সহযোগী শিশির রিমান্ডে
নিজে যুবলীগের ক্যাডার হয়েও নিজ দলের নেতাকর্মীদের রক্তে হাত রঞ্জিত করেছে চট্টগ্রামের ভয়ঙ্কর খুনী অমিত মুহুরী। সর্বশেষ তার নির্মম শিকারে পরিণত হওয়া যুবক ইমরানুল করিম ইমন যুবলীগের একজন কর্মী। অমিত ও ইমনের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে।
ছোটবেলা থেকেই তাদের দু’জনের বন্ধুত্ব। দু’জনই যুবলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। অথচ স্ত্রীর সাথে কথিত পরকিয়ার সন্দেহে সে বন্ধুকেই নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ গুম করে এ ভয়ঙ্কর খুনী। এর আগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী অমিত মুহুরীর নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে। চাঞ্চল্যকর ইমন হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর অমিত মুহুরীর অপরাধ জগতের খতিয়ান খুঁজতে গিয়ে পুলিশ এমন তথ্য পায়। পুলিশ জানায়, বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী রাসেলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে অমিত ও তার সহযোগীরা। প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাসেলের সাথে অমিতের বিরোধ বাধে। এর জের ধরে রাসেল বন্ধুদের নিয়ে অমিতকে ডিসি হিল এলাকায় পিটিয়ে আহত করে। রাসেল ও অমিত যুবলীগ কর্মী হওয়ায় যুবলীগের এক শীর্ষ নেতা তাদের দু’জনের মধ্যে মিলমিশ করে দেন। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ অমিত মনে মনে ক্ষোভ পুষে রাখে। এর জের ধরে রাসেলকে নগরীর আগ্রাবাদ জাম্বুরী মাঠ এলাকায় মধ্যরাতে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। মুমূর্ষ অবস্থায় রাসেলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার কয়েকদিন পর রাসেলের মৃত্যু হয়।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রæয়ারী নগরীর আমতলার একটি রেস্টুরেন্টে খুন হন নগর ছাত্রলীগ নেতা ইয়াছিন আরাফাত। পুলিশ জানায়, ভারত থেকে চোরাইপথে আসা আড়াই লাখ টাকা দামের একটি মোটর সাইকেলকে কেন্দ্র করে তাকে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ প্রায় নিশ্চিত এ খুনের সাথেও অমিত মুহুরী জড়িত। ওই ঘটনার কয়েকদিন পর নগরীর বাকলিয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন নগর ছাত্রলীগ নেতা তানজিরুল হক। এ ঘটনার পর ওই ছাত্রলীগ নেতার স্ত্রী ফারহানা সুলতানা অমিত মুহুরী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। পুলিশ জানায়, গভীর রাতে অমিত তার সহযোগীদের নিয়ে ওই এলাকায় মোটর সাইকেলে শোডাউন করে। একপর্যায়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রলীগ নেতা তানজিরুল হকসহ অন্যদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ছুঁড়ে সে। এতে গুলিবিদ্ধ হয় তানজিরুল হক।
২০১৪ সালে নগরীর সিআরবিতে টেন্ডারবাজির ঘটনায় অমিত মুহুরী ও তার সহযোগীদের গুলিতে মারা যায় যুবলীগ কর্মী সাজু পালিত ও এক শিশু আরমান হোসেন। সাজু পালিতের পরিবারের অভিযোগ, অমিত মুহুরী সাজু পালিতের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। পুলিশের উপর হামলার অভিযোগও রয়েছে খুন, ছিনতাইসহ ১৩ মামলার আসামী অমিত মুহুরীর বিরুদ্ধে। গত পহেলা বৈশাখ নগরীর ডিসি হিলে পুলিশের উপর হামলা করে অমিত ও তার সহযোগীরা। এর আগে তুচ্ছ ঘটনায় নগরীর সেবক কলেীনিতে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়ে অমিত। ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজও এখন পুলিশের হাতে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বদলে নিজ দলের নেতাকর্মীদের টার্গেটে পরিণত করা অমিত মুহুরীর কর্মকান্ড নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনেও এখন তোলপাড় চলছে। এতদিন ভয়ঙ্কর এ অপরাধীকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিলেন তারাও এখন তার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। অমিতের কথায় যেসব ক্যাডার এতদিন যেখানে-সেখানে তান্ডব চালিয়েছে তারাও এখন গা-ঢাকা দিয়েছে।
এদিকে নগরীতে ড্রামে ঢালাই করা ইমনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতার প্রধান আসামী যুবলীগ নেতা অমিত মুহুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেনি পুলিশ। চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক এ হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেন আদালত। তবে গতকাল (বুধবার) বিকেল পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারাগার থেকে আনা হয়নি। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম ইনকিলাবকে বলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আমরা তাকে যেকোন সময় কারাগার থেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবো। এর আগে গ্রেফতার মামলার অন্যতম আসামী ও অমিত মুহুরীর বন্ধু ইমাম হোসেন মজুমদার শিশিরকে তার মুখোমুখি করার পরিকল্পনাও রয়েছে। হত্যাকান্ডের ব্যাপারে এ দু’জনই আদালতে যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে কিছু গরমিল থাকায় তাদের মুখোমুখি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ ঘটনায় জড়িত অমিত মুহুরীর স্ত্রী চৈতী ও তার বন্ধুদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। হত্যাকান্ডে অমিত ও তার স্ত্রী সরাসরি জড়িত থাকলেও লাশ গুম করার ক্ষেত্রে অমিতের ৭-৮ জন বন্ধু সহযোগিতা করেছে। ইতোমধ্যে তাদের সবার নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হবে। খুনের পর অমিতের নন্দনকাননের ৫ তলা বাসা থেকে ড্রামভর্তি লাশ নামিয়ে এনায়েত বাজার রানীর দীঘিতে ফেলে দেয়ার কাজে বেশ কয়েকজন শ্রমিককেও ভাড়া করা হয়। তাদেরকেও খুঁজছে পুলিশ।
গত ১৩ আগস্ট নগরীর কোতোয়ালি থানার এনায়েত বাজার রানীর দিঘী থেকে সিমেন্ট ঢালাই করা ড্রামের ভেতর থেকে ইমরানুল করিম ইমন নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তে নেমে ইমনের বন্ধু অমিতকে সন্দেহ করে পুলিশ। একপর্যায়ে অমিতের বন্ধু শিশিরকে গ্রেফতার করলে সে হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দী দেয়। এর জের ধরে গত শনিবার কুমিল্লার একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে অমিতকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন অমিত।
দুই দিনের রিমান্ডে শিশির
ইমরানুল হক ইমন খুনের ঘটনায় মূল আসামী যুবলীগ নেতা ও ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী অমিত মুহুরীর সহযোগী ইমাম হোসেন মজুমদার শিশিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ। মহানগর হাকিম মাসুদ পারভেজ গতকাল এ আদেশ দেন। সিএমপির সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান, শিশিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল। শুনানি শেষে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এর আগে গত শুক্রবার এ হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দী দেয় শিশির। আরও কিছু তথ্য জানা জরুরী হওয়ায় তাকে রিমান্ডে আনা হয়েছে বলে জানান মামলার তদন্ত তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারি পুলিশ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন