৯টার ট্রেন আসবে ১১টায়। স্টেশনের মাইকে ঘোষণা এলো, ‘বৃষ্টির কারণে কিছু কিছু স্থানে রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে ধীরে চলতে গিয়ে ট্রেন বিলম্ব হওয়ায় আমরা দুঃখিত।’ রাসেল মনে মনে বললো, ্এটা আবার নতুন কি? মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হয়ে সোজা ওয়েটিং রুমের দিকে হাঁটতে লাগলো সে। ওয়েটিং রুমের সোফায় বসে দুই ঘণ্টা ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দেবে বলে মনে মনে স্থির করলো। বন্যায় গ্রামের পথঘাট সব ডুবে গেছে। রাসেলের বড় বোন হার্টের রোগি। কখন কি হয় বলা যায় না। জরুরী প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। সে কারণে দুলাভাইকে সে ফোন করে বোনকে ঢাকায় আনতে বলেছে। গ্রামের চারিদিকে শুধুই পানি আর পানি। এমতবস্থায় ঢাকায় আসতে চান নি রাসেলের বড় বোন। কিন্তু অসুখ বলে কথা।
সেই সকাল থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। তারপরেও রাজধানীর ব্যস্ত মানুষগুলো বৃষ্টিতে ভিজেই রাস্তায় হাঁটছে। চলছে রিকশা, গাড়ি সবকিছু। প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য বৃষ্টিটা একটা উৎস বটে। রাসেলও ভিজেছে খানিকটা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়েটিং রুমে বসলে তা সহজেই শুকিয়ে যাবে।
ওয়েটিং রুমে বসার মতো কোনো জায়গা নেই। বরং কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। রাসেল আর ভিতরে ঢুকলো না। বাইরে প্লাটফরমের বেঞ্চে বসে পড়ল। একটু পরেই তার পাশে এসে বসলো এক মেয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজলে একটু লজ্জা লজ্জা ভাব থাকে। মেয়েটির মধ্যে সেই ভাব লক্ষ্য করলো রাসেল। কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করলো না। ভাবলো, থাক এমনিতেই লজ্জা পাচ্ছে। বাড়তি লজ্জা দিয়ে আর লাভ নাই। মেয়েটি পরনের কাপড় ঝেরে ঝুরে রাসেলকে উদ্দেশ্য করে বললো, একটু কি বসতে পারি? রাসেল কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। ভেজা শরীরে মেয়েটি রাসেলের পাশে বসলো।
রাসেল লক্ষ্য করলো মেয়েটি তার পাশে বসার পর থেকে স্টেশনের টোকাই থেকে শুরু করে সব বয়সী পুরুষ যাত্রীরা কেমন যেনো তাদের পাশে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগেও সে পানি কেনার জন্য কোনো ফেরিওয়ালাকে খুঁজে পায়নি। এখন তার পাশে কমপক্ষে চারজন ঘুরঘুর করছে। রাসেল এবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এর কারণ বুঝতে পারলো। মেয়েটি দেখতে অপরুপ সুন্দরী। হালকা গরনে শ্যামলা রঙে দারুন দেখতে। মেয়েটির মুখের দিকে সে আঁড় চোখে একবার দেখে নিলো। এরপর এমন ভাব করলো যেনো মেয়েটি তার সাথেরই। একজন ফেরিওয়ালা এসে বললো, স্যার জুতা কালি করবেন? রাসেল মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিলো। এবার ফেরিওয়ালা বললো, স্যার ম্যাডামেরটা করে দেই। রাসেল কিছুটা বিব্রত হতে গিয়েও হলো না। ভাবলো, মেয়েটি যে তার সাথেরই সেটাই বোঝাতে হবে এদের। তা না হলে মেয়েটি ঝামেলায় পড়তে পারে। বললো, না লাগবে না-বললাম না।
কিন্তু একেবারে মুখ বুঝে বসে থেকে মানুষকে বোঝানো মুশকিল যে মেয়েটি তার সাথেরই। তাই কথা বলা জরুরী মনে করলো রাসেল। আশপাশের মানুষজন সন্দেহ করতে পারে এজন্য সরাসরি তুমি সম্মোধন করে কথা শুরু করলো।
-এবার বৃষ্টিটা অনেক বেশি বলে মনে হচ্ছে তাই না?
-তাইতো মনে হচ্ছে, বৃষ্টির কারণে এবার দেশেরও অনকে ক্ষতি হয়ে গেছে। উত্তরে তো বন্যা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে।
রাসেল একটু ধীরে জানতে চাইলো, তোমার বাড়ি কি উত্তরাঞ্চলে?
হ্যাঁ, দিনাজপুরে।
তাই নাকি? আমার বাড়িও তো দিনাজপুর।
দিনাজপুরে যাওয়ার জন্যই কি অপেক্ষা করছো? রাসেল জানতে চাইলো
না আমার নানা আসছেন দিনাজপুর থেকে। বৃদ্ধ মানুষ একা আমাদের বাসা পর্যন্ত যেতে পারবেন না। তাই নিতে এসেছি।
-ও আচ্ছা।
-আপনি?
- আমিও। আমার বড় বোন আসছেন বাড়ি থেকে। অসুস্থ। অবশ্য দুলাভাই আছেন সাথে। তারপরে আসলাম আরকি।
-আপনার নানা কি কাশবন এক্সপ্রেসে আসছেন? রাসেল জানতে চাইলো
-জ্বি।
-আপনার বোন?
-ওই ট্রেনেই।
রাসেল বললো, ট্রেন তো সেই দুই ঘণ্টা লেট। আজকাল রেলের যা অবস্থা। কোনো ট্রেনই সময়মতো চলে না। এটা খুবই বিরক্তিকর। কি বলো?
মেয়েটি একটু ভিন্নমত পোষণ করে বললো, তারপরেও রেলের অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। এই ধরেন আমার নানা কোনোদিনও ট্রেনে আসতে চাইতেন না। একবছর আগে তাকে অনেকটা জোর করেই ট্রেনে করে আনা হয়। এরপর থেকে তিনি আর বাসে উঠতে চান না। তার মতে, ট্রেন এখন অনেক নিরাপদ ও আরামদায়ক। একটু লেট করে চললেও ট্রেনই উত্তম।
স্টেশনের মাইকে ঘোষণা এলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনাজপুর থেকে ঢাকাগামী কাশবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৩ নম্বর প্লাটফরমে এসে দাঁড়াবে।
ঘোষণা শুনে মেয়েটি নড়েচড়ে বসলো। তাকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছিল। কিন্তু রাসেলের মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটি উঠে দাঁড়াতেই রাসেল তাকে বসার অনুরোধ করে বললো, আরে এখনও অনেক দেরি। বসো বসো। মেয়েটি তার কথায় কান দিলো না। রেললাইন ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। দুর থেকে ট্রেনের ইজ্ঞিনের হর্ণ শোনা গেল। রাসেলের মনে হচ্ছিল সেই হর্ণ তার বুকে আঘাত করছে। নিমিষের মধ্যে একটা অস্থিরতা ভর করলো তার মনে। ট্রেনটা কি আর একটু দেরি করে আসলে হতো না?
দেখতে দেখতে ট্রেনটা প্লাটফরমে এসে দাঁড়ালো। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল বৃষ্টিভেজা সেই মেয়েটি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন