রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা রোধে নজরুল

| প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মা হ মু দ কা মা ল : নজরুলের ওপর এক সময় অভিযোগ ছিল তিনি বিশেষ সময়ের কবি। কিন্তু, আমরা এখন এমন অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি , যখন ধর্মের নামে খড়গের নিচে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিনিয়ত; আর এই সময়ে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে ভাবনার জন্ম দিয়েছে। নজরুল সকল ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে তাঁর অল্প জীবনের সাহিত্যে তিনি হিন্দু-মুসলিমের অপূর্ব সমন্বয় করেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়েই নজরুলের উত্থান। এই কবিতার মধ্যে বিদ্রোহ, প্রেম ও ধর্মীয় নানা অনুষঙ্গ পাশাপাশি আবস্থান করেছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা স্বকীয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মাত্র একুশ বছর বয়সে লেখা বিদ্রোহী কবিতাটি সেই সময়ে সর্ব মহলে আলোড়ন তুলেছিল। আমরা ভেবে বিস্মিত হই, তিনি লিখতে পেরেছিলেন এমন পংক্তি, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ চিহ্ন।’ একবার ভাবুন সেই সময়ের কথা। আমরা জানি, দেবতা ভৃগুকে নানা সময়ে শাস্তি দেয়ার কারণে তিনি মহাদেবের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। মহাদেবের নিদ্রার সুযোগে তিনি তার বুকে চড়ে লাফিয়েছিলেন। পূরাণের সেই বিষয়টি সাহসিকতার সাথে নজরুল কবিতায় ব্যবহার করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় প্রসঙ্গগুলোও কবিতাটিতে পাশাপাশি অবস্থান করেছে। লিখেছেন, ঈষান-বিষাণের ওংকার, ইস্রফিলের শিঙ্গা, মহাদেবের ডমরু-ত্রিশূল,অর্ফিয়াসের বাঁশি,বাসুকীর ফণা, পুরাণের এইসব বিষয়াদি। তিনি লিখেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণ তূর্য।’ আমরা বলতে পারি, এই কবিতার মধ্যে সামগ্রিকতা বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উঠে এসেছে।

তিনি বিদ্রোহের কবি, সাম্যবাদের কবি, প্রেমের কবি, ইসলামের কবি, শ্যামা সঙ্গীতের কবি এরকম যার যা সুবিধা সেভাবেই তাকে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এ কথা ঠিক উপর্যুক্ত সকল অভীধায় তিনি কবিতা ও গান রচনা করেছেন। মুসলিম এতিহ্য বিষয়ক কবিতা কামাল পাশা, খেয়াপারের তরণী, মহরম, শাত-ইল-আরব, আনোয়ার,কাব্য আমপারা, ঈদ মোবারক, ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম লিখেছেন পাশাপাশি স্বত:স্ফূর্তভাবে লিখেছেন হিন্দু ঐতিহ্য বিষয়ক কবিতা, আনন্দময়ীর আগমন, পূজারিণী, রক্তাম্বরধারিণী মা, আগমনী ও পূজা-অভিনয়। বিজয়া এবং হরপ্রিয়া নামে লিখেছেন দু’টো নাটক। লিখেছেন অজস্র ইসলমী গান ও শ্যামা সঙ্গীত। লিখেছেন বটে কিন্তু এর জন্য তাকে কম ধকল সহ্য করতে হয়নি। ইসলামী গান লেখার জন্য যেমন তৎকালের কট্রর হিন্দুত্ব বাদীদের যেমন তিনি রোষানলে পড়েছিলেন পাশাপাশি শ্যামা সঙ্গীত রচনার জন্য মোল্লা-মৌলবীদের কোপানলে পড়তে হয়েছে। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় তিনি এর জবাবও দিয়েছেন। মুনীর চেীধুরীর ভাষায় বলা যায়, নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের কবি, বিপ্লবের কবি, শান্তির কবি, সাম্যের কবি। তিনি প্রেম ও অপ্রেমের, হিংসা ও ভালোবাসার, মিলন ও সংঘাতের কবি। আস্তিকতা ও নাস্তিকতা, ধার্মিকতা ও অধার্মিকতা, ইসলাম ও অনৈসলাম সবই নজরুল-কাব্যে পাশাপাশি আবিস্কারযোগ্য। সব কিছু মিলিয়েই নজরুল ইসলাম কবি।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে কবীর চৌধুরীর ‘ মুসলিম রেনেসাঁ ও কাজী নজরুল ইসলাম‘ প্রবন্ধের কিছু অংশ উদ্ধৃত করি। “কোন সত্যিকারের মহৎ শিল্পীই কোন একটি সম্প্রদায়, জাতি কিংবা দেশের হন না। রমাঁ রোলা কি টলস্টয়, শেক্সপিয়ার কি গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথ কি নজরুল ইসলাম কোন বিশেষ বা সমাজের লোক নন-তাঁরা সমগ্র বিশ্বের এবং সমগ্র কালের। মহৎ শিল্পী তাঁর রচনায় বহু ধারার সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্টি বহু মানুষকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে। যে ধারা যাকে যে ভাবে প্রভাবান্বিত করে বা অনুপ্রাণিত করে তিনি সেই অনুপাতে গুরুত্ব দেন, তাঁর মূল্যবিচারে ও আলোচনায় সেই স্বীকৃতি প্রাধান্য পায়। কিন্তু খন্ডিত বিচারে সাবধান না হলে মূল্য বিকৃতির আশংকা থাকে।”
উপর্যুক্ত দুই বিখ্যাত লেখকের উদ্ধৃতি পাঠে আমাদের খুব সহজেই মনে হয় নজরুল ইসলাম কোনও বিশেষ ধারার কবি নন। আর সাম্প্রদায়িকতা বিষয়েও তিনি তার অবস্থানকে স্পষ্ট করেছেন তারই লেখ ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের নায়ক প্রমত্তর জবানীতে। নায়কের উক্তি এ রকম: আমার ভারত এ মানচিত্রের ভারত নয় রে অনিম। আমার ভারতবর্ষ- ভারতের এই মূক- দরিদ্র-নিরন্ন পর-পদদলিত তেত্রিশকোটি মানুষের ভারতবর্ষ! ..আমার ভারতবর্ষ মানুষের যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দন-তীর্থ, ওরে এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়, এ আমার মানুষের- মহামানুষের মহাভারত!”
মানবতার কবি নজরুল সেই গানই গেয়েছেন যেখানে হিন্দু-মুসলিমের সব বাধা ব্যবধান এক হয়ে গেছে। কিন্তু এক কি হয়েছে? এ বিষয়ে তিনিও সন্দিহান ছিলেন। সন্দিহান ছিলেন নিজেকে নিয়েও। তাঁর অল্প দিনের সাহিত্যপ্রদীপ নিভে যাবে তিনি তা বুঝতে পেরেছেলেন সম্ভবত। ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’ এই শিরোনামে ১৯৪১ সালের ৫ই এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত-জুবিলী উৎসবের সভাপতি হিসেবে জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন:- “যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে- আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় ক্ষমা করবেন-আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন,আমি কবি হতে আসিনি,আমি নেতা হতে আসিনি-আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানাহানি, জাতিতে-জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব- অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে,সঙ্গীতে,কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম-অসুন্দরকে ক্ষমা করতে,অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম-আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না,প্রতিষ্ঠা চাই না,নেতৃত্ব চাই না- তবু আপনারা আদর করে যখন নেতৃত্বের আসনে বসান,তখন অশ্রু সংবরণ করতে পারি না। তাঁর আদেশ পাইনি,তবু রুদ্রসুন্দর রূপ আবার আপনাদের নিয়ে এই অসুন্দর, এই কুৎসিত অসুরদের সংহার করতে ইচ্ছে করে। যদি আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূন্য থেকে অসময়েই নামতে হয়-তা’হলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সে নজরুল আনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। সেদিন আমাকে কেবল মুসলমানের দলে দেখবেন না-আমি যদি আসি, আসব হিন্দু-মুসলমানের সকল জাতির ঊর্ধ্বে যিনি একমেবাদ্বিতীয়াম্ তাঁরই দাস হয়ে।”
পরের বছরই কবি অসুস্থ হয়ে পরেন। ক্রমে ক্রমে বাকশক্তিহীন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সাহিত্য জীবন থেকে তার বিদায় আসন্ন। মাত্র ২২/২৩ বছরের লেখালেখিতে তিনি সব সময় মানুষের কথাই বলেছেন। অথচ বর্তমান সময়ে কিছু অমানুষের কারণে আমাদের জীবন-যাত্রা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। নজরুল তা কখনই চাননি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন