বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

বি দে শী ব ই

| প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

থিংস ফল অ্যাপার্ট : সাংস্কৃতিক দ্ব›েদ্বর
অনবদ্য আখ্যান
লো ক মা ন তা জ
নাইজেরিয়ার কালজয়ী কথাসাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে উপনিবেশবিরোধী অবস্থানের জন্যে বিশেষভাবে সুখ্যাত। তার লেখা ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ উপন্যাস পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তোলে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। বিশ্বসাহিত্যে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে এই উপন্যাস। ৫০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়া এই উপন্যাসের সারা বিশ্বে এক কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। নাইজেরিয়ার একটি গ্রামের গল্প তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। সেখানকার ইবো আদিবাসীদের সাথে ইউরোপিয়ান খ্রিস্টান মিশনারিদের সাথে প্রথমবারের মতো সংঘর্ষ বাধে। এরপর এগিয়ে যায় উপন্যাসটির গল্প। চিনুয়া আচেবে জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ লেখার সময় চিনুয়া আচেবের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। এটাই ছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস। এরপরও বেশকিছু উপন্যাস লিখেছিলেন চিনুয়া আচেবে। যার বেশিরভাগেরই প্রেক্ষাপট, ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত আফ্রিকা। এর পাশাপাশি নন-ফিকশন এবং কবিতাও লিখেছেন তিনি। ফিকশনের জন্য ম্যানবুকার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। চিনুয়া আচেবের ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ পুরো আফ্রিকার একটি চিত্র। ওমোফিয়া গ্রামের ইবো জনগোষ্ঠীর সামাজিক জীবনধারাকে তুলে ধরেছে এ উপন্যাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদিম এই সমাজ অপরিবর্তিত অবস্থায় চলে আসছে। ঐতিহ্যকে লালন করে অভ্যস্ত এই সমাজের সাথে বহির্বিশ্বের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। যে মানুষই এ সমাজে প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করে, তাকেই সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হয়। আদিম এ সমাজের বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, অর্থনীতি, আত্মীয়তার বন্ধন ইত্যাকার নানা বিষয়ের মাধ্যমে একটি যুগের সামাজিক চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাই একে সামাজিক উপন্যাস বললে ভুল হবে না বলে আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে প্রাক-শিল্পযুগীয় একটি সংস্কৃতির মানুষজন কীভাবে প্রথা-শাসিত জীবন যাপন করছিল তার একটি মনস্তাত্তি¡ক বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসটি একধাপ এগিয়ে নিজেকে নৃ-তাত্তি¡ক গুণে সমৃদ্ধ করেছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি যখন ইবো সমাজের বহু বছরের মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করে নিজ প্রতিপত্তি স্থাপনের নগ্ন মহড়া শুরু করে, তখনই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ওকনকো এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এবং শেষপর্যন্ত এ আরোপিত সংস্কৃতি মেনে না নিতে পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়; তবুও আদর্শচ্যুত হয়নি, স্বীয় সম্মানকে বিসর্জন দেয়নি। আফ্রিকার বিভিন্ন সমাজে রয়েছে গল্প বলার এক বর্ণালি ইতিহাস। আচেবেও ছোটবেলা থেকে গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছিলেন। তাই গল্প বলার একটি জাত প্রবণতা তাঁর কোনো উপন্যাসেই বিস্মৃত হয়নি। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও আচেবে নিজ ভাষার বহু শব্দ ও প্রবাদ এতে জুড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, যেসব শব্দ ভাষান্তর-যোগ্য নয় সেসব শব্দ হুবহু রাখা উচিত কিংবা সেসবের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে মাধ্যম হবে ইংরেজি ভাষা। কারণ আফ্রিকায় এত ভাষা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে, এক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা আরেকটি গোষ্ঠীর কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। এমন একটি একক শক্তিশালী ভাষা আফ্রিকায় নেই, যা সবাই বুঝতে পারে কিংবা তা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এ যেভাবে আফ্রিকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চিত্রিত হয়েছে, তা এককথায় অনবদ্য। প্রথমবারের মতো বিশ্বপাঠকেরা আচেবের বর্ণনায় আফ্রিকাকে নতুনভাবে জানল। এ জানা পূর্বাপর সব জানা থেকে ভিন্ন। এ ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল কেবল একজন নাইজেরীয় আফ্রিকার কণ্ঠস্বর হয়েছিলেন বলে। ইউরোপীয় লেখকেরা আফ্রিকীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস বর্ণনায় সব ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে পারেননি। আচেবের প্রেক্ষাপটে এই কেন্দ্র হচ্ছে সংস্কৃতি। অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসন বা থাবাই হলো অরাজকতা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করে ফেলেছে আফ্রিকীয় সংস্কৃতিকে। আচেবের প্রশ্ন, তবে কি স্বীয় সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাবে? উত্তরও তিনি দিয়েছিলেনÑনা। গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় মেধা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের কারণে পুরো এলাকার শাসনকর্তাদের একজন হয়ে ওঠে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওকনকো। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ সে পার্শ্ববর্তী গ্রামেরও প্রতিনিধির দায়িত্ব পায়। গ্রামের মহান ব্যক্তি এজেন্ডোর শেষকৃত্যানুষ্ঠানকালে অপ্রত্যাশিতভাবে তার বন্দুকের গুলিতে মৃত ব্যক্তির ছেলে নিহত হলে তাকে সাত বছরের জন্য নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হয়। নির্বাসন থেকে ফিরে সে পুরো গ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পায়। তার ছেলেসহ বহু গ্রামবাসী খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। সাদা চামড়ার লোকেরা সাধারণ মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করছে, যুগ যুগ ধরে পালিত ঐতিহ্য, প্রথা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের থাবায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। ওকনকো এসব মেনে নিতে না পেরে স্থানীয় গির্জা পুড়িয়ে দিল। নানা অপরাধের কারণে একপর্যায়ে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তার করল। পরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছিল বটে। কিন্তু এত দিনে তার সব স্বপ্ন শেষ। রাগে, ক্ষোভে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রতিনিধি-প্রধানকে হত্যা করল সে। তখন তার আর বুঝতে বাকি নেই যে, এখন ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। আত্মপ্রত্যয়ী ওকনকো আত্মসম্মান রক্ষার্থে আত্মহত্যা করল। তার এই আত্মহত্যা জানান দিল, ইবো সংস্কৃতি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে; ইবো ঐতিহ্যের অবসান হবে। এখানেই আচেবের যুক্তি, ছোট ছোট নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি তাদের নিজেদের দুর্বলতার কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। উত্তরণের উপায় হলো স্বীয় সংস্কৃতির সাথে বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটানো। তাঁর মতে, সংস্কৃতি কোনো স্থির বস্তু নয়। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ঠেকানো অসম্ভব। পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করে, স্বীয় সংস্কৃতির অপরিহার্য প্রথাকে বজায় রেখে বিদেশি সংস্কৃতির যা ভালো, তা গ্রহণ করা উচিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন