বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাব বর্ষ শুরু সংখ্যা

লাভঘাট

| প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ফা হি ম ফি রো জ : ওই যে...ওই যে রসিক সরোবর, ওই যে মহান নির্জনতার ঘাট। ঠিক এইখানেই কোনো এক বিকেলে ১৯৮১ সালের জুন-জুলাইতে সংঘঠিত হয়েছিলো অপূর্ব দু’টো দেহের প্রাণময় সংলাপ। তিন যুগ পর, আজ যা মিথে পরিণত হতে চলেছে, কিছু উঠতি তরুণ-তরুণীর কাছে; যারা প্রেমের পূজারী। শোনা যায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি চুপিচুপি কিংবদন্তি সেই প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দু’একটা ফুল এখনো ঘাট থেকে সরোবরে ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু তারা জানে না সেই দু’জনের পরিচয়। তাদের মহান প্রেমের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেউ কেউ সেই সরোবরের ঘাটে নাম দিয়েছে ‘লাভঘাট।’ ধীরালয়ে পরিচিত হচ্ছে এ নাম। এই ঘাটে ফুল ছুঁড়ে দিলে নাকি প্রেমিক-প্রেমিকার মন-বাসনা পূর্ণ হয়। মেয়েটির নাম ছিলো লীনা আর ছেলেটি লিয়ন।
একদিন লিয়ন কলেজ শেষে, নিঝুম সরোবরের পূর্ব ঘাটে বসে লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। সেদিন চারদিকে ছিলো সীমাহীন নির্জনতা। বয়সের কারণে প্রকাশ্যে সিগারেট ফোঁকার সাহস লিয়নের তখনও হয়নি। তাই কাজটা লুকিয়েই সারতো। লিয়ন যখন ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ধুয়ো আলগা করছিলো, তা একটা কুন্ডলি পাঁকিয়ে সরোবরের শ্যাওলা ভরা জলের উপর দিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল। সরোবরের উত্তর-পূর্ব পাশে ছিলো হালকা জঙ্গল, ঘাটের পুরনো ইট ছিলো বুড়োদের দাঁতের মতো এলোমেলো এবং অপোক্ত। সেদিন অচেনা এক পাখির ঝাঁক লীনা-লিয়নের মাথার অনেক উপর দিয়ে ডানার অহঙ্কারের শব্দ শুনিয়ে দিগন্তে যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল।
ভালো আছেন তো? হঠাৎ পিছন থেকে প্রশ্ন।
লিয়ন চোখ উঁচু করে দেখে- সে; যেন বলছে :
‘আপনি যাকে খোঁজছেন সেই আমি এখানে।’১

এতদিন পর! কিছুটা স্বম্ভিত হয়ে লিয়ন জবাব দেয়-
ভালো, মোটামুটি।
তুমি?
লীনা প্রশ্ন এড়িয়ে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে কিছুটা আনন্দের মধ্যে ঠেলে দিলেও মুহূর্তে তার দু’গালে মেঘ ফুটে উঠে।
আপনাকে তো কিছু দিনের মধ্যেই আপনার আব্বা ঢাকা নিয়ে যাচ্ছে। আপনি মানুষ হলেই আমার বড় পাওয়া।
লিয়ন হ্যাঁ-না কিছুই বলে না। একটা উত্তেজনা ওর বুক নাড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৭৬ সালে দু’জনের চিঠি ঘটনার পর এই প্রথম দু’জনের দু’জনার মুখোমুখী। স্বল্পকালীন সাক্ষাতে দু’জন দু’জনকে অনুবাদ করে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। লীনা যখন লিয়নকে ভালোবাসার এক লাইনের চিঠি জমিদার কালিকিঙ্কর দত্তের নাচ ঘরে, হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো তখন তৃতীয় শ্রেণীতে আর লিয়ন সিক্সে। সেদিন ছিল ছোট; স্বল্পবাক। আজ ঝর্নার গতিতে ওর ঠোঁট খোলছে। লীনার উচ্চারিত অপূর্ব শব্দগুলো দীঘির বদ্ধ পানিতে বাড়ি খেয়ে, যেন অপূর্ব প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে।
আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে, জানলে কি করে?
জানবো না মানে? শরীর ঝাঁকিয়ে উঠে লীনা।
লিয়নের আর বুঝতে বাকি থাকলো না কোন গভীর তলদেশ থেকে লীনা এটা জানতে পেরেছে। ওর আব্বাও লিয়নকে থেকে যেতে বলেছেন। লিয়নকে লীনা যা বলেছেন সেটা একটা বড় স্বপ্ন, যা বেরিয়ে এসেছে একেবারে ওর নরম বুকের গভীর থেকে। যা ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। ওর জায়গায় লিয়ন থাকলে তাই করতো। লীনাকে দেখে লিয়নের মনে হল ল্যাটিন আমেরিকান ফল ভারাক্রান্ত কোনো সুদৃশ্য বৃক্ষ। যে ফল স্ফিত, পত্রাবৃত এবং সৌকর্যময়। ওর হাতে ছিলো সেদিন কাপড় কাচার বালতি। পরনে ছিল সবুজ পাজামা আর শাদা ছিট কাপড়ের কামিজ, খোপামুক্ত কেশ। লিয়নের গায়ে ছিল হালকা সবুজ রংয়ের চেক শাট, পরনে ক্রিম কালারের প্যান্ট, আলু থালু চুল। লীনাকে দেখে, ভয়ে কোথায় আঙ্গুলের আগুন ছুঁড়ে ফেলেছে, লিয়নের সেদিকে খেয়ালই নেই। ও এসব পছন্দ করে না। পাঁচ বছর দু’জনের কোনো দেখা না হলেও আড়ালে দু’জনই দু’জনের খোঁজ রাখতো। শেষ পর্যন্ত লীনার কথাই সত্য হলো। লিয়নকে ঢাকায় কাৎ হতে হয়। এক বছর পর খুবই জরুরী কাজে ওকে দৌলতগঞ্জে আবার ফিরতে হয়। লীনার সঙ্গে কয়েকটি শব্দও বিনিময় হয়, দেয়ালের ওপার থেকে। ওর পক্ষ থেকে দুপুরের খাবারের শক্ত নিমন্ত্রণও করা হয়। লীনা প্রহর গুণতে থাকে কখন বেখেয়ালি মানুষটা আসবে। কি একটা অভিমান করে সেবার লিয়ন আর লীনার খাবার খায়নি। ঢাকা ব্যাক। লীনার বুকটা শূন্য গোরস্থান হয়ে উঠে। ভাবে, লিয়ন আর তার মুঠে আসবে না। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য জীবনের অন্য দিকে সে মোড় নেয়। কিন্তু এর পরই বুঝতে পারে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লিয়ন যখন জানতে পারে লীনার হাতে মেহেদী উঠেছে, তখনই ও প্রচÐ ধাক্কা খায়। একটানা কয়েক বছর সবার সাথে প্রায় কথা বলা বন্ধ করে দেয়। পাথরের মতো বসে থাকে ঘরে। সাময়িক ঘুুমের ট্যাবলেটের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। দার্শনিক বেঞ্জামিন ডিজাবইলীর ভাষা মগজে ঢুকিয়ে নেয় লিয়নÑ “যে অপেক্ষা করতে জানে তার কাছে সব কিছুই আসে।” স্বপ্ন পূরণের জন্য অস্থির হয়ে উঠে লিয়ন। ঠিক বার বছর পর লিয়নের কবিতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, সেই সাথে সর্বাধিক প্রচারিত একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকও হয়ে যায় মালিকের নির্দেশে। বিয়ের খবরটিও বিখ্যাত একটি বিনোদন পত্রিকায় ছাপা হয়। আরও কিছু...। লীনা গৃহবাসী হলেও এসব খবর তার কানে আসতো প্রায়ই। নীরবে গর্বে ওর বুকটা ফুলে উঠতো। এক নজর লিয়নকে দেখার জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠতো। একবার পাশের জেলায় বড় একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে চিফগেস্ট হিসেবে লিয়ন ছুটে যায়। ফুলে ফুলে বরণ করা হয় তাকে। লোকাল কাগজগুলোতেও নিউজ ছাপা হয়। লিয়ন মনে মনে ভাবে, এই ফুলের অংশীদার সে নয়, লীনা। বাহারী ভাঁজা খাবারের প্রবল চাপে, লিয়নের গ্যাস্টিকের পরিধি হঠাৎ করে বেড়ে যায়। শেষে সিদ্ধান্ত নেয় শেকড়ের কাছে ফিরে যাবে। এই ফুলের তোড়া লীনার হাতেই গুজে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর অতিথি রীতি ভাঙ্গা যায় না। শেষে বিশেষ কৌশলে, কিছুটা ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়ে বহু দূরের চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের দৌলতগঞ্জে। এদিকে পেটে যেন মেঘ ডাকছে। লিয়নের লক্ষ্য কাঁচা তরকারি। ভাবলো এ জন্য লীনার বাসায়ই ভরসা। দুপুরের পরেই লিয়ন লীনার বাসায় পৌঁছে প্রথমেই ফুলের তোড়া আর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রটি বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে। লীনা লাফ দিয়ে ফুলের তোড়া বুকে চেপে ধরে বলেÑ এগুলো আমার। লিয়ন মুচকি হাসতে থাকে।
অনেক বছর দু’জনের যোগাযোগ নেই। লীনা অসম্ভব অভিমান করে আছে। করবে না কেন? তার এত বড় একটা শারীরিক সমস্যা গেল, লিয়নকে তা জানানোর পরও দেখতে আসেনি। এক্ষেত্রে লিয়নের যুক্তিটি উড়িয়ে দেবার মতোও নয়। ছুরি-কাঁচি আর লাশÑ এসব তার জন্মগত আতঙ্ক। এটা লিয়নের পরিবারের সবাই জানে।
একদিন লিয়ন স্বপ্ন দেখে, লীনা তার বাঁম পাশে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু মুখটা বিষণœ। লিয়ন পরম আদরে আলতু একটা ছোট চুমু ছড়িয়ে দেয় লীনার বাম গালে আর বলে কি হয়েছে তোমার?
লীনা চুপ করে থাকে। ছোট বেলায়ও তাই করতো। কেউ কিছু বললে লিয়নের কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো। শেষে চাপাচাপি করলে মূলটা খোলে বলতো। আজ চাপাচাপিতে যা সংক্ষেপে বললো, তা শুনে প্রকৃতিও ব্যথিত হলো, সরোবরের সেই প্রাচীন ঘাটও কেমন অন্ধকার হয়ে গেলো, তীব্র যন্ত্রণায় লিয়নের বুকের এক একটি হাড় খোলে গিয়ে দিগন্তের দিকে ছুটতে থাকলো। ওরা চন্ডিদাস-রজকিনি নয়, শিরি-ফরহাদ নয়। শিরি-ফরহাদ এসেছে পারস্য কাহিনী থেকে। যাদের আগমনের সন-মাস নেই। লীনা-লিয়নেরটার সন-মাস রয়েছে। কিন্তু ওদের প্রেম নিষ্পাপ সুগন্ধি পাঁপড়িময়। এজন্য ছেঁচল্লিশ বছর জীবনে দু’জনকে কি পরিমাণে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, এটা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। ওকে মাজার বেল্ট খোলে পিটানো হয়েছে, শুধু লিয়নকে ভালোবাসার জন্য। লিয়নকে প্রচÐ হৃদয়কষ্টে ওর জন্য র‌্যাটকিলার খেয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হতে হয়েছে, গৃহচ্যুত হতে হয়েছে। আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজা গোপাল বা ধর্মপালের সময় খনন করা এই দিঘী যতদিন তার অস্তিত্ব ঘোষণা করবে, ততদিন ‘লাভঘাট’ রহস্যের জটলা হয়ে থাকবে। হয়তো মাথিনের ক‚পের মতো দেশ-বিদেশে তাদের নামের উজ্জ্বল্য থাকবে কিন্তু কোনো দিন আর তাদের দেখা যাবে না। শূন্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে; প্রকৃতিই তাদের পুরোপুরি আজ লুকিয়ে ফেলেছে। সেই ঘাটে গোপনে কারা সন্ধ্যার আগে ফুল ছুঁড়ে দেয় জলে, দেখলেও এদের চেনা যায় না। আবার মনে হয় ওদের দু’জনের মতোই কারা যেন ঘাটে গল্প করছে। কখনো আবার অদৃশ্য। নিষ্কাম প্রেম যা সুফিবাদ থেকে এসছে। এর শক্তি বিপুল। এরা কোনো অনাচার, অনৈতিক ভোগ সহ্য করতে পারে না। যে কোনো মুহূর্তে এরা সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে অন্যরূপ ধারণ করতে পারে। যেমন কখনও কখনও ঘাটে বউ, অজুরত মানুষ বা বিড়াল সেজে বসে থাকে। যা সাধারণ মানুষের কাছে গোলক ধাধার মত। ওরা হারিয়ে গেছে কিন্তু নতুন প্রজন্মের কারো কারো কাছে এরা কৌতূহলপূর্ণ।
“নক্ষত্রের মৃত্যু হয়। নক্ষত্র কখনো অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, কখনো মৃত নক্ষত্র থেকে জন্ম নেয় নতুন নক্ষত্র, কিংবা নতুন গ্রহ। নক্ষত্রের বেড়ে উঠা এবং মৃত্যুবরণ দুই-ই চলে কোটি কোটি বছর।”২

 

আমার একটি কবিতা :

লাভঘাট
এই ঘাটে, যারাই দেহের গল্প করে তদের মরণ দীঘির জলে
অথচ আমরা কখনো মরি না; উভয় আত্মার রচিত গোপন
উপন্যাস দেবতারা আড়াল সিন্দুকে আটকে রেখেছে কোন্
বেয়াদব রে ওখানে? ভুলে গেছে এই পাড়ের অতীত?
তাইতো গল্পের তরল আগুন ধারা নিজেদের অজান্তেই
সিঁড়ি বেয়ে ফোটায় ফোটায় নাব্যদেশ ছুয়
কেঁদে উঠে অমনি প্রাচীন সরোবর; আমরা এখনো
প্রজাপতি হয়ে সকলের অগোচরে এখানেই উড়ি-ঘুড়ি, কিছু
অর্ঘ্য ভাসিয়ে, ছড়িয়ে দেইÑ পুষ্প নয় ওইগুলোÑ দু’জনের
শুদ্ধতম ফুসফুস; কোনো গেরস্থের বউ চুপিচুপি দেখে ছিল
সেই দিন। দাদী মারে, দ্যাখো দ্যাখো কষ্ট পাচ্ছে আজ
সেই সব পাখিকুল, যারা একদিন বিকেলে খুউব
আমাদের ডানা ভাঙ্গার শব্দ শুনিয়ে ছিল। প্রসার ঘটিয়ে ছিলো
মেঘের ভেতর। তরতাজা জল পেয়ে তাই শত বুকের ঘুমন্ত চাড়া
এখন কেমন চারদিকে বিকশিত গোলাপ-শেফালি নামে
ছুঁয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। ওগুলো নিখাত প্রেম
অন্যেরা মরছে প্রতিদিন, যারাই দেহের
গল্প করে ওইখানে...। সূর্য থাকে যখন পাড়ের সীমানায়।
১০-৫-২০১৭

অ প রি হা র্য
১. বহু যুগ ওপার হতে : প্রাচীন গ্রিক কবিতার অনুবাদ; শিশির কুমার দাশ
২. চর্যাপদ : সম্পাদক আযাদ নোমান, পৃ: ২১

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন