বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

লেখকদের চালিয়াতি

| প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাসার তাসাউফ

উইলিয়াম হেনরি আয়র্ল্যান্ড (১৭৭৭-১৮৩৫) যেমনি ছিলেন সাহিত্য প্রতিভা ও প্রখর বুদ্ধি তেমনি ছিলেন চালিয়াতির মানসিকতার। তার বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত পুস্তক ব্যবসায়ি, বিশেষত পুরোনো বই, পাÐুলিপি ও পুরাতত্ত¡ সংগ্রহে তার ছিল দারুণ আগ্রহ। মাত্র সাত বছর বয়সে একবার তার বাবার সাথে মহাকবি শেকস্পিয়রের জন্মস্থান দর্শনের জন্য স্ট্যাডফোর্ড অন এ্যাভনে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই তার মনে শেকস্পিয়রের সম্মোহক প্রভাব। প্রবল উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে তিনি শেকস্úিয়র চর্চা করতে থাকেন এবং কালক্রমে তিনি একজন বিখ্যাত শেকস্পিয়র বিশারদ হয়ে ওঠেন। চলনে-বলনে পোশাকে সর্বত্রই তিনি শেকস্পিয়রীয় রীতিকে অনুকরণ ও অনুসরণ করতেন। কিন্তু এত করেও তার খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা এল না। শেষ পর্যন্ত খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অন্য পথ ধরলেন। প্রথমে তিনি শেকস্পিয়রের স্বাক্ষর অবিকল নকল করেন। এরপর তার হস্তরেখারও। এ সময় তার প্রাথমিক পরিচয় একজন শেকস্পিয়রের সংগ্রাহক হিসেবে। নিজের রচিত বেশক’টি সনেট সেকস্পিয়রের অপ্রকাশিত সনেট নামে পত্রিকায় ছাপা হয়। কিছু কিছু নাট্যাংশও শেকস্পিয়রের অসমাপ্ত ও অপ্রকাশিত লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয়। এ ধরনের কাজকে সাহিত্যে চালিয়াতি বলা হয়।
উইলিয়াম হেনরি আয়র্ল্যান্ড কাজটি এত নিখুঁতভাবে করেছিলেন যে, তখন কারো মনে কোন সংশয় জাগে নি। লেখাগুলোর ‘ফুটনোটে’ লেখা হয়েছিল যে, একটি বাড়ির পুরনো কাগজপত্রের সাথে এ সমস্ত অপ্রকাশিত লেখা পাওয়া গেছে। এর পর আয়র্ল্যান্ড তার অমোঘ অস্ত্র ছুড়লেন। একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনা করে শেকস্পিয়রের নামে চালিয়ে নিলেন। নাটকটির নাম দিলেন ঠঙজঞওএঊজঘ অঘউ জঙডঊঘঅ। এর উৎস হলিন শেডের ‘ক্রনিকল’। মাত্র আঠারো বছর বয়সে দু’মাস পরিশ্রম করে তিনি এ নাটক রচনা করেছিলেন। নাটকে শেকস্পিয়রের ভাব, ভাষা ও স্টাইল এবং হস্তাক্ষর একেবারেই নিখুঁতভাবে ছিল। কাগজ, কালি ও কলমের ব্যবহারেও আয়র্ল্যান্ড কম চাতুর্যের পরিচয় দেন নি। এলিজেবেথিয়ান যুগের পুরনো বই থেকে সাদা কাগজ সংগ্রহ করে বিশেষ কালি ব্যবহার করেন। মূলত সমস্ত পাÐুলিপিতে একটি শেকস্পিয়রীয় আবহ ও ভাব এবং উত্তাপ ফুটে উঠেছিল। যার বাইরের দিকটা চিন্তা করলে একে কেউ জাল বা চালিয়াতি বলে সন্দেহ করার অবকাশ পায় নি।
শেকস্পিয়রের একটি নতুন নাটক পাওয়া গেছে জেনে সমস্ত ইংল্যান্ডে কি বিপুল উৎসাহ, আগ্রহ,আনন্দ ও উন্মাদনা! স্বয়ং প্রিন্স অব ওয়েলস আয়র্ল্যান্ডের বাড়ি এসে তাকে অভিনন্দন জানালেন এ বিস্ময়কর আবিষ্কারের জন্য। ১৭৯৬ খিস্টাব্দের এপ্রিল বিখ্যাত নাট্যকার মেরিভানের নির্দেশনা ও প্রযোজনায় ডরিলেন থিয়েটারে অসীম উৎসাহে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন শেকস্পিয়রের নাট্য চরিত্রের দক্ষ রূপকার ও কীর্তিমান অভিনেতা কেম্বল। সেদিন এ নাটকের অভিনয় দেখার জন্য সমস্ত লন্ডন শহর উল্লাসে ভেঙে পড়েছিল। নাটকের রয়্যালিটি হিসেবে আয়র্ল্যান্ডকে দেয়া হয়েছিল পাঁচ হাজার পাউন্ড। কিন্তু শেকস্পিয়রের নাটকের মহৎ উত্তাপ ও বিশালতা, গভীর জীবন দর্শন ও মানবমনের অন্তর্লীন রহস্য এবং দ›দ্ব ও সংঘাতের তীব্রতা আর ট্রাজেডির সেই রক্তক্ষরণ এ নাটকে ছিল না। নাটক হিসেবে ছিল খুব কাঁচা। তবুও দর্শক শ্রোতারা এমনকি শেকস্পিয়র বিশারদরাও একে শেকস্পিয়রের প্রথম জবিনের অপটু রচনা মনে করে আশ্বস্ত হয়েছিল। এভাবে চালিয়াতির মাধ্যমে বিত্ত ও খ্যাতি অর্জন করে শেষ পর্যন্ত আয়র্ল্যান্ড নিজেই একদিন সকলকে তাক লাগিয়ে এ রহস্যের জাল উন্মোচনা করে দিয়ে বলেন যে, এ নাটক শেকস্পিয়রের নয়, তার নিজেরই লেখা শুধু খ্যাতি অর্জনের জন্য তাকে এসব করতে হয়েছিল।
ফরাসি লেখক আলেকজান্ডার ডুমা (১৮২৫-১৮৯৫) নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প মিলে প্রায় বারোশত গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু একজন লেখকের পক্ষে কি এত গ্রন্থ রচনা সম্ভব? বাজারে তার বইয়ের বিপুল চাহিদা। বই বের হলেই হটকেকের মতো শেষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এমন হল যে, বইয়ে শুধু ডুমার নাম থাকলেই হল। ডুমাও গ্রহণ করলেন এ সুযোগ। ভাড়াটিয়া লেখকদের দিয়ে বই লিখিয়ে চালিয়ে দেয়া হতো তার নামে। এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর গল্প আছে। একদিন ডুমা নাকি তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তুমি আমার শেষ লেখাটা পড়েছো তো?’ ছেলেও তো আর কম নয়, সাথে সাথেই সে বাবাকে বলল ‘তুমি নিজে পড়েছো তো বাবা!’
প্রসপের মেরিম (১৮০৩-১৮৭০) প্রথম জীবনে ছিলেন নামকুলহীন এক অজ্ঞাত লেখক। কেউ তাকে চিনত না এবং লেখক হিসেবে পাত্তাও দিত না। নাটক লেখায় ছিল তার ভীষণ শখ। অনেক নাটকও লিখেছিলেন, প্রকাশকরা তাকে বিমুখ করেছে আর নাট্যকার হিসেবে কেউ তাকে স্বীকৃতিও দেয় নি। অবশেষে হতাশ হয়ে মেরিম খ্যাতি অর্জনের জন্য অন্য পথ ধরলেন। তার নিজের লেখা একটা নাটকই কøারা গাজর নামে এক মহিলার লেখা স্পেনিশ ভাষা থেকে অনুবাদ বলে চালিয়ে দেন। এমনকি অনুবাদের দায়িত্বটাও মেরিম নিজের ওপর বার্তায়নি, সেখানে এক কাল্পনিক অনুবাদকের নাম দেয়া হয়। গ্রন্থেও সম্পাদনায় অতীব পাÐিত্যপূর্ণ আলোচনায় মূল লেখক ও ফরাসি ভাষায় অনুবাদকের জীবনী ও সাহিত্যকর্মেও ওপর বিস্তৃত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছিল। বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই প্রসপের মেরিম পাঠক মহলে বিশেষত পÐিত মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং এ বইয়ের মাধ্যমেই তিনি বিখ্যাত হয়ে পড়েন। এক বিজ্ঞ লেখক ও সমালোচক মূল লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদকের সম্পাদনার ওপর আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, সম্পাদনা মোটামুটি ভালো হলেও অনুবাদ মূলের তুলনায় অনেকটা নিকৃষ্টমানের। হায়রে পাÐিত্য! কোথায় মূল লেখক, অনুবাদক ও অনুবাদ! এ যে চালিয়াতের ওপর চালিয়াতি!
আমাদের দেশে অনেকেই ইংরেজি ও ফ্যান্স সাহিত্যের খবর তেমন রাখেন না। অথচ যারা ভালো ইংরেজি ও ফ্রান্স ভাষা জানেন- তারা সেখান থেকে নিয়ে মৌলিক বলে চালিয়ে দেয়ার চালিয়াতি করে থাকেন। এমন চালিয়াতের সংখ্যা একেবারে কম নয়। আমার বন্ধুকে কবি খ্যাতির ভূত পেয়ে বসেছিল। অনেক করেও জাতীয় কোন পত্রিকায় লেখা ছাপাতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত নিজের লেখাকেই অনুবাদ বলে জাতীয় পত্রিকায় ছাপিয়েছে। সাহিত্যে এ ধরনের ঘটনা অতীতে হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আমরা শুধু বলব পর প্রভাবকে আত্মস্থ করে লেখা আর লেখাকে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া এক নয়।
অ প রি হা র্য
১. সাহিত্যে চালিয়াতি : ড. সফি উদ্দিন আহমদ
২. চালিয়াতি সাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ : অরবিন্দ রায়
৩. বিশ^সাহিত্যের আলোচিত ঘটনা : রিপন ঘঠক

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন