আকিব শিকদার : অরুন্ধতী রায়। জন্ম: ২৪ নভেম্বর, ১৯৬১। একজন ভারতীয় ঔপন্যাসিক, বুদ্ধিজীবী এবং অ্যাকটিভিস্ট। তিনি পরিচিত হয়ে আছেন তাঁর পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংসের জন্যে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি ১৯৯৮ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেছিল। এছাড়াও তিনি পরিবেশগত সংশ্লিষ্টতা এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়েও জড়িত আছেন।
গত কুড়ি বছরে অরন্ধতীর লেখালেখি নিয়ে তার সাহিত্যের গুণগ্রাহীরা অনেকেই ধাঁধায় পড়েছেন। তিনি কি যথার্থই সাহিত্যিক, নাকি তার প্রথম উপন্যাস একটা আকস্মিক ঘটনা? তার প্রথম উপন্যাস “দ্য গড অব স্মল থিংস” (‘ক্ষুদ্র জিনিসের ঈশ্বর’) যখন প্রকাশিত হয়, তখন তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। অরুন্ধতীর বয়স তখন ৩৫। কাহিনি এক ক্ষয়িষ্ণু ভারতীয় পরিবার নিয়ে। সেই পরিবারে নানান বেদনাময় সঙ্কট, কেলেঙ্কারি। বইটি বিলেতের বিখ্যাত বুকার প্রাইজ পায়। ৪২টি ভাষায় ৮০ লক্ষ বই বিক্রি হয়। এক অখ্যাত চিত্রনাট্যকার রাতারাতি হয়ে যান আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। অনেকেই ধরে নেন অরুন্ধতী তার প্রজন্মের সাহিত্যিক কণ্ঠস্বর হতে যাচ্ছেন।
অরুন্ধতী বহু নিবন্ধ-প্রবন্ধ লিখেছেন, নানা বিষয়ে আলোচনামূলক বই লিখেছেন, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ, পরিবেশ বিনষ্টকরণ, তীব্র অসাম্য, এসবের বিরূদ্ধেও প্রতিবাদ করেছেন। কাশ্মীরের স্বাধীনতা, মাওবাদী বিদ্রোহী আর আদিবাসীর জমির অধিকার, এসবের পক্ষে আন্দোলন করেছেন। মার্কিন সাপ্তাহিক ঞরসব পত্রিকার বিশ্বের ১০০জন শীর্ষ প্রভাবশালীদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।
তিনি কি সাহিত্যিক? অরন্ধতীর উত্তর: “কথাসাহিত্যের ওপরে কিচ্ছু নেই। আমি মূলত কথাসাহিত্যিক। আমি গল্প বলি। পৃথিবীকে বুঝতে, ঠিক কী খেলা চলছে এখানে, সেটা বোঝার ঐ একটাই পথ আমার।”
অরুন্ধতী পড়াশোনা করেছেন স্থাপত্যকলা নিয়ে, পাশাপাশি আরো অনেক বিষয়ে আগ্রহ ছিল তার। তবু তিনি মনে মনে জানতেন যে, শেষমেশ লেখালেখির দিকেই তাকে আসতে হবে। বর্তমানে ৫৫ বছরের অরুন্ধতী বিবিসি রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘আমার মা ছিল অনেক রাগী ও সুন্দরী এক মহিলা। যখন আমার তিন বছর বয়স, তখনই আমি মনে মনে একজন লেখিকা ছিলাম, কারণ এত কম বয়সে একজন বড় মানুষ তোমাকে শাসন করছে, কারণ তার নিজের মনটাই ভেঙে গেছে এটা বোঝা বেশ শক্ত। শিশুরা সাধারণত এসব বোঝে না, তবে লেখিকা শিশুরা সম্ভবত বোঝে।’
তার প্রথম উপন্যাসের অনুপ্রেরণা পরিবারের ছেলেবেলার কাহিনি থেকে, আর তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ ও ভিন্ন অর্থে আত্মজীবনীমূলক। অরুন্ধতীর দ্বিতীয় উপন্যাসটি এক বেদনাত্মক প্রেমের গল্প, আবার তা প্রতিবাদেরও গল্প। যা আমাদের আশেপাশেই শোনা যায়। এ উপন্যাসেও অরুন্ধতী মানবিকতার জয়গানই লিখেছেন। যেখানে মানুষের প্রেম, আশাবাদ আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে কাহিনী এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এইবার তিনি তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের স্বভাব আর মানসিকতাকে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘এই যে আমি এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দিল্লীতে যেমনটা করি, মসজিদে বা অদ্ভুত সব জায়গায়, আমি সারাজীবনই এমন করেছি, সেসব নিয়ে লিখতে চেয়েছি। এই যে সব পাগলের দল, এত ভাল মানুষের দল, এদের কথা ভেবে আনন্দ পাওয়া, খুব দুঃখের জায়গাতেও একটু সুখ পাওয়া, এই যে কত ব্যাপার আছে যে ভাবাই যায় না, এইসব।’ সামাজিক দৃষ্টিতে হীনতম লোকটির ব্যাপারেও অরুন্ধতীর আগ্রহ, তিনি তার সাহচর্য চান। ‘আমি কাউকে পাশ কাটিয়ে, এড়িয়ে যেতে চাই না। আমি চাই তার সাথে বসে আড্ডা মারতে। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকে শুধাতে – কী ভাই, কেমন চলছে সব?’ আমারতো মনে হয় এইসব নিয়েই আমার বই।
‘জাতিভেদের উদ্দেশ্যই হলো মানুষে মানুষে এমনভাবে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা যাতে কোনভাবেই আর মানুষের একতাবদ্ধ হবার উপায় না থাকে। কারণ নিচু জাতির মধ্যে আবার গোত্র আছে, আরো ভাগ আছে। সবাইকে এই আধিপত্যের ক্রমানুসারে গঠিত, পরস্পর বিচ্ছিন্ন গণ্ডিবদ্ধ সমাজ রক্ষার কাজে লাগানো হয়েছে। এই হলো শ্রেণি, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম অনুযায়ী ছক তৈরির রাজনীতি। সেই ছককে আরো সু² ভাগে ভাগ করাটা গোটা পৃথিবীকে তাঁবে রাখার অপরিহার্য অংশ। মানুষকে এই কথা বলে বশীভূত রাখা: ‘তুমি মুসলমান, তুমি হিন্দু, তুমি শিয়া, তুমি সুন্নি, তুমি বারেলভি, তুমি ব্রাহ্মণ, তুমি সারস্বত ব্রাহ্মণ, তুমি দলিত, তুমি সমকামী, তুমি অপর লিঙ্গের প্রতি আসক্ত, তুমি লিঙ্গত্যাগী – তাই তুমি শুধু নিজের পক্ষেই কথা বলতে পারো, কারো সাথে ঐক্যবদ্ধ হবার কোন পথ নেই।‘ অর্থাৎ মানুষ যাকে মুক্তি ভাবছে সেটা বাস্তবে দাসত্ব।‘
ন্যায়, সমতা আর মুক্ত পৃথিবীর পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর অরুন্ধতী রায় বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিশ্বজুড়ে এক পরিচিত নাম। ভারত থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন তিনি। ইরাক-আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন শাণিতভাবে। কাশ্মিরের জনতার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে দাঁড়িয়েছেন নিজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ভারতের মাওবাদী আন্দোলন নিয়ে মূলধারার বুদ্ধিজীবী এবং এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অবস্থান নিয়েছেন তিনি। পেয়েছেন ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র খেতাব।
অরুন্ধতী রায় দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন ‘মানুষ মানুষকে হত্যা করতে, পিটিয়ে বা গুলি করে মারতে, জ্বালিয়ে দিতে বা গণহত্যা করতে যে ধরনের হিংসার আশ্রয় নিচ্ছে তা বর্ণনা করার জন্য অসিহষ্ণুতা শব্দটা মোটেও যথেষ্ট নয়’।
অরুন্ধতী নিউইয়র্ক থেকে জর্জিয়া স্ট্রেইটকে ফোনে বলেন, “সব সম্পদ খুব অল্প সংখ্যক হাতে জমা হয়েছে। এবং এই অল্প সংখ্যক কর্পোরেশন এখন দেশ চালায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। তারা মিডিয়াও চালায়।”
উত্তর প্রদেশের দাদরি জেলার বিসারা গ্রামে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে মোহাম্মদ আখলাক নামে এক মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করে উগ্রপন্থি হিন্দুরা। এর কয়েকদিন পর জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দা ১৯ বছরের যুবক জাহিদ আহমেদকে একই অভিযোগে তার ট্রাকে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়। এসব ব্যাপারে অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘গরু খাওয়াকে কেন্দ্র করে যেসব দুর্বৃত্ত এই দুজনকে হত্যা করেছে, তাদের নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত হত্যাকারী তো ওরা নয়। যে রাজনীতি বর্তমান এ অবস্থার জন্য দায়ী, সেই রাজনীতিই মূলত তাদের হত্যাকারী।’
‘জাতের বিরুদ্ধে লড়াইটা বেশ জটিল’ মনে করেন প্রখ্যাত এই লেখক। তাঁর মতে, ‘দার্শনিকভাবে বলতে গেলে, অধীনস্ত জাতগুলোকেও তাদের পরিচয়ে গর্ববোধ করতে হবে এবং জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেই গর্বকে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু তখনই মূল বিষয়টা চলে আসে, যেখানে এর বিরুদ্ধে সেই বিপ্লবী অবস্থানই ব্যবহৃত হয় একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে এবং এটি সুবিধাভোগীদের অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
এখনও পর্যন্ত দু’টো ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন অরন্ধতী। ১৯৮৯-এর ‘অ্যানি’ এবং ১৯৯২-এ ‘ইলেকট্রিক মুন’। এর মধ্যে ‘অ্যানি’ চিত্রনাট্য ও ইংরেজিতে সেরা ফিচার ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। এই ছবিতেই অভিনয় করেছিলেন শাহরুখ খান। প্রদীপ কৃষেণ পরিচালিত এই ত্রিভাষিক ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য ছিল অরুন্ধতীর। পাশাপাশি রাধা নামের একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
তিনি ‘ইন হুইচ এনি গিভস ইট দোজ ওয়ানসে’র জন্যে ১৯৮৯ সালে সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে ন্যাশনাল ফিল্ম এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। ২০০২ সালে তিনি লান্নান ফাউন্ডেশনের সাংস্কৃতিক মুক্তি পুরস্কার লাভ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন