বিশেষজ্ঞ ও জেলেরা বলছেন পাল্টে গেছে প্রজনন মৌসুম- একথা মানতে পারছে না মৎস্য অধিদপ্তর এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে করে অসময়ে ইলিশ শিকার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মৎস্যজীবীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। অন্যদিকে মা মাছ রক্ষায় গত ১ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও গতকাল বুধবার ১১ অক্টোবর পর্যন্ত জেলেদের খাদ্যসহায়তা (ভিজিএফের চাল) এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে। যথাসময়ে জেলের কাছে খাদ্যসহায়তা ভিজিএফের চাল না পৌঁছানোর কারণে কয়েক লাখ জেলে পরিবারে কাটছে মানবেতর জীবন। এদিকে কতিপয় অসাধু দাদন ব্যবসায়ী ও জেলেরা বসে নেই, তারা মধ্য রাতেই বিভিন্ন এলাকায় জাটকা ইলিশ শিকার করছে। অভিযানও থেমে নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত গ্রেফতার করে জেল-জরিমানা, জাল-নৌকা আটক করছেন। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এবং মৎসজীবী সমিতির নেতা ও প্রবীণ জেলেদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
তারা জানান, ইলিশের প্রজনন মৌসুম পাল্টে গেছে, বর্তমানে প্রজনন মৌসুম হলেও প্রজননক্ষম তেমন মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রজননের উপযুক্ত সময় ছিল, তখনই মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর নিষেধাজ্ঞার সময় পাল্টায়নি। তাই অক্টোবর মাসের এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। অসন্তোষ দেখা দেয় মৎস্যজীবী ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশিদ ইনকিলাবকে জানান, গত ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের একটি টিম ইলিশ মাছের প্রজনন ঋতু সঠিকভাবে নির্ধারণের জন্য চাঁদপুর-ল²ীপুর-বরিশাল অঞ্চলে গবেষণা করছে। প্রজনন ঋতু নির্ধারণের ক্ষেত্রে মা মাছের জিএসআই পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। জিএসআই হলো মাছের ডিমের ওজন ও দেহের ওজনের অনুপাতের শতকরা হার, সাধারণত প্রজনন ঋতুতে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ে বিগত পাঁচ বছরের জিএসআই-এর পরিমাপ থেকে দেখা গেছে। বাংলাদেশে ইলিশ সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত প্রজনন করে। সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে জিএসআই ১০-১১ থেকে বেড়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে এসে সর্বোচ্চ ১৫-১৭ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং নভেম্বরে এসে তা হঠাৎ করে কমে যায়। ১৫-১৭ জিএসআই ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুম নির্দেশ করে।
চিংড়ির মতো ইলিশ মাছও প্রজননের ক্ষেত্রে চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে। এ মাছ ভরা পূর্ণিমায় বা অমাবস্যায় প্রজনন করে। মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাপমাত্রা। প্রজননের জন্য চন্দ্রনির্ভর আবর্তনের ওপর নির্ভরশীল মাছ সারা বছরের মধ্যে তার পছন্দনীয় তাপমাত্রায় যে মৌসুমে পাওয়া যায় সেই মৌসুমে পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যায় প্রজনন করে। ইলিশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০১০ থেকে গবেষণা করে দেখা গেছে, অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত যে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা পড়ে, সেই সময়ে এ মাছের জিএসআই সর্বোচ্চ থাকে।
তিনি বলেন, ইলিশ শুধু পূর্ণিমাতেই প্রজনন করবে এ ধারণা ভুল। চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে এমন অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখে জানা যায় পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যার দিন আগের ও পরের কয়েক দিন ধরে মাছ সবচেয়ে বেশি প্রজনন করতে দেখা যায়। কিন্তু ইলিশ মাছের প্রজনন ঋতু নির্ধারণ এবং ভরা প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে এসব বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০১০ সালের অক্টোবরের ১৬-২৪ তারিখ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। আর পূর্ণিমা ছিল ২৩ অক্টোবর, পূর্ণিমার ২ দিন পর থেকে কি মাছের প্রজনন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? পরবর্তী দুই বছর ইলিশ আহরণ নিষেধাজ্ঞার সময় ১০ দিন করে এগিয়ে আনা হলো। ২০১১ সালের অক্টোবরের ৬-১৬ এবং ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের ২৫ থেকে অক্টোবরের ৫ তারিখ পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে পূর্ণিমা ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে যে ইলিশ ২৩ অক্টোবর প্রজনন করেছিল ২০১২ সালে এসে মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে সে ইলিশ প্রায় এক মাস আগে প্রজনন করবে তা অসম্ভব। ২০১৩ সালে এসে ১৩ থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হলো এবং এ সময় পূর্ণিমা ছিল ১৯ অক্টোবর। ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আবার আগের নিয়মে ১০ দিন করে এগিয়ে আনতে আনতে ২০১৬ ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময় ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে, ইলিশের ক্ষেত্রে প্রতি তিন বছর পরপর প্রজননের চন্দ্রনির্ভর আবর্তন পরিবর্তন হয়ে আগের অবস্থা দিয়ে যাবে?
ড. হারুন আরো বলেন, ভরা প্রজনন মৌসুম নির্র্ধারণের ক্ষেত্রে শুধু ইলিশ আশ্বিনের পূর্ণিমায় প্রজনন করে এ সনাতন ধারণার ওপর নির্ভর করে এ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নির্ধারণ করাটা সঠিক হবে না। বৈজ্ঞানিক গবেষণানির্ভর তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এর সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে আরো অধিক ইলিশ উৎপাদন হবে। নচেৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক (জাটকা) মো: জাহিদ হাবিব ইনকিলাবকে জানান, যারা বলছেন অসময়ে নিষেধাজ্ঞা, তারা আদৌ বিশেষজ্ঞ কি না তা আমার জানা নেই। তাদের গবেষণা ভুয়া। এটি মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিজস্ব ব্যাপার নয়। এটি দেশের ব্যাপার। আমাদের নিজস্ব গবেষণায় এটি নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়কে জানায়। আমরা নির্দেশনা মতে কাজ করছি।
ইলিশ প্রজনন মৌসুমের ১১ দিন পার হলেও কোনো প্রকার খাদ্যসহায়তা বা ভিজিএফের চাল পায়নি ১৬ লাখ ২০ হাজার জেলে। সমুদ্র তীরবর্তী বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, ল²ীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুরসহ উপক‚লীয় এলাকায় বসবাসরত জেলে পরিবারগুলো অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। মৎসজীবীদের সরকার প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ভিজিএফের চাল দিয়ে থাকলেও এখনো কোনো জেলায় এ চাল পৌঁছায়নি। সরবরাহের এ ন্যূনতম খাদ্যসহায়তা নির্দিষ্ট সময়ে না পেয়ে লাখ লাখ জেলে পরিবার অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করছে। এ নিয়ে জেলেদের মাঝে চরম ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে। কেউ কেউ পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্য রাতে নদীতে মাছ ধরতে বাধ্য হচ্ছে এমন খবরও পাওয়া গেছে। মাছ ধরতে গিয়ে অনেক জেলেকে জেলে যেতে হয়েছে। অনেককে জরিমানা দিতে হয়েছে। অনেক জেলের ধরা মাছ লুট করে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। আদৌ তারা খাদ্যসহায়তা ভিজিএফের চাল পাবে কি না এ বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কেউ কিছুই জনেন না বলে জানা গেছে। তবে চাঁদপুর, ল²ীপুর, নোয়াখালী, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠী, পিরোজপুর, বরিশালের স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দেরিতে হলেও পাওয়া যেতে পারে। বেকার জেলেরা অন্য কোনো কাজ করতে না পারায় তারা এখন অলস সময় অতিবাহিত করছেন। এতে করে উপকূলীয় জেলাগুলোতে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয় জনসাধারণ।
প্রাণী ও প্রজনন বিশেষজ্ঞ ড. আবুল কাশেম চৌধুরী ইনকিলাবকে জানান, প্রজননের জন্য ইলিশ স্বাদু পানির স্রোতের উজানে অগভীর পানিতে উঠে আসে এবং ডিম ছাড়ে। মুক্ত ভাসমান ডিম থেকে পোনা বের হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রজননক্ষম হয়ে জীবনচক্র পূর্ণ করার জন্য আবার নদীতে ফিরে আসে। তিনি বলেন, ইলিশ আমাদের দেশের অন্যতম একটি সম্পদ। ইলিশ উচ্চ উৎপাদনশীল। বড় আকারের একটি ইলিশ ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। সরকারের নিষেধাজ্ঞার সময় আরো ১০-১৫ দিন আগে নিলে খুব ভালো হতো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ইনকিলাবকে জানান, ইলিশ শুধু বাংলাদেশের সম্পদই নয়, সুস্বাদু একটি প্রকৃতি প্রদত্ত মাছ। এটা নিয়ে অবহেলা করলে ক্ষতি শুধু দেশেরই হবে না, মানুষেরও হবে। এ মাছকে ঘিরে লাখ লাখ জেলে পরিবারের জীবন-জীবিকা জড়িত। তার ওপর এ মাছ পুষ্টিতে ভরপুর। কখনো সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে, কখনো নাগালের বাইরে থাকলেও এটিকে সুরক্ষা করা সবার নৈতিক দায়িত্ব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক উপজেলা চেয়ারম্যান জানান, এটি নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই। জেলেরা বেঁচে থাকলে দেশের লাভ। এখন পর্যন্ত কোনো খাদ্যসহায়তা চাল না আসা পর্যন্ত অত্যন্ত দুঃখজনক।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক (জাটকা) জাহিদ হাবিব ইনকিলাবকে মুঠোফোনে জানান, এ ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি, এখনও হ্যাঁ-না উত্তর পাওয়া যায়নি। রোহিঙ্গা শরণার্থীর কারণে মন্ত্রণালয় ঐ দিকে ব্যস্ত। যার কারণে জেলেদের খাদ্যসহায়তা চাল পেতে দেরি হতে পারে।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা মো: মোস্তফা বেপারী ইনকিলাবকে জানান, ইলিশ মাছ কারো সম্পদ নয়। এটা আল্লাহর দেয়া সম্পদ। মৎস্য বিভাগ এবং মন্ত্রণালয় এ সম্পদকে নষ্ট করতে চাইছে। তা না হলে ২ অক্টোবর থেকে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা শুরু হলেও ১১ দিন পার হলো এখনো অনিশ্চিত জেলেদের খাদ্যসহায়তা। চাল পাবে কি পাবে না। চাল না দেয়া হলে সরকার ভুল করবে। রোহিঙ্গা তো আমাদের সম্পদ নয়। জেলেরাই আমাদের সম্পদ। অবিলম্বে জেলেদের চাল বরাদ্দের দাবি জানান তিনি।
মৎস্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে জানা গেছে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত সারাদেশে ৭১৩৫টি অভিযান করা হয়েছে। এ অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১০৪২ জন জেলেকে আটক করে জেলে পাঠিয়েছে। ২৮ লাখ ৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ৩২.৭৪ মেট্রিক টন কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে। মৎস্য বিভাগের তালিকাভুক্ত রয়েছে ১৬ লাখ ২০ হাজার জেলে।
একটি সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে ল²ীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনা নদীর ১শ’ কিলোমিটার এলাকায় এ নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে জারি করা হয়েছে। চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: সদিকুর রহমান জানান, গত কয়েক বছর জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। দেশের কয়েকটি অভয়াশ্রমের মধ্যে চাঁদপুর, ল²ীপুরের ১শ’ কিলোমিটার এলাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের প্রধান মৎস্য গবেষক ডা: মাসুদ হোসেন খান জানান, ২০১৬ থেকে ২০১৭ অর্থবছরে অভিযানের কারণে ৬ লাখ ৬৮ হাজার ২৯১ কেজি ডিম উৎপাদন হয়। ফলে ৩৯ হাজার ২৬৮ কেজি যুক্ত হয়। সর্বোপরি জেলেরা ৩ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন