বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

মধুসূদনের বীরাঙ্গনা

ড. গুলশান আরা | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার ফলে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ঘটে। এরই ফলে বাঙালি জীবনে অকস্মাৎ এক বিরাট আলোরনের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলও সুদূরপ্রসারী। এ বোধই পরিচিতি পায় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ হিসেবে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত উনিশ শতকের মানসপুত্র। নবজাগরণের ফলে তার হৃদয়ে স্ফূর্তি ঘটে, মানস লোক আশ্চর্য এক সৃষ্টি প্রতিভায় সচকিত হয়ে ওঠে। তিনি নিজের মধ্যে অপার আনন্দ, এক পরম শান্তি অনুভব করেন। মানব জীবন তার কাছে অপার রহস্যময় হয়ে দেখা দেয়। বিশ্বজগৎ সমস্ত সৌন্দর্য ও মাধুর্য নিয়ে উপস্থিথ হয় তার চেতনালোকে।
এই সৌন্দর্য ও মাধুর্য  তাঁকে তাড়িত করে নতুন সৃষ্টির তাগিদে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সাহিত্য জীবন পর্যন্ত তাঁর মধ্যে নতুনত্ব আনয়নের চেষ্টা লক্ষ করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে নতুন ভাব ও নতুন আঙ্গিক সৃষ্টির জন্য মধুসূদনের নাম করতে হয়। তাঁর প্রতিটি সাহিত্য কীর্তিই এই নতুনত্ব প্রকাশের গৌরবে গৌরবান্বিত। এদিক দিয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যেও এর ব্যতিক্রম নেই। পাশ্চাত্য থেকে আঙ্গিক ও ভাবের ইঙ্গিত বহন করে প্রাচ্যের অনুভূতিতে তাকে শক্তীকরণ করে তিনি আশ্চর্য সুন্দর কাব্য রচনা করেছেন।
মধুসূদন জন্ম বিদ্রোহী আজন্ম যোদ্ধা। ‘বীরঙ্গনা’ ও তার বিদ্রোহী অন্তরের নব অনুভূতির ফসল। ইউরোপীয় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ তখন মানবতার পথ ধরে ভারতের সমাজে ও সাহিত্যে পথ করে নেবার অদম্য চেষ্টায় রত। এই মানবতাবোধের উদার আদর্শ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের তীব্র অনুভূতি হৃদয়ে ধারণ করেই সে যুগের সমাজ সংস্কারকগণ এগিয়ে এসেছিলেন বাংলার নারীমুক্তির প্রচেষ্টায়। সতীদাহ প্রথা নিবারিত হল, হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ আইন পাস হল, বহু বিবাহ ও কৌলিন্য প্রথা নিরোধের জন্য প-িত ঈশ্বরচন্দ্র ও সুহৃদ বর্গের ক্লান্তির বিরাম ছিল না। কারণ সমগ্র মধ্যযুগ ধরে বাংলাদেশের সমাজ জীবনে নারীর যে অবস্থা ছিল তাকে মানবীয় বলে উল্লেখ করা চলে না। মানবীকে দেবীর আসনে বসালে তাকে  যে আসলে সম্মান দেয়া  হয় না বরং অসম্মানই করা হয় তা উনিশ শতকের মনীষীগণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই সেদিন নারীকে একান্তভাবেই নারী করে না রেখে তাদের মানুষ করে  উঠতে চেষ্টা নিয়ে ছিলেন। ধর্ম ও নীতির শত সহ¯্র বন্ধন ও আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ নারীকে উনিশ শতকের নজজাগ্রতি মুক্তি দিতে চেষ্টা নিয়েছিল। সমাজের এইসব পরিকল্পিত পরিবর্তন মধুসূদনকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি বুঝে ছিলেন যে, বাংলার নারীর মনে আত্মভাবনা ও অহংচেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে- নইলে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। সে কারণে দৃঢ়চিত্তে লেখনী ধারণ করেন তিনি, তাঁকে সহায়তা করেন একদিকে পাশ্চাত্যের কবিকুল অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় শৌর্য বীর্যে পৌরুষ সম্পন্ন নারী চরিত্র।
বীরাঙ্গনা কাব্যের আঙ্গিক ও নামকরণের দিক থেকে মধুসূদন পাশ্চাত্য কবিদের কাছে ঋণী। ইতালীর কবি ওভিদের হিরোয়দস কাব্যের পত্ররীতি অবলম্বন করে বীরঙ্গনা কাব্য রচিত। বিভিন্ন কারণে পরিত্যক্ত নারীর মনোবেদনা পত্রগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। মধুসূদনের নায়িকারা দৈহিক বীরত্ব ও মৌখিক আস্ফালনের জন্য বীরঙ্গনা আখ্যা পাননি, তাদের বীরত্ব চিরাচরিত সামাজিক রীতিনীতির শৃঙ্খল ও জড়তার আচরণ ঘুরিয়ে দিয়ে হৃদয়ের সত্য প্রকাশে। বনবাসিনী শকুনতলার পক্ষে হৃদয়ের অনুভূতি কথা প্রকাশ্যে দুষ্মন্তকে বলা অথবা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করা এ চিরাচরিত ভারতীয় নীতিবিরুদ্ধ। এরা পতির কাজের সমালোচনা শোনা পর্যন্ত পাপ মনে করে। সে সময়ে বাংলার  সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের এমন অবস্থা ছিল যে তারা পতিনিন্দা করা তো দূরে থাক কেউ যদি পতির নিন্দা করতো তাহলে  তারা সে স্থান ত্যাগ করতো। এদের আদর্শ ছিল সতী, যিনি পতির নিন্দা শুনে প্রজ্বলিত যজ্ঞকু-ে আত্ম নিসর্জন দিয়েছেন। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা সে যুগের আদর্শ থেকে চ্যুত হয়ে স্বীয় পতির দোষগুণের সমালোচনাই শুধু করেনি, পতীর প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছে। প্রবল অহমিকায় বিশ্বাসী এবং নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রমণী মূর্তিকে মধুসূদন তাঁর কাব্যে অংকন করেছেন।
বীরাঙ্গনা কাব্যে বিভিন্ন ধরনের পত্র সন্নিবেশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রেমবিষয়ক পত্র, প্রেম প্রত্যাখ্যানজনিত পত্র এবং স্বামীর অত্যাচারে কিংবা দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ রমণী হৃদয়ের ক্ষোভের পত্র।
প্রচলিত ছিল যে, ভারতীয় নারী স্বামীর নিকট বিক্রীত। নারী তার দেহে, মনে স্বামীর কাছে আত্মনিবেদিত। তার নিজের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। সংসারের নিয়ম-নীতিতে সে অষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কিন্তু মধুসূদনের কাব্য রচনা যেহেতু নবজাগরণের পরে সেহেতু তাতে ইউরোপীয় ব্যক্তি মানসের ছায়া পড়েছে।
যেমন ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ এই পত্রে দশরথের অন্যায় কার্যে স্ত্রী কেকয়ী তাকে নানান ভাষায় নানানভাবে শ্লেষপূর্ণ বাক্যে রাজাকে অবজ্ঞা করছে। সে এ কথাও বলে বেড়াচ্ছে যে- সে এ পুরী ছেড়ে চলে যাবে এবং দেশে দেশে বলে বেড়াবে ‘পরম অধর্মচারী রঘুকুল পতি!’ পুত্রের সিংহাসন আরোহণ করানোর জন্য স্বামীর অন্যায়কে সে সহ্য করেনিÑ কারণ দশরথ অঙ্গীকার করেছে কেকয়ী পুত্র ভরতকে সিংহাসনে বসাবে। অঙ্গীকার ভেঙে রামকে কেন সিংহাসনে বসাচ্ছে। কেকয়ীর কাছে এটি অঙ্গীকার ভঙ্গের অপরাধ। অন্যান্য পত্রের মত এ পত্রখানিও ভাষার তীব্রতায় শ্রেষ্ঠ।
‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রে ও স্বামীর মীমাংসাকে মেনে নিতে পারেনি জনা। অশ্ব মেধ যঙ্গের অশ্ব ধরেছিল জনার পুত্র প্রবীর। পার্থের সঙ্গে যুদ্ধে সে নিহত হয়। কিন্তু পিতা নীলধ্বজ শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা করেÑ এটা জনা সহ্য করতে পারেনি। স্বামীকে পুত্র হন্তার সঙ্গে মিত্রতা করার জন্য যে অবজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় লিখেছেÑ তারই নিদর্শন এ পত্র।
এভাবে স্বামীর অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ স্ত্রীর হৃদয়াবেগ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন পত্রে।
ব্রজাঙ্গনার মতো বীরাঙ্গনাও লিরিক কাব্য। ভাষার লালিত্যে এ ছন্দের পারিপাট্টে বীরাঙ্গনা মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ রচনা।
‘তিলোত্তমা’ ও ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন তা ‘বীরঙ্গনা কাব্যে পূর্ণতা পেয়েছে। ‘বীরঙ্গনা’ কাব্যের ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য পাঠককে মুগ্ধ করে। এর সর্বত্রই একটা সংগীত ধ্বনি ঝংকৃত হয়ে কাব্যখানিকে পরম উপাদেয় করে তুলেছে। কবিত্ব শক্তির দিক দিয়ে বিচার করলে মেঘনাদ বধ উৎকৃষ্ট কিন্তু ভাষার লালিত্যে ও ছন্দের পারিপাট্টে বীরঙ্গনা সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। কারণ মেঘনাদ বধ বাক্যে দুরূহ শব্দ সুপাঠের জন্য বিঘœ সৃষ্টি করে। কিন্তু বীরাঙ্গনায় তা নেই। এখানে সুচিত শব্দের সুবিন্যাস ঘটেছে। তা ছাড়া ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে করুণ রস সৃষ্টিতে অসাধারণ শিল্প কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন মধুসূদন। এ কথা বলা অযৌক্তিক হবে না যে সমাজে কোন না কোন কারণে নিন্দিতা নারীর হৃদয় উদ্ঘাটন করে মাইকেল নারী ও নারীত্বকে বীরঙ্গনা কাব্যে ইউরোপীয় আদলে মহিমান্বিত করেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
tAmal sadagar ১৪ আগস্ট, ২০১৮, ৯:৩৮ এএম says : 0
Very good
Total Reply(0)
Doctorbachu ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৮:১৬ এএম says : 0
বীরাঙ্গনা
Total Reply(0)
BALARAM DAS ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৮:৫২ পিএম says : 0
সুন্দর,মনোগ্ৰাহী ।
Total Reply(0)
শর্মিষ্ঠা দাশ ২৫ মার্চ, ২০২০, ১:৪২ এএম says : 0
খুব বলিষ্ঠ উদ্যোগ।
Total Reply(0)
শর্মিষ্ঠা দাশ ২৫ মার্চ, ২০২০, ১:৪২ এএম says : 0
খুব বলিষ্ঠ উদ্যোগ।
Total Reply(0)
Sonu ১৫ আগস্ট, ২০২০, ৯:২৬ পিএম says : 0
Kub Valo lage cha to good..
Total Reply(0)
Sonu ১৫ আগস্ট, ২০২০, ৯:২৮ পিএম says : 0
খুব ভালো লাগলো এই কবিতা
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন