শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মর্মান্তিক পাহাড়ধস

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিপাত ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবনে পাহাড় ধসে অন্তত:১৪০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাঙ্গামাটিতে প্রথমদফা পাহাড়ধসে হতাহতদের উদ্ধার করতে যাওয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারি দলের সদস্যরাও দ্বিতীয় দফায় পাহাড়ধসের শিকার হয়েছেন। দু’জন কর্মকর্তাসহ চার সেনাসদস্যের মৃত্যু হয়েছে। অসংখ্য মানুষ আহত এবং নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পার্বত্য জেলাগুলোতে পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা কোন নতুন বিষয় নয়, তবে একসাথে এত সংখ্যক মানুষের এমন কর্দম সমাধির ঘটনা ইতিপূর্বে আর কখনো ঘটেনি। ইতিপূর্বে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের প্রানহানির মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি সংঘটিত হয়েছিল। এরপরও প্রায় প্রতিবছরই পাহাড় ধসে প্রানহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, বেআইনীভাবে পাহাড় কাটা ও ভ‚মিদস্যুতা বন্ধে অনেক দাবী ও অনেক প্রতিশ্রæতি শোনা গেলেও চট্টগ্রাম,কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবনে নির্বিচার গাছকাটা, পাহাড় ধ্বংস ও ভ‚মিদস্যুতা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। ২০০৭ সালের ট্রাজেডির পর থেকে পাহাড় ধসে প্রানহানির সংখ্যা অনেকটা কমে এলেও এবারের ঘটনা আবারো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস এবং পাহাড় ধসের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রæতিগুলো শ্রেফ বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।
অবিরাম বৃষ্টিপাতে উন্মুক্ত পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ার পেছনে হয়তো কারো সরাসরি হাত নেই। একে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবেই দেখছি। তবে দু’ একদিনের বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসের পেছনে যে সব কার্যকারণ থাকে সেখানে অবশ্যই মানুষের হাত আছে। একদিকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যবাহী জুমচাষের ফলে পাহাড়ে বড় বড় গাছপালা বেড়ে উঠতে না পারায় অতিবৃষ্টির সময় পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে সহজেই ধসে পড়ছে এবং প্রানহানি ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের শহরতলি থেকে শুরু করে পার্বত্য জেলাগুলোর অনুচ্চ পাহাড়গুলো কেটে মাটি সরিয়ে নিচ্ছে একশ্রেনীর দখলবাজ ভূমিদস্যু। পাহাড় কেটে সমান করে এবং গাছপালা কেটে সেখানে বস্তিঘর নির্মান করে ভাড়া দিয়ে তারা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারির সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। সোমবারের পাহাড় ধসে মর্মান্তিক ট্রাজেডিতে শত শত মানুষের হতাহতের ঘটনার জন্যও অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি সেখানে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকে দায়ী করা হচ্ছ্।ে সে অর্থে এই দুর্যোগ ও প্রানহানির ঘটনাকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ হিসেবেই আখ্যায়িত করা চলে। সেখানে যারা ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে তারা হয়তো এমন বিপর্যয়ের আশঙ্কাকে গুরুত্ব না দিয়েই এমন ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন মেনে নিয়েছিল। তাদের এই মর্মান্তিক বিপর্যয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী সেনা কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদেরও প্রান দিতে হলো। পাহাড়ের ভ‚মিধসে ৪ সেনাসদস্যসহ শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে পুরো জাতি আজ দু:খিত ও শোকার্ত। আমরা দেশপ্রেমিক সেনাসদস্যসহ ভ‚মিধসে নিহতদের মাগফিরাত কামনা করছি।
বর্ষা শুরুর আগেই জৈষ্ঠ্যের বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মর্মান্তিক মিছিল আমাদেরকে সামনের বর্ষায় আরো বড় ধরনের ট্রাজেডির আশঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। শুধুমাত্র চট্টগ্রামেই কয়েক লাখ মানুষ বেআইনীভাবে পাহাড়ের উপর ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে। চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ২০০৭ সালে একসাথে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর তৎকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল(অব:)এম এ মতিনের নেতৃত্বে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কর্ফোসের তদন্ত ও সুপারিশের আলোকে চট্টগ্রামসহ পাবর্ত্য অঞ্চলে লাখ লাখ মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস এবং নির্বিচার পাহাড় কেটে মাটি সরিয়ে নেয়া বন্ধ করার কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় পাহাড়ের পরিবেশগত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি আরো অনেক বেড়ে গেছে। মতিন কমিশনের দেয়া ৩৬ দফা সুপারিশের আংশিকও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলে এমন ভ‚মিধস ও ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি হতোনা। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহানির ঝুঁকি কমিয়ে আনতে প্রায় ৯ বছর আগে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিও সুবিধাভোগি প্রভাবশালীদের রাজনৈতিক চাপের কারণে কোন কাজ করতে পারেনি বলে জানা যায়। এভাবেই নদী ও খালবিল দখল, শিল্পদূষনের হোঁতাদের কাছে অসহায়ত্ব বরণ করে আমাদের রাজধানী শহর বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিনত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলিসহ অসংখ্য নদীর বায়োলজিক্যাল মৃত্যু ঘটছে। প্রতিবছর বর্ষা মওসুমে পাহাড় ধসে একসঙ্গে অনেক মানুষের প্রানহানির পর মিডিয়াগুলো সরব হয়ে উঠলে গতানুগতিক কায়দায় এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটিও যথাসময়ে কার্যকারণ উদঘাটনপূর্বক সুনিদ্দিষ্ট সুপারিশমালা উত্থাপন করে থাকে। তবে এসব সুপারিশ কখনো আলোর মুখ দেখেনা। এখানেও হয়তো ভ‚মিদস্যু ও দখলবাজদের হাত থাকে। যেখানে বৈধভাবে নির্মিত বাড়ি ঘরে নতুন গ্যাস-বিদ্যুত ও পানির সংযোগ পেতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে পাহাড়ে বেআইনীভাবে বসবাসকারিরা কি করে সহজেই এসব ইউটিলিটি সংযোগ পাচ্ছে তার জবাবদিহিতা নেই। শত শত প্রানহানির পরও কেন পাহাড়ের প্রাণ-প্রতিবেশ ও মানুষের জীবন রক্ষায় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কোন কারণ থাকতে পারেনা। পাহাড়ে উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা, অস্থিতিশীলতা, ঝুকিপূর্ণ ও প্রানঘাতি কর্মকান্ড বন্ধে দেশের মানুষ অতিদ্রæত কঠোর পদক্ষেপ দেখতে চায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন