সন্তানের সামনে স্ত্রীকে হত্যা, ছেলেকে মা-বাবা পুলিশে দিয়েছেন, ইয়াবাসহ ধরা পড়েছে কারারক্ষী, বাসা থেকে মাদকাসক্ত ছেলের লাশ উদ্ধার, ইয়াবা সেবন করিয়ে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ
দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সমাজে নানা ধরনের অপরাধ দ্রæত গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। পরিবার, স্কুলজীবন, কর্মস্থল কিংবা অবসরজীবন সর্বত্র এখন ইয়াবা নামক মাদকের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। একদিকে মাদকাসক্ত হয়ে যুবক সন্তান মা-বাবার চোখের সামনে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, অন্যদিকে মাদকাসক্ত স্বামী সন্তানদের সামনেই নির্মমভাবে হত্যা করছেন স্ত্রীকে। স্কুল-কলেজগামী মেধাবী ছেলে-মেয়েরা মাদকাসক্তের কারণে বিপথগামী হচ্ছে অভিভাবকদের চোখের সামনে। শহর কিংবা অজপাড়া গ্রাম সর্বত্রই মাদকের বিস্তার ও সহজলভ্যতার কারণে দেশে মাদকের এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত কয়েকদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই ইয়াবার ভয়াবহতা বেরিয়ে আসবে। যদিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিদিনই ইয়াবা উদ্ধার এবং জড়িতদের গ্রেফতার করছে। কিন্তু দেশের সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার ও ভারত থেকে প্রশাসন ও সীমান্তরক্ষায় জড়িত কথিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহযোগিতায় প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার ইয়াবা প্রবেশ করছে। পরে যা দেশের বড় বড় শহর থেকে শুরু করে অজপাড়া গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এখনই এর প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম মেধাশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ৭ অক্টোবর নাটোরে এক অনুষ্ঠানে তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শপথ নিয়ে দেশ গড়তে হবে। মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে পারলে জনগণ সরকারের উন্নয়নের পুরোপুরি সুফল ভোগ করতে পারবে। ঢাকা আহছানিয়া মিশনের মনোবিজ্ঞানী আমির হোসেন বলেন, মাদক নিয়ে পুরুষদের বিষয়গুলো আগে এলেও নারী ও শিশুদের মধ্যে এর যে ভয়াবহতা রয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। মাদকাসক্ত নারীদের অর্ধেকের বেশি ইয়াবায় আসক্ত। মাদকাসক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে কৌতুহল, বন্ধুদের চাপ, মানসিক বিষাদগ্রস্ততা, পারিবারিক কলহ, বাবা-মায়ের মাদকাসক্তি এবং মাদকের সহজলভ্যতাকে দায়ী করছেন আমির হোসেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে সর্বপ্রথম ইয়াবা ঢোকে ২০০১ সালে। ইয়াবার সেই চালান টেকনাফে নিয়ে আসেন মিয়ানমারের নাগরিক পিচ্চি আনোয়ার। দেশের একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী সেবনকারীর কাছে তখন ইয়াবা মাদক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১৬ বছর। হালে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে ইয়াবা। শহর-বন্দর-গ্রাম সবখানেই এখন হাত বাড়ালেই মিলছে মরণনেশা ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৬০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই এখন ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবার পেছনে সেবনকারীরা দিনে খরচ করছে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। বছরে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ৪৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর এ টাকা জোগাড় করতে ইয়াবা সেবনকারীরা সহিংস হয়ে ওঠে। খুন-খারাবি থেকে শুরু করে ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আর তরুণ-তরুণী শুধু নয়; ছোট-বড় ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদেরও একটি অংশ এখন ইয়াবায় আসক্ত। ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার থাবায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে বহু পরিবারের সন্তানের জীবন। নেশায় আসক্ত হয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের মায়ের কান্নাও থামছে না। অসহায় এ বাবা-মায়েদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ অক্টোবর বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় ইয়াবা সেবন করিয়ে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ মামলার আসামি তাপস শীলকে (৩৫) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলা সূত্রে জানা গেছে, নির্যাতনের শিকার স্কুলছাত্রী বাহাদুপুর গ্রামের তার মামা বাড়িতে থেকে বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছিল। অন্যান্য দিনের মতো ২৯ জুলাই রাতে দীপকের বাহাদুরপুর গ্রামের বাড়িতে তাপসের সঙ্গে ইয়াবা সেবন করতে আসে গৌরনদীর গোবর্ধণ গ্রামের কুদ্দুস ফকিরের ছেলে কাওসার ফকির ও একই থানার নন্দনপট্টি গ্রামের শফি মৃধার ছেলে সেন্টু মৃধা। ওই রাতে দীপকের স্ত্রী মোবাইল ফোনে ওই স্কুলছাত্রীকে তার ঘরে ডেকে আনে। পরে ইয়াবা সেবন করিয়ে স্কুলছাত্রীকে বেসামাল করে ধর্ষণ করে কাওসার। একপর্যায়ে মেয়েটির জ্ঞান ফিরলে তার ডাক চিৎকারে স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে দীপক, তার মা ও স্ত্রীকে ধরে পুলিশে দেয়। অন্যরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় গত ৩০ জুলাই ওই স্কুলছাত্রী বাদী হয়ে থানায় মামলা করে। সূত্র জানায়, কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার উত্তর রমনা এলাকায় মাদকাসক্ত নিজ সন্তানকে পুলিশে দিয়েছে বাবা-মা। গত ৭ অক্টোবর তাকে কুড়িগ্রাম জেলহাজতে পাঠানো হয়। এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত হয় রমনা মডেল ইউনিয়নের উত্তর রমনা এলাকার রাসেল মিয়া (২৫)। মাদকাসক্ত হয়ে প্রায়ই বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের মারধরসহ বাড়িঘর, আসবাবপত্র ভাঙচুর করে রাসেল। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে বাবা-মাসহ পরিবারের লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। পরে বাধ্য হয়ে বাবা চিলমারী মডেল থানায় অভিযোগ করেন। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ সেপ্টেম্বর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের এক রক্ষীকে ৬০০ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক করার পর সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। জেলসুপার প্রশান্ত কুমার বণিক জানান, কারারক্ষী আজিজার রহমান ইয়াবা সেবন ও বিক্রির সাথে জড়িত রয়েছে- এমন তথ্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আগে থেকেই ছিল। এরপর থেকে তার প্রতি বিশেষ নজরদারি করা হয়। পরে ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে কারারক্ষী আজিজারকে চ্যালেঞ্জ করে তার দেহ তল্লাশি করা হয়। এ সময় তার সাথে থাকা ৬০০ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। রাজধানীর কদমতলী থানার এসআই লিটন মিয়া জানান, কদমতলীর মুজাহিদ নগরে সেলিম মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া সাহিদা বেগমের বাসা থেকে গত ৮ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টায় তার ছেলে ইমরান হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ইমরান হোসেন অসুস্থ ছিল। তাকে বাসায় রেখে তার মা সাহিদা বেগম জরুরি কাজে বাইরে যান। বিকেল ৫টার দিকে ফিরে এসে দেখেন ইমরান হোসেন অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তারা জানিয়েছেন, ইমরান মাদকাসক্ত ছিল। রাজধানীর বনানী থানার এসআই শেখ মিজানুর রহমান নিহতের মা মোমেনা বেগমের বরাত দিয়ে বলেন, তার ছেলে আবুল মোকারাম মো. আদিল (৩৩) মাদকাসক্ত ছিল। প্রায়ই নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দুই-তিন দিন টানা ঘুমাতো। তাকে একাধিকবার মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু সে মাদক ছাড়েনি। গত ৭ অক্টোবর সকালের নাশতা খাওয়ার পর সে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি তার। রাতে রুমের ভেতর থেকে গন্ধ বের হলে পরিবারের লোকজন দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন আদিলের লাশ পড়ে আছে। এসআই শেখ মিজানুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে তাকে কেউ হত্যা করেছে মনে হয়নি। এরপরও মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে। ডিএমপি সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানা ও গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে ২২ হাজার ২০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, এক কেজি ৮৯৯ গ্রাম ৫১০ পুরিয়া হেরোইন, ৩০০ গ্রাম গাঁজা ও ২০ লিটার দেশি মদ উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, মাদক ব্যবহারের মাত্রা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মাদক উদ্ধারের হিসাব একমাত্র নির্দেশক নয়। তবু বাংলাদেশে মাদক ব্যবহারের ধারণা নেয়া হয় উদ্ধারের হিসাব থেকেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যে পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়ে, তার কয়েক শ’ গুণ বেশি ইয়াবা এ দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। সূত্র জানায়, স¤প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের মংডু শহরের ইয়াবা কারখানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইয়াবার এসব কারখানায় পাঁচ প্রকার ইয়াবা বর্তমানে তৈরি হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- এসওয়াই, জিপি, এনওয়াই, ডবিøউওয়াই ও গোল্ডেন। সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে দুই শতাধিক বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯০ জন দেশি ও ১৩ জন মিয়ানমারের অধিবাসী। ৯০ শতাংশ ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেফতার এড়িয়ে চলছে। ১০ শতাংশ গ্রেফতার হলেও তাদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। যা ওপেন সিক্রেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন