সেগুন্দো সোম্ব্রা
লোকমান তাজ
লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সে দেশকে এনে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র পরিচয়। সেই স্বাতন্ত্র্যের উদঘাটন মাটি উপন্যাসগুলোর প্রধান উপজীব্য। প্রতিটি দেশের চরিত্রের মুখ্য নির্ণায়ক তার ‘মাটি’। মাটির গল্পের লেখকরা সাধারণত নগরকেন্দ্রিক ছিলেন, রাজধানী শহরের বাসিন্দা। কিন্তু চরিত্রের খোঁজে তারা গ্রামাঞ্চলে গিয়ে লোকজ জীবনধারা অনুসন্ধান করতেন। তবে ২০শ শতকে তাদের সহায় হয় সমাজবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশমান শাখাগুলোর শক্তিশালী সব কলাকৌশল। পুরো লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে তখন নতুন জোয়ার এসেছে। বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়, তথা সমগ্র মহাদেশের আত্মপরিচয় খোঁজার শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টায় নেমেছেন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা। ‘মাটির উপন্যাস’ যেন গদ্যক্ষেত্রে সেই জোয়ারেরই একটি ঢেউ। সেই ঢেউয়ের প্রধান নাবিক হয়ে হাল ধরেন রিকার্দো গুইরাল্দেস। আইরেসে জন্মগ্রহণ করা ধনী পরিবারের সন্তান রিকার্দো গুইরাল্দেস তাঁর শৈশব কাটান ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। সাহিত্যাঙ্গনে গুইরাল্দেসের খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৬ সালে, তাঁর উপন্যাস ‹দন সেগুন্দো সোম্ব্রা› প্রকাশের পর। এই কাহিনীর মাধ্যমে তিনি আর্হিন্তিনীয় সাহিত্যে নতুন এক কিংবদন্তী চরিত্রের অবতারণা করেন- বুড়ো গাউচো। আর্হেন্তিনার গরুর মাংসের বিশ্বজোড়া কদর নতুন কোন ঘটনা নয়। ২০শ শতকের প্রথমভাগে এর উৎপাদন ও রপ্তানি দ্রæত বৃদ্ধি পায়, পুরো দেশের অর্থনীতিতে এনে দেয় সমৃদ্ধি। গুইরাল্দেসের নিজের পরিবারের অগাধ ধনসম্পদের উৎসও একই গরুর খামার।
লেখক তাঁর উপন্যাসে এই জীবনধারার বন্দনা করেছেন- পুরো বইটি যেন এক গৌরব-গাঁথা। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধ গাউচো দন সেগুন্দো। গ্রামীণ জীবনের সমস্ত প্রাজ্ঞতা যেন তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠছে, যুগ যুগ ধরে কাউবয়ের কঠিন জীবনলব্ধ জ্ঞান তিনি সমর্পণ করবেন শহর থেকে আগত এক যুবকের কাছে। দন সেগুন্দো সোম্ব্রা একটি বিল্ডুঙসরোমান- এক যুবকের বেড়ে ওঠার গল্প, জীবনের শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার গল্প। সেই সাথে এটি একটি এলিজি বা শোকগাঁথাও। আবার আরেক অর্থে হোসে হের্নান্দেস-এর গাউচো মহাকাব্য মার্তিন ফিয়েরো-র পুনর্পাঠ- আর্হেন্তিনার জাতীয় চরিত্র নিয়ে সেই এপিক কবিতাটি যে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, তার ভেতর একটি সুচিন্তিত হস্তক্ষেপ। উপন্যাসের অন্তিম দৃশ্যে দন সেগুন্দো তাঁর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে চলে যাচ্ছেন, পাহাড় টপকে। তাঁকে চলে যেতে দেখছে গল্পের বক্তা সেই যুবক, আজ তার বাবার মতো সেও রাঞ্চের মালিক। দন সেগুন্দোর প্রস্থানের দৃশ্য যেন তার বুকে রক্তক্ষরণের মত। যাবার আগে দন সেগুন্দো তাঁর নবীশ গাউচোকে উপদেশ দিয়েছিলেন - ‘বাছা, তোমাকে শক্ত হতে হবে’। পাম্পাস প্রান্তরের কঠোর পরিশ্রম আর্হেন্তিনীয় চরিত্রকে করে তোলে সুদৃঢ়-সুকঠিন। গাউচো-জীবনের এটিই পরম শিক্ষা। তবে দন সেগুন্দো সোম্ব্রা-র খ্যাতি আর্জেন্টিনার সীমানা ছাপিয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পরে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত লাতিন আমেরিকান পাঠকরা দন সেগুন্দোর লোকজ্ঞান এবং নির্বিকার সহ্যক্ষমতার সাথে একাত্ম বোধ করতে পেরেছিলেন, আর দ্বিতীয়ত উপন্যাসটির অসংখ্য শৈল্পিক গুণাবলী তাদের আকৃষ্ট করেছিল। গুইরাল্দেসের গদ্যের কাব্যময়তা এই গুণগুলোর অন্যতম। সেই সাথে রচয়িতা নৃতাত্তি¡ক, ভাষাবৈচিত্র্যের মাধ্যমে জাতীয় কৃষ্টির একটি সামগ্রিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোরও প্রয়াস চালান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন