মুর্তজা বশীর এবং তার শিল্পকর্ম
হা মী ম কে ফা য়ে ত : রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একবার কিছু কাজ করেছিলাম। সেই সময়টাতে শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিলো। শিল্পীর বাসায় যেতাম। শিল্পী ও শিল্পবোধ নিয়ে বিচিত্র রকমের আলাপ হতো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলে বসলেন- ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত কোনো গান হলো? আমি তো শুনি জ্যাজ!’
আবুল কালাম শামসুদ্দীন একবার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে বলেছিলেন- আপনি তো শিক্ষিত-সচেতন মানুষ, আপনি এতোগুলো সন্তান নিলেন কেনো?’ উত্তরে ড. শহীদুল্লাহ বলেছিলেন- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি অনেকগুলো সন্তান না নিতেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথ হতেন না। আমি যদি এতোগুলো সন্তান না নিতাম, তাহলে মুর্তজা বশীর হতো না।’
প্রথম জীবনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সন্তান মুর্তজা বশীরের শিল্পীজীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার ধারনা বদলাতে থাকে। উনসত্তরে ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণের আগ পর্যন্ত তিনি একনিষ্ঠভাবে সন্তান মুর্তজা বশীরের শিল্পজীবনকে প্রবলভাবে সমর্থন দিয়ে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তার লাইব্রেরীর গুরুত্বপূর্ণসব শিল্পগ্রন্থ সন্তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পিতার পরিচয়টি জীবনের ধাপে ধাপে মুর্তজা বশীরকে মিশ্র সংশ্রব দিয়েছে। আর্ট কলেজে ভর্তির সময়ও এ পরিচয়টি তার উপকারে আসে, শিল্পাচার্য তাকে আলাদাভাবে সমীহও করতেন। তবে মুর্তজা বশীর সবসময় নিজের পরিচয়ে বড়ো হতে চাইতেন। কখনোই তিনি পিতার পরিচয়ে দাড়াতে চাননি।
ক’দিন পর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬-এর ২৮ মে তিনি পরলোকগত হয়েছিলেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য বিরাট শোকের ব্যাপার ছিলো। শিল্পকলাসংশ্লিষ্টরা ভেঙে পড়েছিলো। সেই সময়ে শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেছিলেন- ‘শিল্পাচার্যের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই, এখন তার দেহান্তর ঘটেছে মাত্র।’
মুর্তজা বশীরের সেই মন্তব্যে বিরাট ধাক্কা খেয়েছিলো শিল্পকলার মানুষেরা। তবে এই ধাক্কাটা ক্রমাগতভাবে বেঁচে আছে আজো। শিল্পাচার্যকে যারা শিল্পসংগঠক মনে করে তাদের কাছে এটি বিরাট ধাক্কা মনে হলেও যারা তাকে শিল্পী মনে করে, তাদের কাছে এ ধাক্কাটা পর্বতসম। শিল্পাচার্যকে যারা সাংগঠনিক তৎপরতার ভেতর দিয়ে মাস্টার পেইন্টার হিসেবে প্রদর্শন করতে চান, তারা অন্যদের চেয়ে একটু বেশী মর্মাহত হয়েছিলেন সেদিন।
সমালোকরা এখানে টেনে নিয়ে আসেন ভিন্ন একটি বিষয়। মুর্তজা বশীর আর্ট কলেজের অনেক মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও শিল্পাচার্য তাকে চারুকলায় চাকরি দেননি। মুর্তজা বশীরের চেয়ে কম-উত্তীর্ণ ছাত্রদের ঠিকই চাকরি দিয়ে জয়নুল আবেদীন। এই প্রসঙ্গটির সঙ্গে সমালোকরা মুর্তজা বশীরের মন্তব্যটি মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়।
অথচ মুর্তজা বশীরকে কেনো, এসএম সুলতানকে কাজে লাগাননি শিল্পাচার্য। আবদুর রাজ্জাক কর্তৃক ভাস্কর্য বিভাগ খোলারও অনেক বছর আগে ভাস্কর নভেরা এ বিভাগ খুলে কাজ করতে চেয়েছিলেন, সেটি হতে দেননি শিল্পাচার্য। এ নিয়ে শিল্পকলার সমালোচকরা কতো ক্ষুব্ধ, কতোটা বিক্ষুব্ধ, এটি পরিমাপ করা সহজ নয়।
চারুকলার বাইরে মুর্তজা বশীরের বহুমুখী কাজ ও তৎপরতা সবসময় আলোচনায় ছিলো, সমালোচনায়ও ছিলো। নিরব-নিথর-শব্দহীন শিল্পজীবন কখনোই যাপন করেননি মুর্তজা বশীর। ভাষা আন্দোলন, গল্প-কবিতা-উপন্যাস, মুদ্রা গবেষণা, চলচ্চিত্রসহ বিচিত্র সময়ের ভেতর দিয়ে এখন অশীতিপর জীবন অতিবাহিত করছেন এ শিল্পী। জীবন যেদিকে ডেকেছে, সবসময় সারা পেয়েছিলো তার। এতো বহুমুখী বিষয়ে বহুমুখী বিচিত্র কাজ মুর্তজা বশীরকে আলিঙ্গন করে রেখেছিলো দীর্ঘকাল। শিলী হিসেবে হোক আর শিক্ষক হিসেবে হোক, প্রধানত চারুকলাই ছিলো মুর্তজা বশীরের প্রধানতম সঙ্গী ও স্বর্গ।
এখন মুর্তজা বশীরের বয়স ৮৪। যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত শিল্পতৎপরতার ভেতর দিয়ে সজীব ছিলেন তিনি। কিন্তু বয়স আশি পেরিয়েই তিনি নানাভাবে শারীরিক দিক দিয়ে আক্রান্ত হতে থাকেন। বছরেরও বেশি সময় ধরে অক্সিজেনের পট সাথে নিয়ে তাকে চলাফেরা করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে তার জীবনসঙ্গিনী আমিনাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রীর অসুস্থতাকালীন পুরো সময়টা তিনি নিজে অসুস্থ হওয়া সত্তে¡ স্ত্রীর শুশ্রæষা চালিয়ে আসছিলেন। স্ত্রীকে ডাক্তারি পথ্য খাওয়ানো, হাসপাতালে আনা-নেওয়া, সবকিছুতেই তিনি স্ত্রীর পাশে থেকে সশরীরে দেখভাল করছিলেন।
গেলো সপ্তাহে স্ত্রী প্রচÐরকম অসুস্থ হয়ে আইসিসিইউতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি সশরীরে থেকেছেন। এই অবস্থায়ই তিনি ঢাকার অভিজাত চিকিৎসাকেন্দ্র অ্যাপোলো হাসপাতালে লিফটে আটকা পড়েন, দেড় ঘন্টার পর তাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে আইসিসিইউতে রাখা হয়। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যখন আইসিসিইউতে, তখন তার স্ত্রী আমিনা বশীর শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন গত শনিবার সকালে। স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ শিল্পী কখন জেনেছেন, আদৌ জেনেছেন কিনা, জানা নেই। সুস্থ হয়ে মহান এ শিল্পী আবার রঙতুলি নিয়ে ক্যানভাসে মনোনিবেশ করুক, সে কামনাই করছি।
লেখক : শিল্পসমালোচক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন