লো ক মা ন তা জ : চিঠি শুধু সংবাদ-বাহন নয়, ব্যক্তিমানসের পরিচয় তুলে ধরে। চিঠি ব্যক্তির রুচি ও চিন্তার সন্ধান দেয়। চিঠির মাধ্যমে একজন লেখককে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়া যায়। যে অন্তরঙ্গরূপ লেখকের জীবনী ও স্মৃতিচারণাও পাওয়া যায়। প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসংখ্য চিঠি লিখেছেন। চিঠির মর্ম উদঘাটনে ব্যক্তি নজরুলের মানস অন্বেষণ সহজ হয়ে উঠে। নজরুলের চিঠি কিছু পত্রিকার ও প্রকাশনার সম্পাদককে লেখা। কিছু চিঠি বন্ধুদের লেখা। কিছু চিঠি ভক্ত-অনুরাগীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন কবি। কয়েকটি চিঠি নজরুল অগ্রজ-সম্বন্ধীয় ও প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। নজরুল সৈনিক জীবনে থাকাকালীন ঊনপঞ্চাশ নং বাঙালি পল্টন থেকে লেখা পাঠাতেন পত্রিকা অফিসে। নজরুলের প্রথম পাঠানো লেখা ছিলো ‘ক্ষমা’ শিরোনামে একটি কবিতা। কিন্তু ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও কবি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক কবির এই কবিতার নাম পাল্টে ‘মুক্তি’ শিরোনামে প্রকাশ করেন। এরই খোঁজ খবর নিতে গিয়ে এবং পরবর্তীতে একটি দীর্ঘ গল্প পাঠিয়ে কবি চিঠি লেখেন। এ চিঠিতে কবি সম্পাদকের সহযোগিতা চেয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘আপনার এরূপ উৎসাহ বরাবর থাকলে আমি যে একটি মস্তবর কবি ও লেখক হবো, তা হাতে কলমে প্রমাণ করে দিবো, এ একেবারে নির্ঘাৎ সত্যি কথা।’ চিঠিতে নজরুল সম্পাদক-এর নিকট সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, আপনারা যে ‘ক্ষমা’ বাদ দিয়ে কবিতাটির ‘মুক্তি’ নাম দিয়েছেন, তাতে আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। এই রকম দোষগুলি সংশোধন করে নিবেন।’ বিনা সঙ্কোচে নজরুল তার লেখার ত্রæটি সংশোধন মেনে নিয়ে নিজেকে নির্মাণ করেছেন কালজয়ী রূপে। ১৯ ডিসেম্বর ১৯২০ সালে দেওঘর থেকে শ্রী পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে খেলা চিঠিতে নজরুলের কৌতুকপ্রিয়তা ফুটে উঠে। নজরুল লেখেন, ‘ভো ভো লিওঁ মশিয়েঁ। গতকাল শুভ দিবা দ্বিপ্রহরে অহম্ দানবের এই দেওঘরেই আসা হয়েছে .............তোর পীড়িত দধি-লুব্ধ মার্জার- নজর্’’। কবি তার চিঠিতে বিভিন্ন জনকে টাকা পাঠানোর অনুরোধ, অনুযোগ লক্ষণীয়। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে- মোহাম্মদ আফজাল-উল হক কিংবা আলী আকবর খান যেনো শিগগির টাকা পাঠায় তার তাগাদা দেখতে পাই। ১৯২২ সালের ২৮ মার্চ, আফজাল-উল হককে লেখা চিঠিতেও টাকা পাঠানোর তাগাদা। কবি ভাষ্যে, টাকা চাই-ই-চাই, ভাই। নইলে যেতে পারবো না।’ আবার ১৬ জুলাই ১৯২৫ সালে মাহফুজুর রহমানকে লেখা চিঠিতে পাই, ........বইয়ের টাকা আদায় হয়ে থাকলে পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেবে। বড্ডো দরকার পড়েছে টাকার।..’ এখানেও কবির অর্থ সঙ্কটের কাতরতা। ১৯২৬ এর অক্টোবর ব্রজবিহারী বর্মণকে লেখা চিঠিতে আবারও অর্থ সঙ্কট প্রাধান্য পেয়েছে। কবি এবার লিখেছেন, ‘আমিও আজ সকালে ফিরে এলাম যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, দৌলতপুর প্রভৃতি ঘুরে। টাকার বড্ড দরকার। যেমন করে পার পঁচিশটি টাকা আজই টেলিগ্রাফ মানি অর্ডার করে পাঠাও।’ নজরুল অর্থ উপার্জন করেছেন প্রচুর। কিন্তু অজানা কারণে তার অর্থ সঙ্কট ঘোচেনি কখনও। নজরুল আজীবনই বেহিসেবী ও উদাসীন ছিলেন। নজরুলের চিঠিগুলো তারই প্রকাশ বলে মনে হয়। হাবিবুল্লাহ বাহারের নানা বাড়িতে, চট্টগ্রাম থেকে ঘুরে আসার পর ছোট বোন শামছুন্নাহার মাহমুদকে নজরুল একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। নজরুলের এই চিঠিতে তার পারিবারিক স্নেহ-মমতার আকাক্সক্ষার কথা ফুটে উঠেছে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন