ড. গুলশান আরা : ‘মহাশ্মশান কায়কোবাদের পরিণত বয়সের শিল্পকীর্তি। কবি জীবনের প্রস্তুতি পর্বে তিনি খন্ড কবিতা বা গীত-কবিতায় মানস গঠন করেছেন। এ সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য-‘অশ্রুমালা’ যখন লিখি, তখন আমার হৃদয়টি নন্দন কাননের মত ফুলে ফলেও ফজরী মকুলে সুশোভিত ছিল। ‘মহাশ্মশান’ স্বর্গ, ‘অশ্রুমালা’ মর্ত। এ দুই আখ্যান কাব্যে স্বর্গ মর্ত প্রভেদ। ‘অশ্রুমালাতে কেবল কবির অশ্রুজল, আর ‘মহাশ্মশানে’ হিন্দু ও মুসলমান সা¤্রাজ্যের অতীত খ্যাতির চিতাভাস্ম।’
রবীন্দ্রনাথের মতে গীতিকবিতা ‘একলা কবির কথা’। কিন্তুু শিল্পে, সাহিত্যে কবির উপলব্ধি যখন সুচারু রূপে পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয় তখন তা পাঠকের মনের অনুভব, উপলব্ধির অংশও হয়ে দাঁড়ায়। যে লেখক নিজের ভাব চেতনা বা অনুভূতিকে যতখানি পাঠকের মনের ভাবনায় তুলে দিতে পারেন তিনি ততখানি সফল বলে মনে করা যায়।
কায়কোবাদের সাহিত্য সাধনার বড় কৃতিত্ব এই যে তিনি একাধারে গীতিকবি এবং সফল গীতিকবি অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম মহাকবি।
রবীন্দ্রযুগ ধরে বেঁচে থেকেও তিনি কখনও হেম-নবীনের মোহমুক্ত হতে পারেননি। তার প্রথম কবিতা গ্রস্থ দুটিও তাদের প্রভাবে ও অনুকরণে লিখিত। ‘বিরহ বিলাস’ হেমচন্দ্রের ‘চিন্তা তরঙ্গিনী’ এবং ‘কুসুম-কাননে’ নবীনচন্দ্রের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। এসব একটি বিচ্যুতি সত্তে¡ও স্বীকার না করে উপায়, নাই যে তিনিই একমাত্র মুসলমান কবি যিনি সর্ব প্রথম অপসংস্কৃত ও গ্রাম্য পুঁথি সাহিত্য আর দোভাষী রচনার আগল ভেঙ্গে সে খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন আর সবার আগে শিক্ষিত জনের ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার সামান্য পূর্ববর্তী কবি সৈয়দ হামজার ভাষা-
‘দেওজাত ঘোড়া যবে পাইল আমির।
বাঞ্জিল তাহার নাল খোওয়াজ খেজির।’
সেই তুলনায় কায়কোবাদের ‘জন্ম ভূমি’র ভাষা আধুনিক-
এই না জন্ম ভূমি সুখের সদন, সুশোভিত নানা দৃশ্য অতুল সুন্দর! স্থানে স্থানে তরুলতা নয়ন রঞ্জন রচিয়াছে কত শত কুঞ্জ মনোহর!
(জন্ম ভূমি-অমিয় ধারা)
পরাধীনতার জন্য কবির বেদনাবোধ ধ্বনিত হয়েছে “ভারতের বর্তমান অবস্থা দর্শন কোন এক বঙ্গ মহিলার বিলাপ” কবিতার ভারতবাসীরা, দাসত্ব শৃঙ্খল, দিয়াছে সাধেতে আপন গলায়/ কাদিলে এখন হইবে কি ফল করমের লেখা, কে কোথা এড়ায়।...
প্রেম ও বিরহ পর্যায়ের ... ‘অশ্রুমালা’। এই কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দে। প্রকাশের পর পরই ‘অশ্রুমালা’
সর্ব সাধারনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ ঊনিশ শতকে মুসলমান কবি সাহিত্যিকের যথার্থ অভাব ছিল তাছাড়া মুসলমানগণ বাংলা সাহিত্যকে তখনও পর্যন্ত অনেকটাই ঘৃণার চেখে দেখতো- সেই সময়ে নতুন ধারার একাব্য হিন্দু-মুসলমান সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। এর ভাষা ছিল বিশুদ্ধ এবং প্রাঞ্জল, আত্মগতভাব-উচ্ছ¡স ও ছিল যর্থাথ আন্তরিক। ‘অশ্রুমালা’য় বিরহ-তাপিত মনের একান্ত ক্রন্দন বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। এছাড়াও ‘অশ্রুমালা’ কাব্যের অনেকগুলো কবিতায় মুসলমানদের প্রাচীন সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যের কথা স্মরণ করে কবিকে দু:খ প্রকাশ করতে দেখা যায়। মুসলমানদের বর্তমান দুরাবস্থা কবিকে বেদনার্ত করেছে-তাই তিনি অতীতের সমৃদ্ধ যুগকে স্মরণ করেছেন, ‘সিরাজ সমাধি; ‘ মোসলেম শ্মশান,’ ‘ শ্মশান সংগীত’ প্রভৃতি কবিতায়।
কায়কোবাদের সমসাময়িক যুগে সব কবিই ব্যাপকার্থে মুসলিম জাগরণের কবি। সমাজকে সম্বোধন করে তারা জানিয়েছেন। জাগরণের আহ্বান। পুনরুজ্জীবনবাদী কবিতা মূলত স্বধর্ম ভিত্তিক হয়ে থাকে। তার কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়-
‘সবাই জেগেছে বিশ্বে কেহইত নাহি আর ঘুমে,
শুধু কি একাই তুমি রহিবে পড়িয়া এই ভূমে?
.....
আজ বিধাতার শুভ আর্শীবাদলয়ে শির’পরে
এসো হে মো¯েøম এস মিলনের এ মহা প্রান্তরে।
(ঈদ আহ্বান : অশ্রু মালা)
(প্রাণের বীনা/ অমিয় ধারা)
কাজী নজরুল ইসলাম ‘ লা-শরিক আল্লাহ’ কথাটা নৈপুণ্যের সঙ্গে প্রয়োগ করে প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিলেন কাব্য রচনার প্রথম দিকে। অনেক সময়ই তার ঈশ্বরানূমত্যে সূফী ভাবার্দশ দ্বারা অনুপ্রাণিত, বাউলতন্ত্রের সঙ্গে মিল আছে, ‘আমি কে’ কবিতায় তিনি প্রশ্ন করেছেন- ‘আমি কি তোমারে ছাড়া?
তুমি কি ব্রহ্মান্ড ভরা?
কোথা তবে তুমি আমি? –কত ব্যবধান?
‘অনিয়ধারা’ কাব্যে-সুফীমতের ছোঁয়া আছে। ‘তার দুয়ারে’ কবিতায় কবি ¯্রষ্টকে বাউলের ভাষায় “অধর ধরা” কে খুঁজছেন- ‘প্রাণ চাহিছে সদা যারে! আমি এসেছি আজ তার দুয়ারে! আমি নেচে গেয়ে তার পাছে পাছে ছুটে বেড়াই দিবানিশি! ধরি ধরি করি তারে বায়ুর সনে যায় সে মিশি।
রাম প্রসাদী ভাবও তার কবিতায় বিরাজ মান-
আমায় আর কাঁদাবে কত। আমি সংসার-চক্রে ঘুরে বেড়াই কলুর চোখ-ঢাকা বলদের মত। শোনা যায় গিরিবালা দেবী নামে এক হিন্দু বালিকার সঙ্গে বাল্যকালে তার প্রেম ছিল। কবির রচনা দ্বারাও তা সমর্থিত, তাই বোধ হয় প্রেমের কাছে সম্প্রদায় ধর্মের গন্ডীকে তিনি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত-‘দূর হ’ক জাতি ধর্ম, হ’ক কানাকানি।’
প্রেম এবং প্রকৃতি প্রায় পাশাপাশি এসেছে তার কবিতায়। প্রকৃতি বিষয়ে এত বেশি কবিতা তার আমলে অন্য কোন কবি লিখেননি। আজীবন পল্লী প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করে প্রকৃতি প্রেমিক হয়েছেন কবি। সামান্য বনফুল নিয়েও অসামান্য কবিতা লিখেছেন তিনি। সে যে বন ফুল।
না পরে ঢাকাই শাড়ী, বানারসী, নীলাম্বরী,
বাঁধে না কবরী, তার এলোথেলো চুল।
সে যে বন ফুল!
(বনফুল অশ্রুমালা)
‘বসন্ত’ কবিতায় লিখেছেন-
সুখের বসন্ত এলো ধরনীর’ পরে,
ফুটিল কুসুম গুলি থরে থরে থরে।
(বসন্ত : অমিয়ধারা)
ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার আগলা গ্রামে ১৮৫৮ খৃস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন মহাকবি কায়কোবাদ। গ্রামের পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার হয়েই জীবন কাটে তার। ঊনবিংশ শতাব্দীর আদর্শবাদী এই কবি শেষ জীবনে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১৯৫২ খৃস্টাব্দের জুলাই মাসের ২১ তারিখে ইন্তেকাল করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন