আলম শামস
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি ভালোবাসতেন ছোটদের। তাই তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন বেশ কিছু মজার মজার বই। যার জন্য আজ তিনি ছোটদের কাছে খুব পরিচিত একটি নাম। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর বইগুলো হল- নীল হাতি, তোমাদের জন্য রূপকথা, টগর এন্ড জেরি, তিনি ও সে, প্রিয় ভয়ংকর, পরীর মেয়ে মেঘবতী, কানি ডাইনি, কাক ও কাঠগোলাপ, জন্মদিনের উপহার, এই ছেলেটা, বোতল ভূত, পুতুল, সূর্যের দিন, ছোটদের সেরা গল্প, ছোটদের যত লেখা, ছোটদের জন্য এক ব্যাগ হুমায়ূন ইত্যাদি।
আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের ডাক নাম ছিল কাজল। ছোটদের নিয়ে খুব ভাবতেন তিনি। আর তাই তো খুব সহজেই ছোটদের মনের মাঝে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।
একদিনে হুমায়ূন আহমেদ তৈরি হননি। অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে তিনি হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠেছিলেন। লেখালেখি করে তিনি সবার কাছে এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান আর হয়তো কেউ দখল করতে পারবে না।
ছোটদের প্রিয় এই লেখক ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত ছিলেন। একবার হুমায়ূন আহমেদের মেজো চাচা তাঁকে কিশোরীমোহন পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দেন এবং সেখানে তিনি প্রথমদিনেই হাতের কনুই দিয়ে মেরে একটি ছেলের সামনের দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন। কী সাংঘাতিক কথা, তাই না?
অবশ্য এর জন্য হেডমাস্টার সাহেব যতক্ষণ ক্লাস চলেছিল, ততক্ষণ তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। আর ক্লাসের সবাইকে বলেছিলেন, সাবধান থাকবে, ও কিন্তু পুলিশের ছেলে। আর পুলিশের ছেলেরা গুন্ডা হয়।
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্লাস সিক্সে পড়েন। পড়া বলতে না পারায় স্যার তাঁর গলায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। আর তাতে লেখা ছিল- ‘আমি পড়া পারি নাই আমি গাধা’। এভাবে তাঁকে সারা স্কুল ঘুরতে বলা হলে তিনি গলা থেকে সাইনবোর্ড খুলে ফেলেন আর স্যারকে বলেন, “আপনি গাধা!”
তারপর এক দৌড়ে স্কুল থেকে পালিয়ে গেলেন। পরে অবশ্য ঐ স্যারের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিয়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ শুধু দুষ্টুমি করতেন, তা শুধু নয়। তিনি কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। সবসময় ভালো রেজাল্ট করতেন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
সেখান থেকে ফিরে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু লেখা যার রক্তে মিশে আছে, তাঁর কি অধ্যাপনা মানায়? তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণেও আত্মনিয়োগ করেন।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সৃষ্টি হিমু এবং মিসির আলী। যুক্তির বাইরে চলা এক খামখেয়ালি যুবক হলো হিমু। মিসির আলী একজন মধ্যবয়সী যুক্তিবাদী অধ্যাপক। এ দুটি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি লজিক আর অ্যান্টিলজিকের দোলায় দুলিয়েছেন কোটি পাঠককে। হুমায়ূন আহমেদের আরও দুটি জনপ্রিয় চরিত্র হল শুভ্র এবং রূপা।
হুমায়ূন আহমেদ সবসময় প্রকৃতি ও ছোটদের ভালোবাসতেন। মিশে থাকতে চেয়েছিলেন ছোটদের মাঝে, প্রকৃতির মাঝে। আর তাই তিনি গাজীপুরে তৈরী করেন নুহাশ পল্লী, যেখানে তিনি চির নিন্দ্রায় শায়িত আছেন। আমাদের সকলের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ ১৯ জুলাই, ২০১২ ইন্তেকাল করেন।
আত্মায় হুমায়ূন
শাহীন রেজা
চলে গেলো পাঁচটি বছর। সময়টা খুব দীর্ঘ হলেও মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের কথা। চলে গেলেন নন্দিত সুজন হুমায়ূন আহমেদ। নরক কি নন্দিত হয় কখনো? নন্দিত নরকের উচ্চারন তাঁর পক্ষেই সম্ভব- যিনি আশ্চর্য অসীমের মধ্যে সীমাবদ্ধ সুন্দরের আবিস্কারে সক্ষম। হুমায়ুন আহমেদ আমাদের মধ্যবিত্ত ভুবনের এক একান্ত অনুভব। যার সৃষ্টি প্রতিমূহুর্তে নিজেকে চেনায়; মনে হয় এতো আমি এতো আমারই অনুভব। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর চিন্তা চেতনা ও মানসিকতায় তরী ভাসানো এ নাবিক তার সহজসিদ্ধ বিন্যাস আর সরল প্রকাশ ভঙ্গিমার জন্য আমাদের সাহিত্যে মিথ হয়ে উঠেছেন। তার রচিত হিমু, মিসির আলী কিংবা কাজল- এই সব চরিত্রগুলো যেন একএকজন আমাদেরই একজন।
অমর নির্মাতা হুমায়ুন বাংলাদেশের কথা সাহিত্যকে পশ্চিম বংগীয় আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছেন। সুনীল- সমরেশের বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে একটি নতুন ও একক বৃত্ত তৈরী করে রচনা করেছেন একটি ইতিহাস। এ ইতিহাস শুধুমাত্র আমাদের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। একটি বইমেলা যে শুধুমাত্র একজন লেখককে ঘিরে অর্থবহ ও উদ্দাম হয়ে উঠতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত হুমায়ুন আহমেদ। হুমায়ুন নেই কিন্তু প্রতিমুহুর্তে তার ছায়া তার উপস্থিতি রয়ে গেছে আমাদের অনুভবে আমাদের চেতনায়। হুমায়ুনহীন বাংলায় তারই সুরে হয়তো কখনো গেয়ে উঠবেন কেউ কিন্তু যিনি কোকিল তিনি কোকিলই থাকবেন, চড়–ই শালিক কি কখনো কোকিলের বিকল্প হতে পারে?
হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন দুঃখবোধে আক্রান্ত একজন মানুষ-এর প্রমান পাওয়া যায় তারই লেখায়।‘ আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’ গ্রন্থে হুমায়ুন লিখেছেন-
‘এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি। বারবার হৃদয় হা-হা করে উঠেছে। চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে কতোবার মনে হয়েছে- এই পৃথিবী বড়ই বিষাদময়। আমি এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য পৃথিবীতে যেতে চাই, যে পৃথিবীতে মানুষ নেই। চারপাশে পত্রপুষ্প শোভিত বৃক্ষরাজি। আকাশে চির পূর্নিমার চাঁদ। যে চাঁদের ছায়া পড়েছে ময়ূরাক্ষী নামের এক নদীতে। সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষন খেলা করে জোছনার ফুল। দূরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত। ’
দুঃখবোধে আক্রান্ত হতে হতে চির পূর্নিমায় অবগাহন আর জোছনার ফুল তুলতে তুলতে দূরের বন থেকে অপার্থিব সংগীত শ্রবণের আনন্দ এ মানুষটিকে নিয়ে গেছে সৃষ্টির গভীরে। অনন্য সব রচনায় তিনি ভাস্বর হয়েছেন একে একে। তার আনন্দ এবং বেদনা জুড়ে যেন এক মহাকালের মহাকাব্য। তিনি যা রচনা করেছেন তাই হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। পাঠক হৃদয় স্পর্শের এক যাদুকরী ক্ষমতা নিয়ে কলম হাতে তোলা এ কথা সাহিত্যিক একের পর এক রচনা দিয়ে হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন পাঠকদের আর নিজেকে তুলে এনেছেন পাহাড়সম খ্যাতি আর ভালোবাসার উচ্চতায়।
হুমায়ুন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক। অনেকের প্রশ্ন- জনপ্রিয়রা কি কালজয়ী হন্? হুমায়ুন প্রসঙ্গে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও পঞ্চাশ কিংবা শত বছর। তবে এ মুহুর্তে যে কথাটি বলা যায় তা হচ্ছে হুমায়ুন পাঠকদের হৃদয়ে প্রবল ভাবে প্রবিষ্ট একজন সাহিত্যকার। মৃত্যুর পরও তাকে ঘিরে পাঠকদের যে অনুভব যে ভালোবাসার বলয় তা নি:সন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা তার সাহিত্যের অমরত্ব প্রত্যাশা করতে পারি নি:সন্দেহে।
একটা কথা অনেকেই জানেন না যে, হুমায়ুন আহমেদের প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত রচনাটি একটি কবিতা। কবিতাটি তিনি রচনা করেন ইংরেজীতে, নাম ‘এড়ফ’। এটি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে ছাপা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন