পূর্বাচল নতুন শহর যেন সবুজে ঘেরা আর এক নতুন ঢাকা। বহুল আলোচিত ও স্বপ্নের ওই পূর্বাচল নতুন শহরে আগামী বছরই শুরু হচ্ছে লোকজনের বসবাস। এতে রাজধানীর জনসংখ্যার চাপ অনেকটা কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। তাঁরা বলছেন, এটি দক্ষিণ এশিযার একটি ঐত্যিবাহী নতুন শহর। এখানেই নির্মাণ হবে বিশ্বের সর্বোচ্চ তৃতীয় বৃহত্তম ভবন ‘কেপিসি বেঙ্গল টাওয়ার’। যার উচ্চতা ২ হাজার ১৪৫ ফুট। এছাড়া বদলে যাচ্ছে পূর্বাচল প্রকল্পের সংযোগ সড়কের দৃশ্যপটও। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে ৩০০ ফুট সড়কের উভয় পাশের লেক খনন কাজ। এ শহরে আগামী ৬ মাস পর থেকেই লোকজন বসবাস করা সম্ভব হবে। ওই প্রকল্পে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। অন্যদিকে পুর্বাচল শহরে যাতায়াতের জন্য যে ৩০০ ফুট সড়ক তৈরী হয়েছে এর উভয়পাশেও চলছে খাল খনননের কাজ। দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র ও পরিবেশবান্ধব করে ৩০০ ফুট রাস্তার দুই পাশের লেক তৈরি করা হচ্ছে। এ খাল বা লেক খনন কাজ শেষ হলে উন্মুক্ত জলাধার তৈরির পাশাপাশি এ অঞ্চলে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি বিনোদন কেন্দ্র উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাও হবে বলে জানিয়েছেন রাজউকের কর্মকর্তারা। এছাড়া ২ হাজার ১৪৫ ফুট উচ্চতার বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ভবন নির্মাণ করা হবে নতুন ওই শহরে। প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ টাওয়ারটি নির্মাণের অর্থ বিনিয়োগ করবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কেসিসি গ্রুপ। চলতি বছরেই নির্মাণ কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজধানীর উপশহর পূর্বাচলে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ও বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ভবন নির্মাণের এ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ১৪২ তলা ভবনের সম্ভাব্য উচ্চতা হবে ২ হাজার ১৪৫ ফিট। আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও এক্সিবিশন সেন্টার হিসেবে ভবনটি নির্মাণ করা হবে পূর্বাচল প্রকল্পের ১৯ নং সেক্টরের রাজউক ঘোষিত সেরাট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট (সিবিডি) এলাকায়। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন নির্মিত হচ্ছে সৌদি আরবের জেদ্দায়। ১৬৩ তলা এই ভবনের উচ্চতা হবে ৩ হাজার ২৮০ ফুট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন ২০১০ সালে নির্মিত হয়েছে দুবাই। বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স হিসেবে ওই ভবনই হবে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ ভবন। এ ছাড়া উচ্চতা ও আয়তনের দিক দিয়ে এটি হবে বিশ্বের সর্বোচ্চ তৃতীয় বৃহত্তম ভবন। ভবনটির নাম হবে ‘কেপিসি বেঙ্গল টাওয়ার।’ ভবনটি ঘিরেই বাংলাদেশ তথা উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দেশের প্রশাসনিক সকল কর্মকান্ড সম্পাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকার ২০১৭ সালের মধ্যেই এ ভবনটি নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ভবনটি নির্মাণের পাশাপাশি উক্ত এলাকায় প্রশাসনিক কর্মকান্ড সম্পাদনে একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সামঞ্জস্য রক্ষায় ভবনটির আশপাশে আরও ৩০ থেকে ৪০ তলা কয়েকটি ভবন নির্মাণ করা হবে। পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন বলেন, সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের আইকনিক টাওয়ার হিসেবে ভবনটির পরিচিতি হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত হবে। উন্নত বিশ্বের ন্যায় এ ভবন নির্মাণ পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দিকে অতি দ্রæত এগিয়ে যাওয়ার আভাস দিচ্ছে। তিনি বলেন,প্রকল্পটি দ্রæত বাস্তবায়নের সকল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আরো বলেন,পূর্বাচল নতুন শহরে ২০১৮ সালের মধ্যে বসবাস করা সম্ভব হবে। পূর্বাচলকে একটি আদর্শ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রিন স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি সরকারের একটি বড় সাফল্যের মাইল ফলক। পূর্বাচল নতুন শহরে বসবাসকারীদের সেবামূলক সকল সুযোগ-সুবিধা এখানে নিশ্চিত করা হচ্ছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অর্থায়নে ৩০০ ফুট সড়কের উভয় পাশে খাল খনন ও অন্যান্য স্থাপনা তেরীর জন্য প্রাথমিকভাবে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার দুইশ’ ছিয়াশি কোটি ৯১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হচ্ছে চার হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডের (ডিপিএম) মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ জন্য ক্ষতিপূরণসহ জমি অধিগ্রহণ বাবদ দুই ধাপে চার হাজার তিনশ’ ৮৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা ঢাকা জেলা প্রশাসনকে দিয়েছে রাজউক। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেয়া হয়েছে এক হাজার ৭৭৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং গত ২৭ ডিসেম্বর দেয়া হয়েছে দুই হাজার ৬০৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে কুড়িল পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার ১০০ ফুট চওড়া লেক বা খাল খনন ও উন্নয়ন করা হচ্ছে। এর সংযোগ হবে বালু নদীতে। এতে মোট জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে ৯০ দশমিক ১৫৪৯ একর। প্রকল্পের আওতায় থাকছে ৩৯ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, চারটি ইউলুপ, খালের ওপর ১৩টি সেতু, চারটি এক্সপ্রেসওয়ে ফুটওভারব্রিজ এবং পাঁচটি সøুইসগেট। এছাড়া প্রকল্পে থাকছে একটি পাম্প হাউস, ১২টি ওয়াটার বাসস্টপ ছাড়াও ৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন। এক্সপ্রেসওয়ে থেকে দু’পাশেই সাড়ে ৬ মিটার সার্ভিস সড়ক থাকবে। এরপর তিন মিটার প্রশস্ত হাঁটার রাস্তার পর ৩০ মিটার খাল থাকবে। খালের পর আবার দুই মিটার হাঁটার রাস্তাা, ছয় মিটার সার্ভিস রোড থাকবে। সব শেষে থাকবে দেড় মিটার করে হাঁটার রাস্তা।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, নয়নাভিরাম এ খালটির উন্নয়ন প্রকল্প জোয়ার সাহারার ৪২ দশমিক ৫৪৮৬ একর, ডুমনি মৌজার ২৩ দশমিক ৬৩০৯ একর, বরুয়া মৌজার ১৩ দশমিক ০২১৬ একর এবং মস্তল মৌজার ১০ দশমিক ৩৩১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ প্রকল্প নেয়ার কারণে নগরীর নিকুঞ্জ, বারিধারা, জোহারা সাহারা, ডিওএইচএস, ক্যান্টনমেন্ট, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, কালাচাঁদপুরসহ আশেপাশের এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে। পাশাপাশি পানি সংরক্ষণ ও গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জের ক্ষমতা বাড়বে।
কর্মকর্তারা আরো জানান, কুড়িল বিশ্ব রোড থেকে ৩০০ ফিট সড়ক পেরিয়ে বালু নদীর ব্রীজের পর থেকে শুরু হয়েছে এই নতুন শহর। রাজউক নির্মাণাধীন ছয় হাজার একরের এই ছোট্র শহরকে ৩০টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে।ওই নতুন শহরের বসবাস শুরু হলে কমে যাবে রাজধানীর জনসংখ্যার চাপ। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের নীচু জমি ভরাটের কারণে নগরীর পানি নেমে যাওয়ার যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন হবে এ প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আগামী বছরেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এতে করে রাজধানীর বাড্ডা,গুলশান, ভাটেরা, নিকুঞ্জ, বারিধারা, জোয়ার সাহারা, ডিওএইচএস ও ক্যান্টনমেন্ট শাহজালাল বিমানবন্দরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে ৩০০ ফুট সড়কের উভয় পাশের খাল খনন কাজ শেষ হলে। এ লক্ষ্যেই রাজউক কুড়িল থেকে পূর্বাচল (বোয়ালিয়া) পর্যন্ত ৩০০ ফুট সড়কের দুই পাশে জলাধার (খাল) তৈরির উদ্যোগ নেয়।
রাজউক জানায়, আধুনিক এই শহরে ১৫ লাখ মানুষের বসবাস করতে পারবেন। রাজউক জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই শহর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, পূর্বাচলের বিদ্যুৎ লাইন হচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। এখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সবই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হচ্ছে। আবাসিক জ্বালানির জন্য এলপি গ্যাসের ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে আগামী বছরই পূর্বাচল নতুন শহরে বসবাস শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে আবাসিক এলাকায় বেশ কিছু ভবন নির্মাণের কাজ সম্পুর্ণ হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবারহের ব্যবস্থা চালু না থাকায় লোকজনের বসবাসের কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। রাজউক জানিয়েছে, এখন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হচ্ছে। গ্যাসের সংযোগও চালু করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রাজউকের নিজস্ব উদ্যোগে পানি সরবরাহের জন্যও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া গত ডিসেম্বর মাস থেকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সেক্টরে ভবন স্থাপনের জন্য নকশার অনুমোদ। নতুন এ শহরে থাকছে সবুজ ছায়া ঘেরা পরিবেশবান্ধব নগর জীবনের সকল সুযোগ সুবিধা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই শহর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। রাজধানীর পাশেই এ নতুন শহরটি হওয়াতে কমবে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যার চাপ। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বসবাস করতে পারবে ওই শহরে।
পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক আবদুল আউয়াল ইনকিলাবকে বলেছেন, আগামী বছর থেকে লোকজন আবাসিক এলাকায় বসবাস করতে পারবেন। এজন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা রাজউক দ্রুতগতিতে করে যাচ্ছে। ২৫ হাজার ১১৫টি আবাসিক এবং সাড়ে ৩ হাজার বাণিজ্যিক ও অন্যান্য প্লট রয়েছে। তিনি বলেন, রাজউক নিজ উদ্যোগে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করছে। গ্যাস সংযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, প্রথমে ওয়াসা পানি সরবারহের কথা থাকলেও অতিরিক্ত ব্যয় হবে বিধায় এখন ওয়াসা বাদ দিয়ে প্রথমিকভাবে রাজউক ডিপ টিউবয়েল স্থাপন এবং পানি সরবারহের প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া সনাতন পদ্ধতিতেই গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ লাইনও সংযোগ দেয়া হচ্ছে।
রাজউকের প্রকল্প শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়। এখন শুধু সেবাসংযোগ চালু করার কাজ বাকী আছে। গ্যাস বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন