মুহূর্তের মধ্যে একটি পরিবার নেই হয়ে গেল। দুই শিশু পুত্র-কন্যা ও স্বামী-স্ত্রী মিলে ছোট্ট এই পরিবারের সকল সদস্য এখন আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছে শুধুই স্মৃতি। গত শনিবার মধ্যরাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুতে বেপরোয়া বাস তাদের বহনকারী সিএনজি অটো রিকশা চাপা দিলে তারা সবাই নিহত হয়। তাদের সঙ্গে সিএনজি চালকও নিহত হয়। পরিবারকর্তা শেখ মো: সোহেলের খুবই সুখের সংসার ছিল। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তার ও তার স্ত্রীর অনেক স্বপ্ন ছিল। তাদের সকলের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে স্বপ্ন। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন কত মানুষের জীবন ও স্বপ্ন যে হারিয়ে যাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, এই নিয়ে গত সাতদিনে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সড়ক দুঘর্টনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই রাতে নগরীর পতেঙ্গা সৈকতে এলাকায় মোটর সাইকেলের পেছনে থেকে পড়ে গিয়ে ট্রাক চাপায় মারা যায় এক মহিলা। রোববার সকালে বায়জিদ বোস্তামি এলাকায় তেলের গাড়ির লবির চাপায় এক রিকশা চালকের মৃত্যু হয়। গত শুক্রবার নগরীর আকবর শাহ থানার সিটিগেট এলাকায় দ্রæতগামী ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে তিন মোটর সাইকেল আরোহী নিহত হয়। এছাড়া ১৩ আগস্ট রোববার নিমতলায় কন্টেইনারবাহী লরি উল্টে সিএনজি অটোরিকশাকে চাপা দিলে তিনজন নিহত হয়। আগের দিন সিইপিজেড এলাকায় গাড়ি থেকে পড়ে নিহত হয় একজন। খবরে বিশেষভাবে এই তথ্য জানানো হয়েছে, বন্দরনগরীর রাস্তাঘাট ভেঙ্গেচুরে রীতিমত মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। পুলিশের তরফে বলা হয়েছে, চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও সড়কে ব্যাপক খান্দাখন্দ সৃষ্টি হওয়ার কারণে হঠাৎ দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। শুধু চট্টগ্রাম মহানগরী নয়, বন্যায় দেশের সর্বত্রই রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খানা-খন্দ ও ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় এখন দুঘর্টনাও বেড়ে গেছে। গত দুদিনে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছে।
সড়ক-মহাসড়কের দূরবস্থা মোটেই আমলে নিচ্ছে না বাস-ট্রাক চালকরা। তাদের বেপরোয়া গাড়ি চালনাই মূলত সড়ক-দুর্ঘটনার কারণ। সড়ক দুর্ঘটনা নিছকই দুর্ঘটনা নয়; অনেকেই মনে করেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু আসলে হত্যাকাÐের শামিল। বাস-ট্রাকের চালকরা দিনের পর দিন এই হত্যাকাÐ চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না এবং কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও তাদের হয় না। ইতোপূর্বে বহুবার চালকদের দুর্ঘটনাজনিত দায়ের জন্য ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের দাবি জানানো হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। আইন করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। কিন্তুু ওই দাবি শেষ পর্যন্ত কোনো গ্রাহ্যতা পায়নি এবং আইন করার উদ্যোগও পরিত্যক্ত হয়েছে। বাস-ট্রাকের চালক-শ্রমিকদের সংঘশক্তির দাপট, মালিকদের সমর্থন এবং সরকারের মহল বিশেষের পোষকতার কারণে চালক-শ্রমিকরা এক প্রকার দায়মুক্তি ভোগ করছে। এটা কারোই অবিদিত নেই, বাস-ট্রাক চালকদের একটি বড় অংশের গাড়ি চালানোর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই; অনেকেরই নেই বৈধ লাইসেন্স। তাদের এমনকি ট্রাফিক আইন সম্পর্কেও ন্যূনতম জ্ঞান নেই। অথচ তারা বাস-ট্রাক নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়ক-মহাসড়কে। অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য তারাই দায়ী। বলাই বাহুল্য, চালকদের সঙ্গে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর জন্য বাস-ট্রাকের মালিক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোও দায়ী। যতদিন পর্যন্ত পরিবহন সেক্টর নিয়ম-শৃংখলা ও জবাদিহিতা প্রতিষ্ঠিত না হবে, যতদিন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত না হবে ততদিন দুর্ঘটনা কমবে না। শেখ মোঃ সোহেলের পরিবারের মতো আরো পরিবার, আরো নারী-পুরুষ-শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে।
এটা সকলের জানা, সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার নামে এই অপমৃত্যু বা হত্যাকাÐের শিকার হয়। চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এ জন্য প্রধানত দায়ী হলেও অন্যান্য কারণও রয়েছে এর পেছনে। রাস্তাঘাটের দূরবস্থা, অপরিকল্পিত নির্মাণ, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রæটি, রাস্তা দখল, জনসচেতনতার অভাব ইত্যাদি দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। জগতে জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। অথচ এই জীবন বেঘোরে চলে যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় যখন কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয় তখন একটি জীবনেরই কেবল ইতি ঘটেনা, তার পরিবার-পরিজনও নানাবিধ ক্ষতির শিকার হয়। যদি পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তি মারা যায় তবে পরিবারটিই অসহায় হয়ে পড়ে। প্রতিবছর কত পরিবার যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নিরালম্ব হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। যারা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয় তাদের কাছে যেমন জীবন হয়ে পড়ে দুর্বহ তেমনি তাদের পরিবারও পদে পদে বিব্রত ও বিড়ম্বিত হয়। অসহনীয় একটা পরিস্থিতি পরিবারটিকে সয়ে যেতে হয়। প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যু, এই পঙ্গুত্ব এবং তার বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়ার কি কোনো প্রতিকার হবে না? সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটি কেউ মনে করে না। তবে সকলেই বিশ্বাস করে, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা অবশ্যই কমানো সম্ভব। এ জন্য সরকারকে যেমন দুর্ঘটনার কারণগুলো দূর করতে হবে, কঠোর আইন করতে হবে, তেমনি সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীলতা বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন