মাহমুদ কামাল : যেদিকেই পাশ ফিরি, চোখ রাখি এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের তপ্ত বাতাস সবতাতেই তিনি। এক শব্দেই তাকে বাঁধি,‘অপরিহার্য।’ কি পদ্যে কি গদ্যে আর গানেÑ সর্বত্রই। ষড় ঋতুর ছবি এঁকেছেন কথায় এবং সুরে দিয়েছেন ছড়িয়ে। ঋতু পর্যায়ের এমন অনবদ্য গানগুলো প্রকৃতিকে নবায়ন করে বারবার। এবং হৃদয়ে। প্রেম কিংবা পূজা পর্বেও অনন্য। গান ‘একান্তই অন্তরের কথা’Ñ তিনি লিখেছেন, ‘কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না।’ অর্থাৎ তাঁর অস্থি মজ্জায় শিশুকাল থেকেই কথা ও সুর লুকিয়ে ছিল।
এ তো গেল গান। বিষয় এবং বিষয়ান্তরের কবিতাগুলো পাঠক হৃদয়ে যুগে যুগেই। রূপনারায়ণের কূলে জেগে ওঠে তিনি মানুষ ও প্রকৃতির রূপচিত্র আমৃত্যু এঁকেছেন। ভুল হতে পারে ভেবে সংশয়ে বলেছেন, ‘ অনিত্যের যত আবর্জনা/ পূজার প্রাঙ্গণ হতে/ প্রতিক্ষণে করিয়ো মার্জনা।’
কোথায় নেই তিনি। প্রেম ও প্রকৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র, হৃদয়ের অন্তর্নিহিত বেদনা ও উচ্ছাস এসবই তিনি রবীন্দ্রময় করেছেন দীর্ঘ জীবনে দীর্ঘ রচনাসমগ্রে। সামাজিকতায়ও অগ্রবর্তী। এসব নিয়ে অজস্র লেখালেখি হয়েছে। বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ এবং শেক্সপীয়রের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে পৃথিবীব্যপি সবচেয়ে বেশি লেখালেখি হয়েছে। তবে, নিজ নিজ ভাষার সাথে যদি তুলনা করলে ইংরেজি ভাষায় শেক্সপীয়রের চেয়ে বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের আলোচনা এবং গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে অনেক বেশি। যদিও এর কোনও পরিসংখ্যান এখনও বের হয়নি। ভারত ও বাংলাদেশে রবীন্দ্র সাহিত্য কতজনকে যে পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে তারও পরিসংখ্যান নেই। রবীন্দ্রযুগে তাঁকে যারা অনুসরণ করেছেন তারা কেউ টিকে নেই। রবির আলোতে ভস্ম হয়েছেন অনেক শক্তিমান কবি। তিনি জীবদ্দশায় সাহিত্যের যে সিংহাসনে বসেছিলেন মৃত্যুর এতদিনেও তিনি সিংহাসন চ্যুত হননি। উপমাটি অদ্ভুত হলেও বলি, রামের বনবাসের পর তাঁর জুতো জোড়াকে যেমন সিংহাসনে বসিয়েছিলেন প্রজারা তেমনি এখনও রবীন্দ্রসাহিত্য মাথার উপরেই রয়েছে। বিষয়বৈচিত্রে তাঁকে এখনও কেউ পেছনে ফেলতে পারেননি। নতুন ধারার প্রত্যাশি পঞ্চাশের কিছু তরুণ কবি যেমন লিখেছিলেন, রবীন্দ্র রচনাবলী লুটোয় ধূলায় পাপোশে ( স্মৃতি বিভ্রমের কারণে বাক্যটি সঠিক নাও হতে পারে ) তাঁদের বয়স যখন একটু বেড়েছে তাঁরাই রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলেছেন। যুগে যুগে রবীন্দ্রবিরোধিতা কম হয়নি। জীবদ্দশায় এ নিয়ে তিনি কম যাতনার মুখোমুখি হননি। যারা তাঁর যুক্তিহীন কট্টর সমালোচক ছিলেন নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর যখন সেই বিদুষকেরা তাকে সংবর্ধনা দিতে চেয়েছিলেন তখন তিনি বিদেশ থেকে দেশে ফিরছিলেন। তাদের সংবর্ধনা নিতে হবে জেনে তিনি সরাসরি কলকাতা আসেননি। দুঃখবোধ বুকে এঁটে ছিল বলেই বিশাল মাপের এই চির ভাস্বর বিমুখ হয়েছিলেন তাদের সংবর্ধনা থেকে। রবীন্দ্রনাথ কি এখনও বিভাজনের স্বীকার হচ্ছেন না? এ বিভাজন ধর্মীয়। কিন্তু ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকেই তার ধর্ম বিবেচনা করেছেন। মুসলিমসমাজ নিয়ে তাঁর লেখা হাতে গোণা হলেও তার মানে এই নয় তিনি মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্বের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের প্রথম খÐের ( লেখক আবদুল করিম ) ভূমিকায় লিখেছেন,‘ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খÐবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচÐ আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারন করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহারা যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খÐ তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচÐ সূর্যের উদয় হইল, এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রোত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল। তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত, এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না; সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নতুন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নতুনসৃষ্ট মুসলমান জাতির বিশ্ববিজয়োদ্দীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।’
দীর্ঘজীবন ছিল তাঁর, জীবনব্যাপি দুঃখও ছিল। জীবদ্দশায় অসংখ্য প্রিয়জনের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন। যথাক্রমে এরা হলেন, মাতা সারদাসুন্দরী দেবী, নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী, ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ , আরেক ভ্রাতুষ্পুত্র নীতীন্দ্রনাথ , স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, মেজো মেয়ে রেনুকা , পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কনিষ্ট পুত্র শমীন্দ্র, বড় মেয়ে মাধুরীলতা, ভাই সোমেন্দ্রনাথ , আরো দুই ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রনাথ , ভ্রাতুষ্পুত্র সুধীন্দ্রনাথ , একমাত্র নাতি নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং দুই ভ্রাতুষ্পুত্র গগনেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ। এইসব মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে ব্যাথিত করলেও পুষ্ট হয়েছে তাঁর সাহিত্য পরিধি। প্রতক্ষ কিংবা পরোক্ষে চরিত্রগুলো জায়গা নিয়েছে তার লেখায়।
আমরা বলেছি, তিনি অপরিহার্য অর্থ্যাৎ তার রচনা আমাদের মনোভূমিকে সব সময়ই সামনের দিকে নিয়ে যায়। খুলে যায় সকল ঝরোকা। ‘মুক্ত করো হে বন্ধ’ বলেছেন তিনি। খুলে যাওয়া দরোজায় আমরা প্রবেশ করি এবং বেরিয়ে পরি প্রগতির পথে। তিনি তো সবখানেই আছেন। এমনকি কুসুমে কুসুমেও তিনি। আক্ষেপও করেছেন দ্রæত বেলা ফুরিয়ে যাওয়ার। বেলা তার দীর্ঘই ছিল। এ কারণে তার নানবিধ বিপুল ভাÐার আমাদের নিত্য সামগ্রী। তিনি তখনও এবং এখনো অপরিহার্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন