কথায় কথায় ছুরি মারা খুন করা তার নেশা
জীবনের প্রথম অপরাধ বন্ধুকে পিটিয়ে খুন। এরপর একের পর এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। যখন যাকে খুশি ছুরি মারা, খুন করা অনেকটা নেশায় পরিণত হয় তার। একের পর এক অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় আরও ভয়ঙ্ককর হয়ে উঠে সে। যতবারই অপরাধ করেছে ততবারই আশ্রয় পেয়েছে বড় ভাইদের। পুলিশের জালে আটকা পড়েও বেশিদিন থাকতে হয়নি কারাগারে। কারণ ক্ষমতাসীনরা তার আশ্রয়দাতা। এ কারণে পুলিশও তাকে সমীহ করে। চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকানন এলাকার সাধারণ যুবক অমিত মুহুরীর (২৭) ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে উঠার গল্প সিনেমাকেও হার মানায়। অমিত মুহুরীর বর্বরতার সর্বশেষ শিকার হন তার বন্ধু ইমরানুল করিম ইমন। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে খুনের পর ইমনের লাশ বাথরুমে রেখে রাতভর গান শুনে অমিত মুহুরী। সাথে ছিল স্ত্রী চৈতী ও বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব। গানের সাথে চলে ইয়াবা সেবনের আসর। এর মধ্যে জোগাড় হয় এসিড, চুন, সিমেন্ট, বালি। ড্রামে লাশ ভরে এসিড ঢেলে গলানোর চেষ্টা হয়। এরপর তাতে চুন ঢেলে সিমেন্ট, বালি দিয়ে ঢালাই করা হয়। পরে ড্রাম ফেলে দেয়া হয় দীঘির পানিতে। ঠান্ডা মাথায় নিজের বাসায় এভাবে বন্ধু ইমরানুল করিম ইমনকে খুনের পর যথারীতি যুবলীগের এ নেতা তার নেতার কাছে আশ্রয় চায়। আশ্রয় না পেয়ে মাদকাসক্ত রোগী হিসেবে ভর্তি হন কুমিল্লার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। চাঞ্চল্যকর এবং লোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডে অমিত মুহুরীর জড়িত থাকার প্রমাণ হাতে পেয়ে তাকে কুমিল্লা থেকে ধরে আনে পুলিশ। ইতোমধ্যে সে ইমনকে খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে।
তবে পুলিশ বলছে, জবানবন্দীতে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়নি। ইমনের সাথে স্ত্রী চৈতীর পরকিয়া চলছে এমন সন্দেহে ইমনকে ধরে এনে হত্যা করার বিষয়টি স্বীকার করলেও অমিতের বন্ধু শিশির বলছে অমিত এবং চৈতী মিলেই ইমনকে খুন করেছে। চৈতীর যদি ইমনের সাথে পরকিয়া থাকে তাহলে সে তাকে খুন করলো কেন। আর চৈতীকে উত্যক্ত করেছে এমন ঠুনকো অভিযোগেও ইমনকে খুন করা হতে পারে তা মানতে পারছেনা তদন্তকারী পুলিশ কর্মককর্তারা। তারা বলছেন, খুনের নেপথ্যে অন্য কোন রহস্য আছে। এ রহস্য উদঘাটনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। গতকাল (মঙ্গলবার) অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়ার আদালতে শুনানী শেষে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ তিন দিনের রিমান্ডে ইমন হত্যাকান্ড ছাড়াও অন্যান্য হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইমন হত্যাকান্ড ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের এক নেতাসহ বেশ কয়েকজনকে খুনের অভিযোগ আছে।
এ প্রসঙ্গে ইমন হত্যা মামলার তদন্ত তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সহকারী কমিশনার (কেতোয়ালী) জাহাঙ্গীর আলম ইনকিলাবকে বলেন, অমিত মুহুরীকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে আনার পর বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। রিমান্ডে তাকে ইমন হত্যাকান্ডের ব্যাপারে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর পাশাপাশি হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র এবং লাশ গুমের চেষ্টায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম উদ্ধার তথা আলামত সংগ্রহ করা হবে। এ ঘটনায় আর কারা সহযোগিতা করেছে সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, ঘটনার পর অমিতের স্ত্রী চৈতী পালিয়ে গেছে। চৈতীর সাথে পরকিয়ার কারণে ইমনকে হত্যা করার কথা অমিত স্বীকার করলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, এ খুনে চৈতীও জড়িত ছিল। তিনি বলেন, আমরা চৈতীকে ধরতে অভিযান শুরু করেছি।
গত ১৩ আগস্ট নগরীর এনায়েত বাজারের রানীর দীঘি থেকে ড্রামভর্তি লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। তদন্তে নিশ্চিত হওয়া যায় ওই লাশটি ইমনের। তার বাড়ি অমিত মুহুরীর গ্রামের বাড়ির পাশে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। ইমন ছিল অমিত মুহুরীর বন্ধু। অমিত মুহুরীর স্ত্রী চৈতীকে উত্যক্ত করতো এমন অভিযোগে ইমনকে খুন করা হয়েছে বলে স্বীকার করে অমিত মুহুরী। ইতোমধ্যে অমিত মুহুরীর বন্ধু ইমাম হোসেন মজুমদার শিশির আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। আদালতে সে জানিয়েছে, অমিত মুহুরী, তার স্ত্রী চৈতী ইমনকে হত্যা করে। পরে সেসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে লাশ গুম করা হয়। শিশির জানায়, ঘটনার রাতে (৯ আগস্ট) অমিত মুহুরী শিশিরকে ফোনে বাসায় ডেকে আনে। সিঁড়ি বেয়ে অমিতের নন্দনকাননের পাঁচ তলার বাসায় উঠার সময় সে শিশিরকে জানায়, ইমন চৈতীর দিকে কুনজর দিয়েছে। তাই তাকে সাজা দিয়েছি। বাসায় ঢুকেই অমিত শিশিরকে বাথরুমে নিয়ে যায়। শিশির দেখে ইমনের দুই হাত পেছনে বাঁধা, গলা কাটা। লাশ পড়ে আছে বাথরুমে। তখন অমিতের স্ত্রী চৈতী বেডরুমে বসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গান শুনছিল। ওইসময় তার বাসায় রাকেশ, রাজীব, রিপন, ছায়েদ, রকি এবং রকির এক বন্ধুকে ডেকে আনে অমিত। শিশির জানায়, অমিতের কথামতো ইমনের লাশ গলানোর জন্য রাকেশ নগরীর হাজারী গলি থেকে এসিড সংগ্রহ করে আনে। রিপন আনে চুন ও সিমেন্ট। রকি, শিশির ও ছায়েদ মিলে সিমেন্ট-বালু এবং চুন মেশায়। এরপর ইমনের লাশ ড্রামে ভরে ঢালাই করে দেয়া হয়। পরে অমিত ফোন করে আরও ১০-১৫ জনকে ডেকে আনে। তারা সবাই মিলে ড্রামবোঝাই লাশটি রানীর দীঘিতে ফেলে আসে বলে আদালতে জানায় শিশির। শিশির জবানবন্দীতে জানায়, অমিত রাজনীতি করে। কথায় কথায় যাকে-তাকে ছুরি মারে এটাই তার স্বভাব। মূলত তার বক্তব্যের সূত্র ধরেই দীর্ঘ ১৭ দিন পর ওই লাশের পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশ। উন্মোচন হয় লোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডের রহস্য। আর এর মূলেই ছিল ভয়ঙ্কর যুবলীগ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী।
শুরু থেকেই ভয়ঙ্কর অমিত মুহুরী
খুন দিয়েই অমিত মুহুরীর অপরাধ শুরু। এ কারণে অপরাধ জগতে নামার শুরু থেকেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে সে। নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিতি পায় সে। অপরাধী কর্মকান্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও সক্রিয় হয়ে পড়ে অমিত মুহুরী। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে নগরীর নন্দনকানন, সিআরবি থেকে শুরু করে লালদীঘি, আন্দরকিল্লা পর্যন্ত তার একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল-বেদখলের ঘটনায় নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি এ এলাকার অপরাধের সকল ঘাঁটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সে। নন্দনকানন কেন্দ্রিক যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অনুসারী হিসেবে যুবলীগের রাজনীতিতেও সে হয়ে উঠে প্রভাবশালী। অমিত মুহুরীর দুঃসাহসিকতার জন্য দলে আলাদা সমাদর ছিল। সাথে নেতৃত্বের গুণাবলী এবং খুব সহজে অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা মাত্র আড়াই বছরে তাকে চট্টগ্রামের অপরাধ জগতে আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছিল। পরিচিতির ব্যাপকতা আসে সিআরবির ডবল মার্ডারের মাধ্যমে। বারে বারে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া অথবা গ্রেফতার হলেও অল্প সময়ের মধ্যে বের হয়ে আসা তাকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছিল।
পুলিশ জানায়, নগরীর নন্দনকানন এলাকার বাসিন্দা অজিত মুহুরীর বড় ছেলে অমিত। তাদের গ্রামের বাড়ি রাউজানে। লেখাপড়ার দৌঁড় তেমন নেই। গত কয়েক বছরে সে বেশ কয়েকটি ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কয়েকজনকে সে খুন করে, আরও কয়েকজনকে মারাত্মক আহত করে। সিআরবিতে জোড়া খুনের অন্যতম আসামী সে। ২০১৩ সালের ২৪ জুন টেন্ডারবাজির ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত ও হেফজখানার ছাত্র আরমান হোসেন মারা যায়। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সাথে গ্রেফতার হয় অমিত মুহুরী। কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে এসে যুবলীগের নেতা পরিচয় দিতে শুরু করে সে। এরপর এলাকায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং একই সাথে অপরাধ কর্মকান্ডের গতি বাড়িয়ে দেয় অমিত মুহুরী। গত ১১ ফেব্রুয়ারী নগরীর আমতল এলাকায় খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াছিন আরাফাত। এ ঘটনায় তার জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। সিএমপির কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম জানান, অমিত মুহুরীর বিরুদ্ধে একাধিক খুনসহ এ পর্যন্ত ১৩টি মামলার সন্ধান পাওয়া গেছে। আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন