শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

শাহেদ আলীর জীবন নবতর প্রত্যাশা মূল্যায়ন

| প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মা হ মু দ ই উ সু ফ : অসাধারণ, কালোত্তীর্ণ জীবন ঘনিষ্ঠ সব ছোটগল্পের রূপকার অধ্যাপক শাহেদ আলী। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি কালচার, বোধ বিশ^াস, জীবন সংগ্রাম, হাহাকার, ব্যথা বেদনা, জীবনাযাত্রা সাহিত্যে খুঁজতে হলে পাঠকদের শাহেদ আলীর গল্পের দ্বারস্থ হতে হবে। কেবল মানুষই নয়; সাধারণ পশু-পাখির দৈনন্দিন জীবনাচারও অসাধারণত্ব নিয়ে ঝলসে ওঠেছে তাঁর বিভিন্ন গল্পে। কাক, কোকিল, চড়–ই, গাঙচিল, গরু, বিড়াল, বাবুই, ভ্রমর, ময়না প্রভৃতি আল্লাহর সৃষ্টি প্রাণীর সুন্দর চিত্রের সম্মিলনে ভরপুর শাহেদ আলীর গল্প। দম্পতি, একটি রিপোর্ট এবং একই সমতলে গল্পত্রয় পশু-পাখিভিত্তিক। ‘একই সমতলে’ সম্পর্কে মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ বলেন, এ গল্পে মাতৃ স্নেহের এবং বঞ্চনার ও অমানবিকতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে একজন মা ও একটি গাভীর স্নেহের প্রতীক। গাভীর শাবককে মাতৃদুগ্ধ তথা মাতৃস্তন পানের অর্থাৎ দুধের থেকে বঞ্চিত করে মানুষ সেই দুধ বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে। অন্যপক্ষে মায়ের স্তনের দুধ পান করে মানব শিশু হচ্ছে স্বাস্থ্যবান। মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত গাভীর শাবকটি হচ্ছে রিক্ত, শীর্ণ। একই সমতলে শীর্ষক গল্পের কাহিনী অতি পরিচিত ও সাধারণ, কিন্তু এই কাহিনীর বর্ণনা ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা এবং মানসিকতাবোধ অসাধারণ।’’
মানুষ, মন, মনন, সমাজ, প্রকৃতির সমাহার ও সমন্বয়ের চিত্রকল্পই শাহেদ আলীর শিল্প মানস। উপন্যাস বা গল্প কোথায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর গল্পে দীন বা ধর্মকাহিনীর নিখুঁত রূপরেখা প্রস্ফুটিত- এ কথা বলব না। তবে দীন ইসলামের প্রতি ইনসানের যে টান, অনুরাগ, আবেগ তাঁর স্বার্থক রূপায়ন ঘটিয়েছেন শাহেদ আলী। জাবিদ, নবি, হালিমা, নঈমা, হাতেম, রহিমা বানু, রুশন আলীর ধর্মাচার পালন পাঠককে আন্দোলিত করে। ফসল তোলার কাহিনী, জিবরাইলের ডানা, ঐ যে নীল আকাশ, বমি, মানুষের মানচিত্র, ভয়ঙ্কর, পোঁড়ামাটির গন্ধ, নানীর ইন্তেকাল, মহাকালের পাখনায়, এলোমেলো, কপাল, বন্যা, শহীদে কারবালা প্রভৃতি কালজয়ী গল্প পাঠে পাঠকমাত্রই হারিয়ে যাবেন সোনালী অতীতে, নতুন গন্তব্যে। পয়দা হবে অন্যরকম অনুভূতি। হৃদয় কুঠুরিতে ফিরে আসবে শক্তি, সাহস এবং জীবন চলার পথে নতুন অভিযাত্রা। এসব গল্পের পাত্র-পাত্রী, নায়ক-নায়িকা, পাশর্^চরিত্র সবাই-ই ভূমিজপুত্র। বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির চিত্রই এসব গল্পের উপজীব্য। তারপরও দুঃখের সাথে বলতে হয়, এসব উঁচুমাপের গল্প পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পাঠ্যতালিকার বহির্ভূতই থেকে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত প্রতিবেশি দেশের আমাদের জাতিসত্তা বিরোধী কবি-সাহিত্যিকদের রচনাবলি। বাংলা একাডেমি অখ্যাতসব লেখকদের এত রচনসমগ্র প্রকাশ করে। কিন্তু কালজয়ী মননশিল্পী মোঃ শাহেদ আলীর রচনাবলি বের করে না।
বিখ্যাত সুরকার, গীতিকার মরহুম আবদুল লতিফ এর গান, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়/ কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়/এখন কও দেহি ভাই মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়।’’ কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং এর কর্তাব্যক্তি বর্ণহিন্দু পন্ডিতরা মানুষের মুখের জবান কেড়ে নেয় ঔপনিবেশিক আমলে। কোনো প্রতিবাদ করার শক্তি তখন ছিলো না মূলধারার জনগোষ্ঠীর। জুলুমবাজ পৌত্তলিক জমিদার আর ব্রিটিশ শোষনে জর্জরিত ফোর্ট উইলিয়ামের ভাষা আগ্রাসনের ফলেই মুসলিমরা শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। কাজী নজরুল ইসলাম, দৈনিক আজাদ, আযাদি উত্তরকালে তমদ্দুন মজলিস, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদ, মাওলানা আকরম খাঁ এবং হাল আমলে অধ্যাপক ড. এস,এম, লুৎফর রহমান এবং প্রলিফিক রাইটার কথাসাহিত্যিক শফীউদ্দিন সরদার আমাদের পূর্বপুরুষদের বাংলাভাষাকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠার কোশেস চালিয়েছেন। কিন্তু ব্যার্থতার পাল্লাই ভারি। শাহেদ আলী সেই জবানের বুলি ও শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন পাঠকদের। যেমন: আসমান, লোহু, বিষ্টি, দিষ্টি, পুশিদা, ইন্তেকাল, ফূর্তি, বেগানা, জিন্দেগি, আমোদ, জলদি, দুশমন, বদনাম, শরম, সোদা, পয়দা, তাজ্জব, বদলা, মহব্বত, বুনিয়াদ, ভিখিরি, বিবি, সওয়াল, জবাব, ইজ্জৎ, জরু, খসম, দেমাগ, শাদি, মরদ, গরহাজির, ওফা, নতিজা, কিসসা, তামাশা, খতম, নাযেহাল, দরখাস্ত, কুওৎ, গতর, তাকত, শরমিন্দা, মুশকিল, শিরিন, আলাদা, খাতির, জেব, মাইনে, অসওয়াসা, তাজ্জব, মেহমান, জোয়ান, কায়েম, আদমি, লহমা, আযাদ, পেয়ার, তারিফ আরও আরও.....। তবে প্রকৃত বাংলাবুলি ব্যবহারে সবচেয়ে ঋদ্ধ সমৃদ্ধ ‘নানীর ইন্তেকাল’ গল্প। বাংলা একাডেমি এসব লোকায়ত বুলি নির্বাসনে পাঠিয়ে কলকাতার পরকীয়া চর্চায় মনোনিবেশ করছে।
শাহেদ আলী শীর্ষস্থানীয় ভাষা সৈনিকদের একজন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ শুরু করে তমদ্দুন মজলিস। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, আবদুল গফুর, অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, হাসান ইকবাল, শামসুল আলম, ফজলুর রহমান ভুঁইয়া, আজিজ আহমদ, নঈম উদ্দিন, সানাউল্লাহ নুরী, এনামুল হক, ড. আসকার ইবনে শাইখ, শাহেদ আলী প্রমুখ ছিলেন এর নীতি-নির্ধারক। শাহেদ আলী ছিলেন ইতিহাস সচেতন, ঐতিহ্যপুষ্ট, বাস্তবধর্মী, সমাজমনস্ক এবং মাটি ও মানুষের অনুকূলে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ কীর্তিমান লেখক। তিনি ছিলেন, একাধারে জাতীয় বুদ্ধিজীবী, কলম সৈনিক, কথাশিল্পী, শিক্ষাবিদ, সংগঠক, দার্শনিক, সম্পাদক, সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক, বাগ্মী, সমাজসেবক, পার্লামেন্টারিয়ান, সাংস্কৃতিককর্মী, ইসলামিক স্কলার এবং জনদরদি রাজনীতিক। বাংলা সাহিত্যে তিনি আসমান ছুঁয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ছোটো গল্পকার। নামজাদ কবি আল মাহমুদ বলেন, শাহেদ আলী উপেক্ষিত লেখক নন। শাহেদ আলীকে ধর্মীয় পক্ষ থেকে হোক আর ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের পক্ষ থেকে হোক- অর্থাৎ যেভাবেই হোক একটা নতুন বিচার হওয়া উচিত। শাহেদ আলী অত্যন্ত বড় মাপের শক্তিশালী লেখক এবং তার সেই মূল্য তাকে দিতে হবে- না দিলে সেটা খুব খারাপ হবে এবং বিবেকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হবে।’
শাহেদ আলী দৈহিকভাবে আজ বেঁচে নেই। কিন্তু তিনি মানব হৃদয়ে টিকে থাকবেন চিরকাল। কীর্তিমানদের মৃত্যু নেই। তাঁর কর্ম তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে শতাব্দির পর শতাব্দি। তিনি বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষার একজন। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের এই শ্রেষ্ঠ ইনসানটি আজীবন জ্ঞানের পূজারী ছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর ছিলো বিস্তর গবেষণা। দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা তাঁকে বিচলিত করত। আহত করে তাঁর হৃদয়কে। ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি সেমিনারে ইংরেজিতে ‘মুসলিম বিশে^র শিক্ষা সমস্যা’ সম্পর্কে সারগর্ভ আর্টিকেল উপস্থাপন করেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইসলামিকরণ আন্দোলনের পথিকৃৎ ড. সৈয়দ আলী আশরাফ ও বিশ^বরেণ্য দার্শনিক ড. ইসমাইল রাজি আল ফারুকি শাহেদ আলীর প্রস্তাবনার সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন। একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর চিন্তা-চেতনার বাস্তবায়ন ঘটলে দেশের আজ এই দুরাবস্থা হতো না।
স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে আল কুরআন, হাদিস, কুরআন ও বিজ্ঞান, মহানবির জীবনাদর্শ, রসুলুল্লাহর রাষ্ট্রনীতি, ইসলাম ও মানবাধিকার, ইসলাম ও আধুনিক বিশ^, ইসলামি অর্থব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়াবলি পাঠদান করা হলে তরুণ সমাজ এত বিভ্রান্ত হতো না। শাহেদ আলীর কাম্য ছিলো এসব বিষয় ছাত্র-ছাত্রীদের সিলেবাসভুক্তকরণ। তাই সময় এসেছে আমাদের সকলকে ইসলামিক ও কুরআনিক সাবজেক্টসমূহ শিক্ষার সকল স্তরে অনুমোদনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। দীনের সাথে জ্ঞানের রিশতা সম্বন্ধে অধ্যাপক শাহেদ আলী বলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখা এবং মানুষের সকল ক্রিয়াকলাপই ইসলামের বৃত্তের মধ্যে পড়ে। এ কারণে ইসলাম বিজ্ঞান ও গবেষণাকে মানবিক মূল্যবোধ ও উচ্চতর আনুগত্য থেকে বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কহীন মনে করে না। বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল সাধনাকে ইসলামি জীবনদৃষ্টি কেবল প্রভাবিত করে না, নিয়ন্ত্রণও করে। এর ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা কখনো মহৎ লক্ষ্য-বর্জিত হয় না।’’
হদিস:
১। শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠ গল্প, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, মতিঝিল ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০০২
২। কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী জীবন ও কর্ম, ড. আবদুল ওয়াহিদ সম্পাদিত, আল আমিন প্রকাশন, আগস্ট ২০০২
৩। মোস্তফা কামাল: প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ও ভাষা আন্দোলন, সোনারগাঁও প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশনস, আজিমপুর রোড ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রæয়ারি ১৯৮৮
৪। ফাহমিদ-উর-রহমান: সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বাংলাদেশ, বুক মাস্টার, নয়াপল্টন ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ, ফেব্রæয়ারি ২০১৬
৫। ইন্টারনেট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন