সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

যুবলীগ নেতাকে গুলি : আটকের পর থানায় হম্বিতম্বি: সড়কে ব্যারিকেড জনদুর্ভোগ

চট্টগ্রামে আ‘লীগ নেতা মঞ্জুর কান্ড

চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

 ‘মদ্যপ’ আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু গুলি করেন যুবলীগ নেতা জয়নাল আবেদীনের পায়ে। অস্ত্রসহ আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর সেখানেও তিনি পুলিশকে গালাগাল, হম্বিতম্বি ও ক্ষমতার দাপট দেখান। আটক করে থানায় নেওয়ার পরও তাকে থানা হাজতে নেওয়া যায়নি, তিনি বসে থাকেন ওসির কক্ষে চেয়ারে। শনিবার গভীর রাতে নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন অফির্সাস ক্লাবের সামনে সড়কে এই গুলির ঘটনা ঘটে। মঞ্জুর বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে। তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সদস্য সচীব মঞ্জুর ঠিকাদারী ব্যবসাও আছে। ঠিকাদারী ও পরিবহন খাতে তিনি ‘ডন’ হিসাবেও পরিচিত। তাকে আটকের প্রতিবাদে গতকাল (রোরবার) সকাল থেকে হাটহাজারীতে সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষোভ করে তার সমর্থক আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী ও পরিবহন শ্রমিকেরা। এতে করে উত্তর চট্টগ্রাম এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির সাথে বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। লোকজনকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়।
যুবলীগ নেতাকে গুলি করে পুলিশের হাতে আওয়ামী লীগ নেতার আটক হওয়ার ঘটনা এবং এর প্রতিবাদে সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এনিয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও দিনভর তোলপাড় চলে। তবে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা কোন প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন কিছু বলতে চাননি। ‘প্রচন্ড জ্বরে’ ভুগছেন জানিয়ে তিনি পুরো বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং কথা শেষ করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়াম্যান এম সালামও এবিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। গুলিবিদ্ধ জায়নাল আবেদীনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে তার পায়ের গুলি বের করা হয়। তার বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। তিনি আনোয়ারা উপজেলা থেকে নির্বাচিত চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য এস এম আলমগীরের ছোট ভাই।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জসিম উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, এমএ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন অফিসার্স ক্লাবের সামনে শনিবার রাতে ওই গুলির ঘটনা ঘটে। অফিসার্স ক্লাবে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরে মঞ্জু পিস্তল বের করে জয়নালের পায়ে গুলি করেন। খবর পেয়ে পুলিশ আহত জয়নালকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। আর মঞ্জুকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। ওসি বলেন, ওই পিস্তলের লাইসেন্স রয়েছে বলে মঞ্জু তাদের জানিয়েছেন। তবে কী নিয়ে জয়নালের সঙ্গে মঞ্জুর বিরোধ তৈরি হয়েছিল, সে বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। জয়নালকে নিজের পিস্তল বের করে গুলি করার সময় মঞ্জু অসংলগ্ন ছিলেন বলেও জানান ওসি। ক্লাবের কয়েক জন সদস্য জানান, জয়নালের সাথে এর আগেও মঞ্জুর ঝগড়া হয়। ক্লাবের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলছিল। অফিসার্স ক্লাবের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাসুকুর রহমান সিকদার বলেন, ক্লাবের সামনে গুলির ঘটনা আমরাও শুনেছি। আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ক্লাবের ভেতরে জয়নালের সাথে মঞ্জুর কথা কাটাকাটি শুরু হয়। তারা দুই জনেই ওই ক্লাবের সদস্য। এক পর্যায়ে জয়নাল মঞ্জুকে মারতে উদ্যত হন। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মঞ্জু ক্লাবের সামনের সড়কে গাড়িতে থাকা পিস্তল বের করে জয়নালের পায়ে গুলি করেন। এসময় তিনি ক্লাবের দেওয়ালেও কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েন। টহল পুলিশ ঘটনা থেকে থানায় খবর দেয়। খবর পেয়ে থানার ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ সেখানে ছুটে যায়। তাৎক্ষণিক বিষয়টি ওসি উর্ধতন কর্মকতাদের জানান। পরে তাদের নির্দেশে ওসি মঞ্জুকে আটক করে থানায় নিয়ে যান। জয়নালকে গুলি বিদ্ধ অবস্থায় প্রথমে থানায় নেওয়া হয় পরে পুলিশের গাড়িতে করে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পুলিশ জানায়, মঞ্জুকে আটক করার পর থেকে তিনি পুলিশকে গালমন্দ করতে থাকেন। থানায় নিয়েও তাকে হাজতে নেওয়া যায়নি। তিনি ওসির কক্ষে চেয়ারে বসে থাকেন। সেখানে বসে তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকিও দেন বলে জানান পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। তাকে ছাড়িয়ে নিতে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা দৌঁড়ঝাপ শুরু করেন। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে মামলা দিতে তৎপর হয়ে উঠেন আহত জয়নালের পক্ষের আওয়ামী লীগ নেতারা। রাতে থানায় ছুটে যান জয়নালের বড় ভাই ও জেলা পরিষদের সদস্য এস এম আলমগীরসহ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারা। তাদের পক্ষ থেকে মঞ্জুর বিরুদ্ধে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেয়া হয়।
তবে সেটিকে মামলা হিসেবে রেকর্ড না করতে পুলিশকে চাপ দেয় মঞ্জু ও তার পক্ষের আওয়ামী লীগ নেতারা। রাতভর থানায় এনিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের নেতাদের ব্যাপক শো-ডাউনের খবরও জানান পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। অফিসার্স ক্লাবে মদপানের বিষয় নিয়েও প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ ক্লাবে মদ বিক্রির অনুমোদন আছে কিনা এব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হবে। ক্লাবের প্রধান ফটকে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল থেকে যুবলীগ নেতাকে গুলি করেন মঞ্জু। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এব্যাপারে পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোন মামলা না করলেও লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে লিখিত সুপারিশ করা হবে। তবে থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয় নিজের আত্মরক্ষার জন্য। মামলা তদন্তে বোঝা যাবে কোন প্রেক্ষাপটে তিনি পিস্তল থেকে গুলি করেছেন।
মঞ্জুর বাড়ি হাটহাজারী উপজেলায়। সেখানে আওয়ামী লীগের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, পরে জেলা ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য ছিলেন তিনি। পরিবহন ব্যবসা ও ঠিকাদারী নিয়েও তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগেও তাকে ঘিরে রয়েছে নানা অসন্তোষ। জেলার সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দলের ভেতরে বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। জেলা আওয়ামী লীগের একটি সূত্রমতে, মঞ্জুকে আটকের খবর পেয়ে রাতেই তার অনুসারীরা থানায় যান। বিভিন্নভাবে ছাড়ানোর তদবির করে ব্যর্থ হন তারা। তাকে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সকালে হাটহাজারীতে সড়ক অবরোধ করে তার অনুসারীরা। এতে দুর্ভোগে পড়েন উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার মানুষ।
হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টায় ব্যারিকেড দেয় চট্টগ্রাম নাজিরহাট খাগড়াছড়ি বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি, খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের নেতাকর্মী ও অনুসারীরা। এতে উত্তর চট্টগ্রামের সঙ্গে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে মঞ্জুর অনুসারী ও পরিবহন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে পুলিশ প্রশাসন। এরপর বিকেলে ব্যারিকেড তুলে নিলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। হাটহাজারীতে সড়ক অবরোধ করায় ফলে দুর্ভোগে পড়েন চট্টগ্রাম-নাজিরহাট-খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম-রাউজান-রাঙামাটি রুটসহ নগরমুখী যাত্রীরা। আটকা পড়ে কয়েকশ যানবাহন। অবরোধের কারণে শহর থেকে অনেকেই কর্মস্থলে যেতে পারেননি।
মামলা নেয়নি পুলিশ, ২১ ঘণ্টা পর পার পেলেন মঞ্জু
এদিকে আটক করে থানায় নেয়ার পরও আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জুরুল আলম মঞ্জুর বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি পুলিশ। ফলে থানায় আটকের ২১ ঘণ্টা পর পার পেয়ে যান মঞ্জু। গতকাল দুপুর ২টায় গুলিবিদ্ধ জয়নাল আবেদীনের বড় ভাই আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের সদস্য এসএম আলমগীর কোতোয়ালী থানায় এজাহার জমা দিলেও পুলিশ তা রেকর্ড করেনি। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে পুলিশ মামলা নেয়নি। এ ব্যাপারে কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে রাত সাড়ে ৮টায় তিনি ইনকিলাবকে জানান, যিনি গুলি করেছেন তিনি আওয়ামী লীগ নেতা। আর যিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি যুবলীগের নেতা। ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা বিষয়টি আপোস করার চেষ্টা করেন। শেষপর্যন্ত তাদের মধ্যে আপোস হওয়ায় মামলা হয়নি। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় মঞ্জুকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার সকল প্রক্রিয়া শেষ করে আনেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের একজন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস উদ্দিন ইনকিলাবকে জানান, আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপে আপোস রফা হয়েছে। থানায় কোন মামলা হয়নি, আর কিছুক্ষণের মধ্যে মঞ্জুকে আমরা থানা থেকে নিয়ে যাব। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা তাকে ছাড়িয়ে নিতে আপোস রফা করেছেন। এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইনকিলাবকে জানান, বিষয়টি আপোস রফায় মিটমাট হয়েছে। তবে তিনি এর বেশিকিছু বলতে চাননি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Naim Khan ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ৫:৫৪ এএম says : 0
desh ta e to tader , tai tara ja isse ta e korte pare
Total Reply(0)
রাজিব ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ৫:৫৫ এএম says : 0
এদের মত কিছু লোকের কারণে দলের দুর্ণাম হয়।
Total Reply(0)
Nurun Nabi Jamal ২৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:৫৩ পিএম says : 0
এটাইতো বাংলাদেশের নিয়ম!
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন