এ.টি.এম. রফিক, খুলনা থেকে : খুলনা জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু (৪২) ও তার দেহরক্ষী নওশের আলীকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকের এঘটনায় মিঠুর শ্বশুর ও অপর একজন দেহরক্ষী জখম হন। ফুলতলার নতুনহাটে মিঠুর বাসভবন সংলগ্ন মেসার্স মিঠু এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যক্তিগত অফিসের ভিতরেই এ ডবল হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। হত্যার প্রতিবাদে ও হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবিতে আজ শনিবার ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খুলনা মহানগর ও জেলায় হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। একই সাথে এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে চারদিনের শোক কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর পৌনে ১২টায় দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেসব্রিফিংয়ে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
প্রসঙ্গত্ব, ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল মিঠুর বড় ভাই দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবু সাঈদ বাদলকে। তারআগে, ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল তাদের পিতা ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেমকে। এলাকায় সর্বসাধারণের কাছে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা ও আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার কারণেই এই পরিবারটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৯টার দিকে সরদার আলাউদ্দিন মিঠু তার অফিসে বসে কয়েকজন দলীয় নেতাকর্মীকে নিয়ে মিটিং করছিলেন।কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেল যোগে গোয়েন্দা পুলিশের পোশাক ও হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র ৩/৪ ব্যক্তি নিরাপত্তা প্রহরীকে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। কক্ষেও গেটে থাকা লাইসেন্সকৃত শর্টগানধারী তার দেহরক্ষী নওশের আলী (৫০) কে গুলি করে দ্রæত কক্ষে ঢুকে মিঠুর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এসময় তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মিঠুর শ্বশুর ও উপজেলা বিএনপি নেতা সৈয়দ ফজলুল আলম সেলিম (৫৬) ও তার অপর দেহরক্ষী সিরাজ মোড়ল (৫১) জখম হন। তাদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় নওশের আলীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বাকিদের ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। নওশের আলী শুক্রবার মধ্যরাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। খবর পেয়ে শোকার্ত এলাকাবাসী তার অফিস ও বাসভবনের সামনে ভীড় জমায়। রাত সাড়ে ১১টায় খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ ও মোঃ নাঈমসহ উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে আসেন।
ফুলতলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আসাদুজ্জামান মুন্সী বলেন, দুর্বৃত্তরা ডিবি’র পোশাক পরিহিত ছিল কি-না সেটি নিশ্চিত না হলেও তাদের মাথায় হেলমেট ছিল। দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিত ও আকস্মিকভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। এঘটনায় সন্দেহজনকভাবে মোঃ ইমরুল শেখ নামের এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে। দাফনের পরনিহতের স্বজনরা বাদী হয়ে মামলা করবেন বলে জানান ওসি।
নিহত মিঠুর স্ত্রী, এক পুত্র এক কন্যা রয়েছে। নিহত মিঠুর মেঝ ভাই সেলিম সরদার বলেন, কোন ব্যক্তি আক্রোশের বিষয় নয়, উপজেলা ব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তাই একের পর এক পিতা ও ভাইদের খুনের কারণ। শুক্রবার প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর শাখার সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, চারদিনের কর্মসূচির মধ্যে গতকাল শুক্রবার সকল দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারন। আজ ২৭ মে শনিবার হরতাল চলাকালে বেলা ১১টায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে জেলা ও মহানগর বিএনপির যৌথ বিক্ষোভ সমাবেশ। একই দিনে খুলনা বিভাগের অপর ৯ জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে। আগামীকাল২৮ মে রবিবার বেলা ১১টায় দলীয় কার্যালয়ে শোক সভা ও দোয়া মাহফিল। আগামী ২৯ মে সোমবার মিঠু হত্যার বিচার দাবিতে ডিআইজি ও জেলা প্রশাসনকের মাধ্যমে সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ। এ সময়ের মধ্যে খুনীরা ধরা না পড়লে পরবর্তীতে আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাড. শফিকুল আলম মনা। উপস্থিত ছিলেন কেসিসি মেয়র ও মহানগর বিএনপির সাধারন সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি, কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম, অধ্যাপক ডাঃ গাজী আব্দুল হক ও আমীর এজাজ খান প্রমুখ।
প্রেস বিফ্রিংয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ও ঠান্ডা মাথায় খুনীরা ফুলতলা বিএনপি’র জনপ্রিয় নেতা সরদার আলাউদ্দিন মিঠু ও তার দেহরক্ষীকে হত্যা করেছে। কাছ থেকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর তারা অফিসের অভ্যন্তরে, সাইনবোর্ডে ও গেটে ক্রমাগত গুলি করেছে। তিনি বলেন, এরআগে খুনীরা মিঠুর পিতা উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেম ও তার ভাই অত্যন্ত জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান বাদলকে গুলি করে হত্যা করেছিল। এঘটনার আগেও একাধিবার মিঠুকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। তিনি প্রশ্ন রাখেন, একটি পরিবারের সকল সদস্যকে একের পর এক হত্যা করা হবে, আর খুনীরা মাথা উচু করে প্রকাশ্যে চলাফেরা করবে, এতো সাহস তারা পায় কোথা থেকে? সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের আশ্রয় প্রশ্রয় ছাড়া এটা সম্ভব নয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, কোন হত্যাকান্ড ঘটলেই আমরা পুলিশের তৎপরতা দেখতে পাই। মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসে। যানবাহনে তল্লাশি হয়। বøক রেইড হয়। অথচ মিঠুসহ ডাবল মার্ডার হওয়ার পরে আমার সারারাতেও ফুলতলায় বা খুলনায় পুলিশের কোন ধরনের তৎপরতা দেখলাম না। অভিযোগ রয়েছে, খুনীরা নাকি ডিবি লেখা পোশাক পড়ে মিঠুর অফিসে ঢুকেছিল। আর এখন খুনীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশ আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ। তাহলে কি এর মধ্যে কোন যোগসূত্র রয়েছে? সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের গুম খুন অপহরনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম আসছে অভিযোগ এসে তিনি এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত দাবি করেন। ফুলতলার একজন চরমপন্থী নেতা শাসক দলে যোগদানের পর থেকে মিঠু জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন বলেও সাংবাকিদের জানানো হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন