বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

অধ্যক্ষ মাওলানা ফখর উদ্দীন (রহঃ)

মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নম্রতা ও বিনয়াবনতা, দানশীলতা, তাকওয়া ও পরহেজগারী এবং আশেকানে রাসূল প্রভৃতি গুণাবলীতে তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। ব্যবহার ছিল অমায়িক, সুমধুর এবং নিরহংকার। কোন দিন তিনি বংশীয় ঐতিহ্য এবং ইলমের বাহাদুরী করতেন না। যে কেউ তাঁর সাথে যে কোন ধরনের কথা বলতে পারতেন, এতে তিনি বিন্দুমাত্র বিরক্তিবোধ করতেন না। তিনি সব সময় কুরআন, হাদীস, দালায়েলুল খায়েরাত ও দরুদ শরীফ পাঠে রত থাকতেন। তিনি বড়দের প্রতিযথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ করতেন। তিনি সত্য ভাষী, সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন। লাজুকতায় তাঁর দৃষ্টি সব সময় নিম্নগামী হত। তিনি স্বীয় পিতার ন্যায় আচার ও অভ্যাসে আদর্শ নমুনা ছিলেন। তিনি রাসূল পাক (সাঃ) এর প্রতি গভীর ভালবাসা এবং গাউসুল আযম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) সহ অন্যান্য অলীয়ে কেরাম গণের প্রতি ভক্তি এবং শ্রদ্ধা তাঁর জীবনের উন্নত ভূষন। ইসলাম ও শরীয়তের সুরক্ষায় এবং রাসূল পাক (সাঃ) এর মান সম্মান সমুন্নত রাখার ব্যাপারে আল্লামা ফখর উদ্দীন (রহঃ) সব সময় নির্ভীক ভূমিকা পালন করেন। তিনি ইসলামী আইন চর্চার ও সত্য প্রতিষ্ঠায় অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন। তিনি অতিথি পরায়ন ছিলেন। অসংখ্য লোক তার সাথে সাক্ষাতের জন্য এবং বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে জানার জন্য আগমন করতেন। তিনি তাদেরকে বিনা মেহমানদারীতে ফিরিয়ে দিতেন না। কারো উপহার লাভের লোভ তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি অত্যন্ত স্বল্পহারী ছিলেন। তবে সামান্য মুখরোচক খাবার তিনি পছন্দ করতেন।তিনি কোনদিনই তার পরিমাণের বেশী খেতেন না। তবে, চা এক কাপ বেশী দিলে তিনি সাধারণত তা না করতেন না। তিনি মাত্রা অনুযায়ী পানও খেতেন। তাঁর চলাফেরা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। জাঁকজমকপূর্ণ মূল্যবান বস্ত্র তিনি কখনো পরিধান করতেন না। তাঁর ব্যবহার্য বস্ত্রাদি তিনি নিজেই ধুতেন। নিজের কাজ নিজেই করতেন। তাঁর সন্তান-সন্ততি থাকা সত্তে¡ও নিজেই বাজারে গিয়ে পরিবারের জন্য বাজার করে নিয়ে আসতেন। আরাম ও বিলাসিতাকে তিনি ঘৃণা করতেন।তিনি সব সময় সুগন্ধী (আতর) ব্যবহার করতেন। সাহবায়ে কেরামের আড়ম্বরহীন সহজ সরল জীবনই তাঁর অত্যন্ত পছন্দের ছিল এবং তাঁদের অনুসরণ করেই তিনি জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করতেন। তিনি গৃহস্থালী কাজেও অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন।তিনি জমির আগাছা পরিষ্কার, বীজক্ষেত তৈরী, নানা ফল গাছ চারা রোপণ ও পরিচর্যা,সার দেয়া, গ্রামে ঘরের চারপাশে সীমানা দেয়া, মহিলাদের গোসলের ব্যবস্থার জন্য নিজেই জল ঘাট নির্মাণ সহ ইত্যাদি কাজ অত্যন্ত সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতেন। এসব কাজে তিনি অত্যন্ত আনন্দ পেতেন এবং পরিবারকেও এসব কাজ করার উৎসাহ যোগাতেন।
শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখর উদ্দীন (রহ:) একজন ব্যাক্তি নন। বরং তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি একটি আনজুমান, একটি একাডেমী, একটি গবেষণা ইনষ্টিটিউটও বটে। এই আলেমে দ্বীন একজন বিশিষ্ট সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারের অন্যতম পুরোধা, শরীয়ত বিরোধী ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ উচ্ছেদ আন্দোলনের আপোষহীন প্রবক্তা, সত্যনিষ্ঠা এবং বাতিল মতাবাদের আতংক ছিলেন।এমন কি তিনি একজন সংগঠকও বঠে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের নেতৃত্বে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাক্তন ছাত্র সমিতি গঠনের পেছনে তাঁর অনেক চেষ্টা ও অবদান ছিলো। আলিয়া মাদ্রাসার সমস্যা নিয়ে জাতীয় পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট করানোর জন্যেও তিনি বিভিন্ন সূত্রে অনেক কাজ করেছিলেন। তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হাল-নাগাদ তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতেন।ছাত্রাবাসের সমস্যা সমাধানের জন্যে তার অক্লান্ত চেষ্টা ও প্লান একটা ইতিহাস হয়ে আছে। মাদ্রাসা-ই-আলিয়া সিলেটে কর্মরত থাকাবস্থায় তিনি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান, নকল ও সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান, বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন, জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি, বিনামূল্য শিক্ষা উপকরণ বিতরন, রক্ত দান কর্মসূচি সহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যে অংশ গ্রহণ করেন। এমনকি এই আলেমেদ্বীন সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার রোভার স্কাউটের উপদেষ্টা সহ বিভিন্ন সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্ব পূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১৮ জুন লোহাগাড়া থানার চুনতীর বড় মৌলভীর বাড়ী মাওলানা আব্দুল হাকীমের বংশধর মাওলানা আব্দুন নূর সিদ্দিকীর ১ম কন্যা ফাতেমা বতুলসিদ্দিকার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর শ্বশুর একজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন এবং অলীয়ে কামেল ছিলেন। তিনি সাবেক অধ্যক্ষ বাজালিয়া হেদায়াতুল ইসলাম সিনিয়ার মাদ্রাসা ও হুলাইন ইয়াছিন আউলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসায় সুনাম ও দক্ষতার সহিত নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চুনতী হাকীমিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মুহাদ্দিস এবং পদুয়া হেমায়াতুল ইসলাম সিনিয়ার মাদ্রাসা (আল জামেউল আনওয়ার)’য় সাবেক মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি চুনতী মিয়াজী পাড়া হযরত শাহ আবু শরীফ জামে মসজিদে পেশ ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি চন্দনাইশ সাতবড়ীয়া আরিফ শাহ পাড়া জামে মসজিদ এবং কুসুমপুরা জামে মসজিদ (জিরি) এ ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমন কি তিনি বাংলাদেশ ছাড়া বার্মা (মায়ানমার) এবং ভারতের কাশমীরী গেইট, উঁচী মসজিদ দিল্লী তে পেশ ইমাম ও খতীব হিসেবে নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের দিল্লী প্রদেশে“শ্রেষ্ঠ খতীব” হিসেবে সম্মাননা সনদ এবং পুরস্কার লাভ করেন। এমন কি এই আলেমে দ্বীনকে অভিজ্ঞ অধ্যক্ষ ও প্রশাসক হিসেবে স্বীকৃতি স্বরুপ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্য্যায়ে “শ্রেষ্ঠ শিক্ষক” হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন । যিনি একই সাথে চুনতীর ঐতিহাসসিক ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সিরাতুন্নবী (সাঃ) এর প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রহঃ) এর শ্বশুর ছিলেন। শায়খুল হাদীস অধ্যাপক আল­ামা ফখর উদ্দীন (রহ:)’র ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে যথাক্রমে:১. মুহাম্মদ জালালুদ্দীন, ২. মুহাম্মদ জায়ন্দ্দুীন আহমদ, ৩. মুহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন, ৪.নূরুন নাহার আক্তার পারভীন, ৫. আমাতুল মাওলা মারজানা। তিনি ২০০৮ সালে স্বীয় স্ত্রীকে নিয়ে বায়তুল্লাহ শরীফ তওয়াফ এবং মহানবী (সাঃ) এর রওজায় জিয়ারতের মাধ্যমে হজ্জ্ব পালন করেন। এর আগেও তিনি ১৯৯৩ সালে হজ্জ্ব সম্পন্ন করেন। জ্ঞান, জ্ঞানী ও জ্ঞান পিপাসুদের সাথেই শায়খের ছিলো যত ভাব ও শখ্যতা। এ জন্যে জ্ঞান, জ্ঞানীরা ও জ্ঞান পিপাসুরাও শায়খকে অসম্ভব ভালোবাসতেন এখনও বাসেন। মাদ্রাসা-ই- আলিয়া ঢাকা ও মাদ্রাসা-ই- আলিয়া সিলেট এর কর্মজীবনে মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে তাঁর কয়েকটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন জার্নাল ও ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। হাদীস ও উসূলে হাদীস এবং আছমাউর রেজাল এর উপর তাঁর কয়েকটি গবেষণা মূলক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ উর্দু ভাষায় তাঁর বিবিধ জ্ঞান সমৃদ্ধ পান্ডুলিপি রয়েছে। তিনি এ গুলিকে “মাখযানুল উলূম” নামকরণ করেছিলেন। যা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি। সিহাহ সিত্তার হাদীস গ্রন্থাবলীর ইযাযত সম্বলিত তাঁর লিখিত একটি সনদ মাদ্রাসা-ই- আলিয়া সিলেট এর কর্মরত থাকাবস্থায় বিভিন্ন সময়ে তা প্রকাশিত হয়েছে।
২৬ শে মে ২০১১/২১ জমাদিউস সানি ১৪৩২ হিজরি রোজ বৃহস্পতিবার দুপুরে বুখারী শরীফের দাওয়াতে বোয়ালখালীতে গমন করেন এবং ইমাম বুখারী ও সহী বুখারী শরীফের ফজিলত ও মহাত্মের উপর মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। বিকেলে তিনি স্বীয় গৃহে ফিরেন। সেদিন দিবাগত রাত ১২.১৫ মিনিটে তাঁর প্রভুর ডাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জুমাবার বাদে আসর জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ঐতিহাসিক ময়দানে তাঁর জানাযা নামায অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর বড় জামাতা ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুর রহমানের ইমামতিতে উক্ত জানাযার নামাজ সম্পন্ন হয়। এতে গুণী ব্যক্তিবর্গ সহ হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে তাঁকে তার পারিবারিক কবরস্থান মাওলানা মঞ্জিলে দাফন করা হয়।আল্লাহ পাক তাঁকে আন্বিয়া, সোলাহা ও শুহাদার সাথে জান্নাতুল ফেরদাউসের আলা ইল্লিয়িনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান নসীব করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন