\ এক \
মানুষের মাঝে মানবিক কু-প্রবৃত্তির দরুণ বক্রতা আর একগুয়েঁমি বিদ্যমান। তাই রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে নামাযের মাধ্যমে বান্দার অন্তর থেকে বক্রতা আর একগুয়েঁমি দূরিভূত হয়ে বান্দার অন্তরে আল্লাহর প্রতি সম্মানবোধ মুহাব্বত ও ভয়ভীতি স্থান করে নেয়। এই নামাযের উসিলায় গোলাম তার মাওলার ভালবাসায় সিক্ত হয়। নামায নামাযিকে মনুষ্যত্বের গন্ডিতে অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। সর্বোপরি বাঁকা অন্তরকে সোজা বাঁশের মত সরল-সোজা হতে সাহায্য করে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- নিশ্চয় নামায মানবজাতিকে সমস্ত অশ্লীল এবং গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবূত, আয়াত: ৪৫)
রোযা, হজ্ব, যাকাতসহ ইসলামের অন্যান্য সব ইবাদত পৃথিবীর জমিনে ফরয হয়েছে। আর নামায ফরয হয়েছে আসমানের ওপর। শুধু তাই নয়, নামায আরশের পাশে স্বয়ং রাব্বুল আলামীনের উপস্থিতিতে ফরয হয়েছে। এজন্য নামাযের প্রতি যে ধরণের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে অন্যান্য ইবাদাতের ব্যাপারে এত গুরুত্বের কথা উল্লেখ নেই। তেমনি কুরআন-হাদীসে নামাযের কথা যেভাবে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, অন্যান্য ইবাদতের বেলায় এমনটি বলা হয়নি। নামাযী যখন নিয়ত বাঁধে, তখন সে রাব্বুল আলামীনের সামনে চলে যায়। যখন কোন দুর্ভাগা নামাযী নামায পড়ার সময় দৃষ্টিকে অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয়, তখন আল্লাহ বলেন, বান্দা! আমি তো তোমার সামনেই আছি। এদিক-সেদিক কী দেখছো? আমার চেয়ে ভাল কিছু কি তোমার নজরে পড়েছে, যে তোমার দৃষ্টিকে আমার দিক থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে?
নামাযী যখন নামাযের নিয়ত বাঁধে, তখন তাকবীরে তাহরীমা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর সে সদ্য প্রসূত নবজাতকের মত পবিত্র হয়ে যায়। নামাযী ছানা পড়ার পর যখন আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ে, তখন তার শরীরের প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়। নামাযী যখন সূরা ফাতিহা পড়ে, তখন একটা হজ আর একটা ওমরাহ হজের সওয়াব লিখা হয়। নামাযী যখন রুকুতে যায় এবং তাসবীহ পড়ে, তখন সমস্ত আসমানী কিতাব তেলাওয়াত করার সমপরিমাণ সওয়াব অর্জিত হয়। নামাযী যখন সিজদা করে, তখন একজন ক্রীতদাস মুক্ত করার সওয়াব পায়। নামাযী বান্দা যখন সালাম ফেরায়, তখন তার জন্য জান্নাতের ৮টি দরজা খুলে দেওয়া হয়, কেয়ামতের দিন যেখান দিয়ে ইচ্ছে সে প্রবেশ করতে পারবে। (মাজালিসে সুন্নিয়া)
হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, নামাযী ব্যক্তির জন্য তিন ধরণের বিশেষ সম্মান আছে- (ক) যখন সে নামাযের জন্য দাঁড়ায়, তখন তার মাথা থেকে আসমান পর্যন্ত রহমতের মেঘ ছেয়ে যায় এবং তার ওপর বৃষ্টির মত সওয়াব বর্ষিত হয়। (খ) ফেরেশতারা নামাযী ব্যক্তির চতুর্পাশে জড়ো হয়ে তাকে নিজেদের বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে নেন। (গ) একজন ফেরেশতা উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, হে নামাযী! যদি তুমি অবলোকন করতে যে, তোমার সামনে কে আছেন এবং কার সাথে কথা বলছ, খোদার কসম! কেয়ামত পর্যন্ত তুমি সালাম ফেরাবে না। নামাযের মধ্যেই তোমার মৃত্যু এসে যাবে।
কেয়ামতের দিন যখন নামাযীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করতে বলা হবে, তখন সর্বপ্রথম একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে, যাদের চেহারা সূর্যের মত চমকাতে থাকবে। ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করবেন, তোমারা কারা? তোমাদের আমল কী ছিল? তারা বলবেন, আমরা মুসলমান। আমাদের আমল ছিল আমরা নামাযের হেফাজত করতাম। ফেরেশতারা বলবেন কীভাবে হেফাজত করতে? উত্তরে বলবেন, আমরা সবসময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় শুরু হওয়ার পূর্বেই মসজিদে এসে যেতাম। তাদের পরে দ্বিতীয় আরেকটি দল পুলসিরাতের ওপর দিয়ে জান্নাতে যাবে। তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মত জ্বলজ্বল করবে। ফেরেশতারা তাদেরকেও জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কারা? দুনিয়াতে কী আমল করতে? তারা উত্তরে বলবে, আমরা নামাযের হেফাজতকারী মুসলমান। ফেরেশতারা বলবেন, তোমরা নামাযের হেফাজত কীভাবে করতে? তারা বলবে, আমরা আযানের পূর্বে অজু করে নামাযের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেতাম এবং আযান শোনার সাথে-সাথে মসজিদে পৌঁছে যেতাম এবং নামায পড়তাম। তারপর তৃতীয় দল যাবে যাদের চেহারা তারার মত চমকাবে। ফেরেশতারা তাদেরকেও একই প্রশ্ন করবেন। তারা উত্তরে বলবে, আমরা আযান শোনার পর অজু করে মসজিদে চলে যেতাম এবং সব সময় তাকবীরে উলার পাবন্দি করতাম।
হযরত আলী রা. বলেন, নামায হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম, ফেরেশতাদের ভালবাসা অর্জন করার উপায়, পূর্বের আম্বিয়ায়ে কেরামের তরিকা, দোয়া কবুল হওয়ার উপায়, ইসলামের মূল স্তম্ভ, প্রভুকে চেনার পাথেয়, নামায ছাড়া কোন ইবাদত কবুল হয় না, নামায পড়লে আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হয়, নামায মৃত্যুর সময় আজরাঈল আ. কে সহজভাবে জান বের করার সুপারিশ করবে, নামায মুমিনের অন্তরের জ্যোতি, কবরে আলোর উৎস, কবরের অন্ধকার গর্তে নামায নামাযীর পক্ষে মুনকার-নাকীরের প্রশ্নের উত্তর দিবে, নামায কিয়ামত পর্যন্ত কবরে নামাযীর সঙ্গ দিবে, হাশরের দিন ছায়াপাত করবে, মাথার মুকুট এবং শরীরের পোষাক হবে, মশাল হয়ে নামাযীর পথ চলতে সাহায্য করবে, হিসাব-নিকাশের সময় জাহান্নাম এবং নামাযীর মাঝে আড়াল হয়ে থাকবে, আল্লাহর আদালতে নামাযীকে ক্ষমা করে দেওয়ার অনুরোধ করবে, নামাযের ওজন সমস্ত গুনাহর ওজন থেকে বেশি হবে, পুলসিরাত সহজ হবে ও বেহেশতের চাবি হবে।
হযরত কা’ব রা. বলেন, আমি তাওরাত শরীফে দেখেছি যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা আ. কে বলেন, হে মূসা! আমার শেষ নবীর উম্মত যখন ফজরের সময় দুই রাকাত ফরজ নামায পড়বে, তার বিনিময়ে আমি তাদের পুরা রাত-দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেব এবং আমার নিরাপত্তার দুর্গে প্রবেশ করিয়ে নেব। হে মূসা! আমার শেষ নবীর উম্মত যখন যোহরের চার রাকাত ফরজ নামায পড়বে, তার প্রতিটি রাকাতের জন্য আলাদা আলাদা সওয়াব রয়েছে। প্রথম রাকাতের বিনিময়ে তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় রাকাতের বিনিময়ে কিয়ামতের দিন তাদের নেক আমলসমূহের পাল্লা ভারী হবে। তৃতীয় রাকাতের বিনিময়ে ফেরেশতারা তাদের জন্য মাগফিরাত এবং রহমতের দোয়া করবে এবং চতুর্থ রাকাতের বিনিময়ে আসমানের দরজাসমূহ তাদের জন্য খুলে যাবে এবং স্বর্গের হুর তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। হে মূসা! আমার সর্বশেষ নবীর উম্মত যখন আছরের নামায পড়বে, তখন আসমান-জমিনের সব ফেরেশতারা তাদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। আর মনে রেখ, যার জন্য ফেরেশতারা মাগফিরাতের দোয়া করবে আমি তাকে আযাব দিব না। হে মূসা! আমার শেষ নবীর উম্মত যখন মাগরিবের তিন রাকাত ফরজ নামায পড়বে, তখন নামায পড়াকালীন সময়ে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে। তারা যে আশা-আকাঙ্খার কথা আমার কাছে ব্যক্ত করবে। আমি সব পূরণ করে দেব। হে মূসা! এশার চার রাকাত ফরজ নামায আমার শেষ নবীর উম্মতের জন্য পুরো পৃথিবীর রাজত্ব এবং সহায় সম্পদ থেকে উত্তম। এই নামায পড়ার পর তারা সদ্য প্রসূত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যাবে।
একদা হযরত ঈসা আ. সাগর পাড়ে হাঁটছিলেন, এমন সময় তিনি দেখলেন যে, একটি উজ্জ্বল সাদা বর্ণের জন্তু সাগরের নোংরা কাদায় লুটে পড়ল, অমনি সেই উজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন জন্তুটি কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল। তারপর জন্তুটি সেখান থেকে বের হয়ে সাগরের পানিতে গিয়ে গোসল করল। গোসল করার সাথে সাথেই সে পূর্বের মত উজ্জ্বল এবং পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল। জন্তুটি কিছুক্ষণ পর-পর এ ধরনের কাজ পাঁচ বার করল। হযরত ঈসা আ.! এসব দেখে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলেন। তিনি আশ্চর্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেলে জিবরাঈল আ. তাঁর কাছে এসে বললেন, হে ঈসা আ. আপনাকে জন্তুটির এই কার্যকলাপ এজন্যই দেখানো হয়েছে যেন আপনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের নামাযের উদাহরণ বুঝতে পারেন। এই যে কাদা আপনি দেখলেন, তা হচ্ছে তাদের গুনাহ আর কাদায় লুটে পড়া হচ্ছে তাদের পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার উদাহরণ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন