অবশেষে বহুল বিতর্কিত ভ্যাট আইন ও প্রস্তাবিত আবগারি শুল্ক নিয়ে জনমনে সৃষ্ঠ উৎকণ্ঠার অবসান ঘটালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাবিত ভ্যাট আইন এবং ব্যাংকে এক লাখের উর্ধ্ব অঙ্কের স্থিতির উপর প্রায় হাজার টাকা অবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব সম্বলিত আইন বাদ রেখে গত বুধবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অর্থবিল পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি অনাকাঙ্খিত বিতর্ক ও উৎকণ্ঠার অবসান হল। নতুন ভ্যাট আইন দু’ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সেই সাথে আবগারি শুল্ক আগের চেয়ে কমিয়ে এক লাখ থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত দেড়শ’ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সংসদে বাজেটের উপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাজেট জনগনের কল্যাণের জন্য, সেই জনগনের দুর্ভোগ চাইনা। তার মতে অর্থমন্ত্রীও জনগনের দুর্ভোগ চাননা। তবে একথা অস্বীকার করা যাবেনা যে, শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে প্রস্তাবিত কিছু বিশেষ কর ও আবগারি শুল্ক কমিয়ে অর্থবিল পাস হওয়ায় দেশের ব্যবসায়ী মহল এবং সাধারণ মানুষ স্বস্তি বোধ করছে। এমনিতেই দেশের অর্থনীতি ক্রমাবনতিশীল এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বা চালসহ নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির পাশাপাশি নতুন ভ্যাট আইন এবং অবগারি শুল্ক দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা আরো দুর্বিসহ হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তে মানুষের সে আশঙ্কা অনেকাংশে দূরিভ‚ত হল।
গতানুগতিক নিয়মে প্রতি বছরই দেশের অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। সংসদীয় রীতি অনুসারে সংসদ সদস্যরা বাজেটের আলোচনায় অংশ নেন এবং যথারীতি কিছু সংশোধনীসহ বাজেট পাস হয়ে যায়। তবে এবার সংসদের বাজেট আলোচনা কিছুটা ভিন্ন মাত্রায় হাজির হয়েছিল। প্রস্তাবিত আবগারি শুল্ক এবং ভ্যাট আইন নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছিল বাজেট অধিবেশন। বিরোধিদলীয় সদস্যরা শুরু থেকেই বাজেটের বিতর্কিত প্রস্তাবগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সরকারীদলের সংসদ সদস্যদের একাংশও ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক নিয়ে কঠোর ভাষায় বক্তব্য রাখেন। বলা যায়, সংসদের চতুর্থ বাজেট অধিবেশনটি কিছুটা হলেও প্রানবন্ত রূপ লাভ করেছিল। চলতি বছরটি মূলত: নির্বাচনী বছর হওয়ায় জাতীয় বাজেটের জনগুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোকে নিয়ে আলোচনা করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা নিজেদের সরব উপস্থিতির জানান দেয়ার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে সরকারী দলের মন্ত্রী-এমপিদের পক্ষেও এসব জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অগ্র্হ্যা করা সম্ভব হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি সক্রিয় থাকলে এবং ক্ষমতার জন্য জনগনের ভোটের ম্যান্ডেট অপরির্হায মনে করলে জনগণের দুর্ভোগের বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করে যেনতেন প্রকারে বাজেট পাসের সুযোগ নেই।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত চার লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। যদিও বাজেটের আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট প্রস্তাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এই ঢেউ মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও লেগেছিল। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিবিদরা এসব জনসম্পৃক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনাসহ প্রস্তাব পুনর্বিবেচনায় বাধ্য হয়েছেন। পরিবর্তনসহ অর্থবিল পাস হওয়ার পরও সাবেক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবারের প্রস্তাবিত বাজেটকে একটি ‘নিকৃষ্ট বাজেট’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার পর বাজেটের মৌলিক বিষয় পরিবর্তনের নজির আমাদের দেশে বিরল। এবারের বাজেটে এটা এক বড় দৃষ্টান্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা নানাভাবে বিষয়টির আলোচনা করছেন। বাজেটের যে সব সিদ্ধান্তে দেশের ব্যবসা-বানিজ্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তোলার আশঙ্কা ছিল, সে সব বিষয়ে কিছু মোলিক পরিবর্তনের প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের বিকল্প ছিলনা। জনস্বার্থে এবং জনদাবীর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর যথাযথ উদ্যোগে বাজেটের অনাকাঙ্খিত অসঙ্গতি কিছুটা দূর হয়েছে। জনদাবীর প্রেক্ষিতে বাজেটের মৌলিক পরিবর্তনের এই দৃষ্টান্ত আমাদের সংসদীয় রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক ধারার সূচনা বলে মনে করা যায় আগামীতে সকল দলের অংশগ্রহনে স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে বাজেট প্রণয়নে স্বচ্ছতা এবং সংসদে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন