শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত জ্যাং জো সমুদ্র অর্থনীতি খাতে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। গত শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতির সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেছেন, সমুদ্র অর্থনীতি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য তিনি প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বাংলাদেশে সমুদ্র অর্থনীতির, যা ইতোমধ্যেই ব্ল ইকোনমি হিসাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে, ব্যাপক সম্ভাবনা সম্পর্কে চীনের রাষ্ট্রদূতই নন, বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও কোনো দ্বিমত অথবা সংশয় নেই। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা নিয়ে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তার অবসান ঘটেছে। সমুদ্র অর্থনীতির বিকাশে যে বাধা ছিল, এখন তা নেই। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমার অভ্যন্তরে বিভিন্ন রকমের বিপুল সম্পদের উপস্থিতি রয়েছে। এসব সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার করতে পারলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন দ্রæতায়িত হতে পারে সঙ্গতকারণেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুদ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে অফুরান মৎস্য ও জলজ সম্পদ। আরো আছে মূল্যবান বালি, ইউরেনিয়াম ও থোবিয়ামসহ নানা প্রকার খনিজ। সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশেরও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। স্বভাবতই সমুদ্র সম্পদভিত্তিক শিল্পের বিকাশ হলে তাতে সৃষ্টি হতে পারে ব্যাপক কর্মসংস্থান। দু:খজনক হলেও স্বীকার করতে হচ্ছে, সমুদ্র সীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়ার পর সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের যে উদ্যোগ-পদক্ষেপের প্রত্যাশা ছিল, তা এখনো নেয়া হয়নি। পক্ষান্তরে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় কাজ শুরু করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারা ইতোমধ্যে তাদের সমুদ্র এলাকায় তেল ও গ্যাসের সন্ধান লাভ করেছে। আমরা এক্ষেত্রে মোটেই এগুতে পারেনি। অন্যান্য সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণেও আমরা উদ্যোগী হতে পারিনি।
বাস্তবতা এই যে, ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভের সম্পদরাজী দ্রুত নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমুদ্র সম্পদের দিকে নজর দিয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা ৯০০ কোটিতে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে হলে যে বিপুল সম্পদের প্রয়োজন, তা ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভ থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সেক্ষেত্রে সমুদ্রের দিকে হাত বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনেক আগেই এদিকে এগিয়ে এসেছে এবং সুফল পেতে শুরু করেছে। বিশ্ব অর্থনীতি ও সমুদ্র অর্থনীতির সুবিধা পেতে শুরু করেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববাসীর জন্য ১৫ শতাংশ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। বিশ্বের অন্তত ৩০ শতাংশ গ্যাস ও তেলের সংস্থান করছে সমুদ্রতলের গ্যাস ও তেল ক্ষেত্রগুলো। বহুদেশ সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। দেশটি এর মধ্যেই এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান দাঁড়াবে জাতীয় বাজেটের ১০গুণ। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র সম্পদ থেকে প্রতিবছর আয় করছে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সাল নাগাদ এই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় তেল-গ্যাসের বড় রকমের মজুদ আছে, মৎস্যসহ নানা জলজ সম্পদ আছে, আছে বিভিন্ন মূল্যমানের খনিজ সম্পদ। পর্যটন সম্ভাবনাও অপার। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে পর্যটন সুবিধা ও অবকাঠামো নির্মাণ করা গেলে এই খাত থেকে প্রতিবছর বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আসতে পারে। আরো একটি সম্ভবনার কথা উল্লেখ করা দরকার। সমুদ্র আমাদের ভূমি বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। আমাদের দেশ ছোট; লোকসংখ্যা সেই তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের ভূমির দরকার আবাদের জন্য, বাসগৃহ নির্মাণের জন্য, শিল্পকারখানা নির্মাণের জন্য। পরিকল্পিত উদ্যোগ ও পদক্ষেপের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে এই ভূমি আমরা পেতে পারি।
অন্যান্য দেশের জন্য যাই হোক, আমাদের দেশের জন্য সমুদ্র অর্থনীতির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। সরকারের এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি ধারায় সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। অথচ এখনো সমুদ্র সম্পদের পূর্ণাঙ্গ জরিপই হয়নি। জরিপই যেখানে হয়নি সেখানে অনুসন্ধান ও সংরক্ষণ কীভাবে হবে? সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার তো আরো পরের কথা। এটা অত্যন্ত দু:খজনক। সরকারকে অবশ্যই সমুদ্র অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা নিতে হবে এবং এর সপক্ষে উপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা উন্নয়ন ও উপয্ক্তু মানব সম্পদ তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জনগণের কাঙ্খিত জীবন মান উন্নয়নে সমুদ্র অর্থনীতির বিকল্প নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন