সৈয়দ টিপু সুলতান
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
সমুদ্রের স্বতেজ হাওয়া বাতাস ও জলের খেলা অদূরে জাহাজবাসীর কোলাহল। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর কেমন যেন অনেক চেনা একটা পরিবেশ। ছেলে-মেয়ে কোথায় খবর নেই। আমরা অনেক রাতে রুমে আসলাম। ভাগ্য প্রসন্ন হওয়াতে আমাদের রুমের পাশে সমুদ্রে দেখাদেখি একটা ছোট্ট বেলকনি ছিল। দুটো চেয়ার পাতা। বসে থাকতে থাকতেই মৃদু মোলায়েম বাসাসে চোখ ভেঙ্গে রাজ্যের ঘুম আসলো। কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছিল না এমন মনোরম মায়াবী আবেশ রেখে চোখে অন্ধকার নামানোর। মনে হলো ঢাকা-বরিশাল যাত্রার কথা। গভীররাতে স্টীমারে একেবারে সম্মুখভাগে বসে জ্যোৎ¯œা ছড়ানো কুয়াশা মাখানো অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির ঘোমটা সরিয়ে সরিয়ে দেখার কথা। রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ভোঁ শব্দ যেন জানান দিতো প্রিয়জনকে কাছে আসার।
কখন যে দুজনেই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। পরের দিন আমাদের দেশের মত ট্টপিক্যাল আবহাওয়ার দ্বীপ ডমিনিকা দ্বীপে এসে জাহাজ ভিড়লো। ডমিনিকার রাস্তাঘাট ততটা পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন নয়।
ছোট ছোট অনেক পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসতি। গাইড চলার পথে বিভিন্ন গাছের ফল ফলাদি দেখাল। কোকা নামের ফল খেলাম আমি ও জুবেন। গাইড দেখাল টিনের উপর মাংস রেখে নীচে আগুন জ্বালিয়ে কাবাব বানানোর পদ্ধতি। ডমিনিকা ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রায়ই প্রচুর আম গাছও চোখ পড়লো। ১৯৯২ সালের ঘূর্ণিঝড়ে গাছ চাপা পড়া একটা স্কুলবাস আজও একইভাবে পড়ে আছে। কলা প্রধান অর্থকারী ফল। বিশাল বিশাল এলাকা কলা গাছের বাগান। তারপরই ট্যুরিজম। এখনও যুক্তরাজ্যের জন্য এখান থেকে বিশেষভাবে কলা সরবারহ করা হয়। গাইডকে ফলো করে একবার পাহাড়ের উপর আবার পাদদেশে এমারাল্ড পুল ও ট্রাফেলগার জলপ্রপাতের ছবি তুললাম। অনেকে এমারাল্ডপুলের স্বচ্ছ পানিতে নেমে পড়ছে গোসল করার জন্য।
জাহাজে উঠতে উঠতে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল। এত দিনে ফ্লোরিডা থেকে আসা পরিবারটির সাথে মোটামুটি ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে। খাওয়ার পর প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান প্রতি পরিবারের জন্য আলাদাভাবে ছবি তুলালো নানা ভঙ্গিমায়। ক্ষাণিকক্ষণ পর জুবেন বায়না ধরল রাতেই জুকুজিতে যাবে। সুইমিং ড্রেস পড়ে নেমে পড়লাম বাবা ছেলে। রাতের বাতাসে আর্দ্রতা থাকতে জুকুজিতে গরম পানির বুদবুদ, রাতের আকাশের অসংখ্যা তারার মেলায় বেশ উপভোগ করছিলাম। পরের দিন ফ্রান্স শাসিত মার্টিনিকে পৌঁছলাম। সেন্ট পিয়েরে এবার বাসে করে গাইডের সাহায্যে শহর দেখা। মাউন্ট পিলি (চঊখঊঊ) ১৯০২ সালের আগ্নেয়গিরি দ্বারা, সেন্ট পিয়েরের পূর্ণ ধ্বংসের ও শুধু ১ জনের বাঁচার অভ‚তপূর্ব ও অবিশ্বাস্য কাহিনী আগেই বলেছি।
ইউরোপিয়ান স্টাইলে ছোট ছোট বাড়ি-ঘর বেশ সাজানো গোছানো। সরকারের পরিচালিত বড় বড় এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের প্রথম পদচিহ্ন যেখানে পড়েছে সেখানটায় গিয়ে মনে হলো কত দুঃসাহসিকতা আর আবিষ্কারের অদম্য উৎসাহ নিয়ে নয়া বিশ্বের খোঁজে বেরিয়েছিলেন। আবার টাইল দিয়ে অসংখ্য গাছের মাঝে বড় বড় বাড়ি ঘর চোখে পড়ল। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিশাল বিশাল ফার্ণ আমাদের দেশে ফার্ণ সাধারণত ছোট হয় কিন্তু ওখানকার ফার্ণ গাছগুলো বিশাল কড়ই গাছের মত। ফার্ণ গাছের আকৃতি ও প্রকৃতি সত্যিই দেখার মত।
পরের দিন বার্বাডোস। কেরিবিয়ান আইল্যান্ডগুলোর মধ্যে বলা যায় অপ্সরা তিলোওমা দ্বীপ। একদিকে প্রশান্ত ও অন্য দিকে আটলান্টিকের সম্মোহনী সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ছে। আমরা এখানে প্রথমে আইল্যান্ড সামারি ট্যুর নিলাম। এমন একটা এডভেঞ্চার মিস করা যায় না।
বার্বাডোস ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। আয়নত ১৬৬ বর্গমাইল। ২ লক্ষ ৬০ হাজার অধিবাসীর বসবাস। প্রায় ৭টা ল্যান্ড রোভার (৪দ্ধ৪) দিয়ে যাত্রা শুরু। প্রথমে ঈঙঠঊইঅণ (কভাবে) যেতেই যাত্রীদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। উঁচা- নিচা বন-জঙ্গল পেরিয়ে কখনও পাথরের চ‚ড়ায় আবার কখনও সমুদ্র তটে। সব মিলিয়ে দুঃসাহসিক এ অভিযান। সেঁওতি, তানিয়া, জুবেন খুব মজা করছে। সমস্যা আমাকে ও গিন্নিকে নিয়ে। বিশাল ঢেউ এসে ঈঙঠঊইঅণ তে আছড়ে পড়ছে। শিলারাশি খসে পড়তে পড়তে বিভিন্ন আকার ধারণ করছে। মনে হচ্ছিল কোন শিল্পীর তৈরী ভাস্কযের বিমূর্ত বিকাশ।
তারপর পিকু টেনেরাইফ এল ভিউ। পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখা। ঔঙঊদঝ জওঠঊজ ঋঙজঊঝঞ এর মাঝখান দিয়ে কাদামাটি পানি, জঙ্গল, লতানো গাছের স্পর্শ যেন আনন্দ ও ভয়ের মিশ্রণ। সবচেয়ে বেশী বার্বাডোস এ এসে যে বিষয়টা নজর কাড়লো সেটা হচ্ছে আটলান্টিকস সাবমেরিনে সমুদ্রের তলদেশ ভ্রমন। লিফলেটে বর্ণনা দেখে সব যাত্রীর চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। এটা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম যাত্রী বহনকারী সাবমেরিন ফ্লিট। এর অন্যান্য পোর্টে হচ্ছে আরুবা, ওয়াই কি কি, মাওউই (হাওয়াই) ও মালয়েশিয়া। ৬৫ ফিট লম্বা ৮০ টন ওজন সম্পন্ন সাবমেরিনের একসাথে ৪৮ জন যাত্রী ধরে। ১৫০ ফুট সমুদ্রের নীচে নেমে আসে। গতি ১.৫ নটস। সমুদ্র উপক‚লের সাথে বস সময় রেডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। প্রথমে বোটে করে তীরের বেশ দূরে রাখা সাবমেরিনের দিকে যাত্রা কররাম। ছেলে-মেয়েদের আনন্দ যেন আর ধরে না।
আমাদেরও যেহেতু প্রথম অভিযান তাই শংকিত উদ্বেলিত হৃদয়ে অপেক্ষায় রইলাম। সাবমেরিনে ওঠেই দেখলাম রংবেরং এর মাছ এসে খেলা করছে কাঁচের ওপারে। জুবেন হাত দিয়ে ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করার সাথে সাথে আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার দিচ্ছিল। আবার কচ্ছপ দেখে ভয়ে শংকিত হল। প্রায় ১০০ ফুট গভীরে যাওয়ার পর দেখা গেল স্পঞ্জ ও কোরালের বাগান। নিঃশ্বাস কেড়ে নেয়ার মত বাগানের সৌন্দর্য দেখে মনে হলো মাটির পৃথিবী থেকে সমুদ্রের তলদেশের জগৎ যেন আরও মায়াময় এবং অধরা অপ্সরা রমনীর মত রহস্যময়। সৃষ্টিকর্তার অপার রহস্যের গভীরতা যেন মানুষের সৃষ্ট সৌন্দর্যকে ¤œান করে দিয়েছে। শত শত রকমের হাজার হাজার রংবেরং এর মাছ অপরূপ খেলায় রত। বংশপরম্পরায় হাজার হাজার মাছ দলবেঁধে ধেয়ে চলেছে অজানার পথে। সবার মনে টান টান উত্তেজনা ও আনন্দানুভ‚তি। ফিরে আসার সময় সাবমেরিনের গতি আরও দ্রæত হওয়ায় সমুদ্রের জগৎ কে যেন স্বপ্নপুরীর মত মনে হচ্ছিল। সাবমেরিন থেকে উঠে এসে আমরা জাহাজে উঠলাম সবাই। এবার ফেরার পালা। দিন নেই রাত নেই চলছে সমুদ্রে ভাসমান পাঁচতারা হোটেল। খাওয়া, খেলা, প্রকৃতির বন্দনায়- আলোছায়ায়, মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলায় যেন জীবনের এক নতুন অধ্যায়েন সূচনা হলো। এবার চটঊজঞঙ জওঈঙ তে এসে ঘুরে দেখা হলো অনেক পুরোনো সভ্যতা ও ঐতিহ্যমÐিত সান হোয়ান শহর।
চাটার্ড প্লেনে ওঠার আগে শত শত যাত্রী সুভেলির কেনার শেষ চেষ্টায় ব্যস্ত। জুবেন খুঁজে খুঁজে একটা টি শার্ট পছন্দ করল, গায়ে, লেখা ছিল “ডঐঙ খঊঞ ঞঐঊ উঙএ ঙটঞ”। বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে বিমুর্ষ চিত্তে এক সময় সানহোয়ান এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম সবাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন