ইদলিবে আরো বিশেষ বাহিনী ও কমান্ডো পাঠিয়ে তুরস্ক সিরিয়ায় তার সর্বশেষ সামরিক হস্তক্ষেপের দ্রুত বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। তুরস্কের এ সামরিক অভিযান হচ্ছে প্রধানত আল কায়েদার নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তর পশ্চিম সিরীয় প্রদেশে একটি সংঘাতমুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ প্রচেষ্টার অংশ যাতে সমর্থন রয়েছে মস্কো ও তেহরানের।
গত বছরের পর এটাই হচ্ছে সিরিয়ায় তুরস্কের বৃহত্তম সামরিক হস্তক্ষেপ। সে সময় তুর্কি সেনাবাহিনী এক সময়ের মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ও বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে তুরস্কের উপর নির্ভরশীল ফ্রি সিরিয়ান ফোর্সেস (এফএসএ)-এর সাথে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও কুর্দিশ পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি)কে বিতাড়িত করার জন্য অভিযান চালায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বসাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের কয়েকটি লক্ষ্য আছে। তার মধ্যে রয়েছে একটি কুর্দি ছিটমহলকে ঘিরে ফেলা। তুরস্ক চায় না যে কুর্দিদের এ ছিটমহলটির সাথে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত আরো উত্তরের এলাকার সংযুক্তি ঘটুক। তুরস্কের এ পদক্ষেপ পশ্চিমাদের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছাড়াই সিরিয়ার বহু বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ অবসানে মস্কো, তেহরান ও আংকারার সম্মিলিত প্রচেষ্টার অংশ।
তুর্কি কর্মকর্তারা বলেন, ইদলিবে তুরস্কের সামরিক অভিযান হচ্ছে ইদলিব ভিত্তিক সিরিয়া সরকার বিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপগুলো ও বাশার আল আসাদের সরকারের মধ্যে সংঘর্ষ হ্রাসে গত মাসে রাশিয়া ও ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির অংশ। তুরস্কের জন্য আল কায়দার সিরীয় শাখা হায়াত তাহরির আল শামসসহ সরকার বিরোধী বিদ্রোহী ও সিরিয়া সরকারের মধ্যে লড়াই কমে এলে তুর্কি সীমান্তে সিরীয় উদ্বাস্তু আগমন হ্রাস পাবে। ইদলিব প্রদেশে প্রায় ২০ লাখ লোকের বাস। এ প্রদেশে একটি সংঘাত মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়ার আগে প্রদেশটি রাশিয়া ও সিরিয়ার জঙ্গি বিমানের নির্বিচার বোমা বর্ষণের স্থান ছিল যাতে শত শত বেসামরিক লোক নিহত হয়।
ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ^বিদ্যালয়ের বিশ্লেষক চেঙ্গিস ওমর গত সপ্তাহে ইস্তাম্বুলে একটি সম্মেলনে বক্তৃতায় বলেন, এ সামরিক অভিযানের একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কে সিরিয়ার উদ্বাস্তু আগমনের নতুন স্রোত বন্ধ করা।
২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর তুরস্কের ট্যাংক ও সামরিক যান সিরীয় সীমান্তে অবস্থান নেয়। সোমবার তুরস্কের সামরিক বাহিনী বলে, আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একটি সংঘাতমুক্ত অঞ্চল বলবত করার লক্ষ্যে তুর্কি সৈন্যরা সিরিয়ার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশে প্রবেশ করেছে।
দামেস্ক তুর্কি অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এ অভিযান হচ্ছে তার সার্বভৌমত্বের লংঘন। সিরিয়া শনিবার ইদলিবে এফএসএ বাহিনীর সাথে মোতায়েন তুর্কি সেনাদের অবিলম্বে ও নিঃশর্ত প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও একজন জ্যেষ্ঠ আইন প্রণেতা কানি তরুন আল জাজিরাকে বলেন, তুর্কি সৈন্য প্রত্যাহারে সিরিয়া সরকারের দাবি দেশের জনগনের আইওয়াশ মাত্র এবং তা গুরুতর কিছু নয়।
রাশিয়ার কোনো আপত্তি নেই
বাশার আল আসাদের এক প্রধান মিত্র রাশিয়া সিরিয়ায় তুর্কি সামরিক অভিযানের কোনো প্রতিবাদ করেনি। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, ইদলিবের সংঘাতমুক্ত অঞ্চল হচ্ছে সিরিয়ায় প্রস্তাবিত ৪টি সংঘাতমুক্ত অঞ্চলের একটি। এটি আস্তানা আলোচনার ঐকমত্য অনুযায়ী রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক কর্তৃক নিরাপত্তা প্রদত্ত।
কুর্কি পার্লামেন্টের মুখপাত্র ইসমাইল কাহরামান শনিবার রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ার কর্মকর্তাদের সাথে এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়ার সাথে সহযোগিতা আমাদের পররাষ্ট্র নীতির একটি প্রধান বিষয়। সিরিয়ার ব্যাপারে মস্কোর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ইদলিবের বাব আল হাওয়া সীমান্ত দিয়ে ট্যাংক ও সামরিক যানসহ ৪টি তুর্কি সামরিক বহর সিরিয়ায় প্রবেশ করতে শুরু করে। শনিবার আরো বহু কনভয়কে সীমান্তে সমবেত দেখা যায়।
এফএসএ বিদ্রোহীরা বলে, তুর্কি অভিযাত্রী বাহিনী ইদলিবের ৪০ কি মি অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে যার ফলে বাব আল হাওয়া থেকে জারাবøুস শহর এবং দক্ষিণে আল বাব শহর থেকে উত্তরপূর্বে আলেপ্পো পর্যন্ত বিস্তৃত সিরিয়ার একটি এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে।
ওয়াইপিজির সাথে সংশ্লিষ্ট সিরীয় কুর্দিদের মতে, তুর্কি সামরিক অভিযান তাদের প্রতি পুনরায় হুমকি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে তুর্কি সীমান্তে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হবে যেগুলোর কিছু তারা এফএসএ ও জিহাদিদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল।
তুরস্কের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আফরিন ছিটমহল। তুরস্ক সেখানকার কুর্দি বাহিনীকে বহিষ্কার করার হুমকি দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১৩ অক্টোবর আংকারায় দলের সদস্যদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, আফরিনে ছোট ভুলও বরদাশত করা হবে না।
তবে এ সামরিক অভিযান তুরস্কের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তারা যদি ইদলিবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হতে চায় তাহলে বহু ক্ষুদ্রক্ষুদ্র গ্রুপকে দমন করতে হবে। এর মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে সাবেক জাবহাত আল নুসরা বা হায়াত তাহরির আল শাম (এইচ টি এস) কে দমন করা।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিংক ট্যাংক দি সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের সিরিয়া বিশেষজ্ঞ আরোন ল্যান্ড বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে তুরস্ক কিভাবে সংঘাতমুক্ত অঞ্চল কার্যকর করবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইদলিবের প্রধান অংশই হায়াত তাহরির আল শামের নিয়ন্ত্রণে। আন্তর্জাতিকভাবে এটি সন্ত্রাসী গ্রুপ বলে পরিচিত।
এখন পর্যন্ত তাহরির আল শামস তুর্কি বাহিনীর মোকাবেলা না করে তাদের ও তাদের মিত্রদের ইদলিবের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দিয়েছে। এমনকি তারা গত সপ্তাহে আফরিন ঘেরাও করতে তুর্কি বাহিনীকে সহায়তা করে। এ ঘটনার পর কুর্দিরা আংকারার বিরুদ্ধে জিহাদিদের সাথে যোগসাজশের অভিযোগ করেছে।
নীতি গবেষণা কেন্দ্র কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের বিশ্লেষক ইয়াজিদ সাইগ বলেন, তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসরমান তুর্কি বাহিনীর লড়াইয়ের ঝুঁকি না নিয়ে তুর্কিদের সাথে সহযোগিতা করা ছাড়া তাহরির আল শামের কিছু করার নেই। তবে এইচটিএসের দলছুট অংশ যারা ওসামা বিন লাদেনের ছেলে হামজার প্রতি আনুগত্য ব্যক্ত করেছে, তারা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
জিহাদ ও সন্ত্রাস মনিটর গ্রুপ মিডল ইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, আনসার আল-ফুরকান ফি বিলাদ আল শাম (সিরিয়ার কুরআন সমর্থকগণ) প্রধানত মার্কিন স্বার্থকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। তবে ১০ অক্টোবর এক বিবৃতিতে তারা বলে, তারা তুর্কি সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন