরে আসে না। বিবেকের কষাঘাতে ছেলেটি একটুও দগ্ধ হয় না। বৃদ্ধ মায়ের জন্য সামান্যতম সমব্যথী হয় না। পদ্মা, মেঘনা ও বুড়িগঙ্গার জল শুকিয়ে শেষ হয়ে যায়, বৃদ্ধ মা’র চোখের নোনা জল শেষ হয় না। দুই চোখে সাগর ধারা নেমে আসে। বহমান ¯্রােতধারা নিরন্তর ক‚ল ক‚ল শব্দে বহে চলে। এ সমাজ বিলকুল ক্ষয়ে গেছে। নীতি-নৈতিকতা, শিষ্টাচার, ও ভদ্রতা সহবতের বড়ই আকাল। এসব নেই বললেই চলে। অনেকটা কাজীর গরুর মতো। কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, স্বেচ্ছারিতায় সর্বত্র আজ ছেয়ে গেছে।
মানবতার বদলে পশুবাদ ভর করেছে। হিং¯্রতায় একাকার হয়ে গেছে সর্বত্র। আগেরকার ঐতিহ্যময় একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এখন আশেপাশে কয়েক গ্রাম চষে বেড়ালেও একটা যৌথ পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভেঙেচ‚রে খান খান হয়ে গেছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবারগুলোতে শান্তি নেই। প্রাণ খোলা হাসি নেই, আনন্দ নেই। রাতের আঁধারের সাথে সাথে সর্বত্র নিকষ কালো অন্ধকার নেমে আসে। অথচ তখন মা ছিল পরিবারের মধ্যমণি ও মুখ্য ভ‚মিকায়। পরিবারের চাবিকাঠি তথা নেতৃত্বভার ছিল মায়েদের হাতে। সবাইকে একই ছাদের তলায় স্নেহ, ভালোবাসা ও যতœআত্তি দিয়ে আগলে রাখতেন। সকলের প্রয়োজন সাধ্যমতো মেটাতেন। কখনো কারও কোনো উচ্চবাক্য থাকত না। নতমস্তকে সকলে মেনে নিত। বিশ্বাস, ভক্তি, শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় সকলে তাকে মাথায় তুলে রাখত।
অথচ আজ মাকে আমরা যোগ্য স্থানে না রেখে সকল কিছু ঘরের স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছি। বিনিময়ে মাকে অযতœ-অবহেলায় রাখছি। অথচ আমাদের ইসলাম ধর্মেও সন্তান কর্তৃক মায়ের এক এক করে তিনগুণ খেদমতের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে একাধিক জায়গায় এ বিষয়ে আলোকপাত করা আছে। ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’Ñ রাসূল (সা.) মুখ নিসৃত পবিত্র বাণী হাদিসে উল্লেখ আছে। বুক ফুলিয়ে সমাজে নিজেকে সৎ মানুষ, শিক্ষক, প্রফেসর কিংবা মুফতি, সুফি, জবরদস্ত ওলী হিসেবে ঢাকঢোল পিটিয়ে গলাবাজির পূর্বে, একবার অন্তত নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুনÑ ঘরে বৃদ্ধ মা’র ন্যায্য হক আদায় হচ্ছে তো? এ শীতে এখন পর্যন্ত একবারের জন্য মা’র কোনো খোঁজখবর নিয়েছেন? অথচ শীত প্রায় চলে যাচ্ছে। জানতে চেয়েছেন মা কী পছন্দ করে, খেতেইবা কী চায়? কিংবা কখনো দরদমাখা হৃদয়ে উপলব্ধি করেছেনÑ মা কোনো দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে না তো? পুরাতন কোনো রোগব্যাধিতে বিনিদ্র রজনী কাটছে না তো? ওষুধ-পত্র ও নাওয়া-খাওয়া ঠিকঠাক মতো চলছে তো? চতুর্দিকে আজকাল অহরহ শোনা যায়, শিক্ষিত নামদারী মুখ ও মুখোশের আড়ালে সমাজের উঁচু স্তরের ওই মানুষগুলোই মাতার সাথে সবচেয়ে বেশি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।
মাকে অশ্রদ্ধা অপমান ও লাঞ্ছনা করছে। ঠিকমতো সেবা, যতœআত্তি করছে না। মাকে মা বলে ডাকছে না। পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এসব ঘটনাপ্রবাহ নিত্য দেখা যায়। বৈশ্বিক যুগে এখন কোনো ঘটনাই আর চাপা পড়ে থাকে না। মুহূর্তে চাউর হয়ে যায়। মুঠোফোন আর ইন্টারনেটের বদৌলতে এসব খবর পৌঁছে যায় মানুষের হাতে হাতে। তাই আসুন, বারবার প্রশ্ন করুন স্বীয় বিবেককে। জাগ্রত করার চেষ্টা করুন। সবকটা দ্বার ঠাস ঠাস করে খুলে দিন। একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। কী হওয়া উচিত আর কী হতে চলেছে। বিবেক আপনাকে সঠিক পথে চালিত করবে। অতীত ভুলের জন্য মায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই মা আপনাকে ক্ষমা করে সেকেন্ড বুকে টেনে নেবে। এ বিধিবদ্ধ জীবনে আমরা প্রত্যেকে এ সতর্কীকরণ মেনে চলতে ক্ষতি কী? কলিজার টুকরো মাতার সঙ্গে বিমাতা সুলভ আচরণ আর নয়। কোনো দুঃখ-কষ্ট, অবহেলা নয়। তারপরে... প্রমাণ হবে আমি-আপনি কতটা ভালো... কতটুকু সৎ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন