রাসূলুল্লাহ (সা:) যে শরীয়ত নিয়ে আগমন করেছিলেন, তা ছিল দুনিয়ার জন্য সর্বশেষ ও অবিনশ্বর শরীয়ত। এই চিরস্থায়ী ও চিরন্তন এবং সর্বশেষ শরীয়তের জন্য এটাও জরুরি ছিল যে, শরীয়তের এমন এক চিরস্থায়ী বিধানের মূল উৎস অবশ্যই থাকবে যা সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বলে বিবেচিত হবে। এ জন্য এই সর্বশেষ অহীয়ে ইলাহী স্বীয় কিতাবকে নিধানাবলীর নীতি নির্ধারণ এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার আকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং শাখা-প্রশাখার ক্ষেত্রে এই কিতাবের আয়াত সমূহে এমন সকল ইঙ্গিত-ইশারা বিধৃত আছে, যার ধারা প্রবাহ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান এবং মনীষার আলোকে সমুজ্জ্বল। যাদের অন্তর জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ, যাদের সমগ্র বক্ষ সম্প্রসারিত এবং আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ তাদের মনীষা ও অনুভূতি অনুযায়ী আল-কোনআনের ইঙ্গিতপূর্ণ নিদের্শাবলী যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। তাই মহান আল্লাহ পাক মর্যাদার আসন সর্বপ্রথম আম্বিয়াদেরকে প্রদান করেছেন। যেহেতু তাঁরা সর্বোতভাবে মা’সুম ও ত্রæটি মুক্ত সেহেতু তাদের পদ-মর্যাদা ও তাদের প্রসূত সিদ্ধান্ত ও পরিণাম ফলগুলোও সামগ্রিকভাবে ত্রæটিমুক্ত।
তারপর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর উসীলায় এই দায়িত্ব ও কর্তব্য খোলাফায়ে রাশেদীন, আকাবেরে সাহাবা, ইমামগণ, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, মুজতাহেদীন এবং ওলামায়ে ইসলাম সবসময় লাভ করে আসছেন। এর ব্যবহারিক নাম হচ্ছে, ‘ইজতেহাদ।’ যাকে প্রত্যেক যুগের নুবওতের জ্ঞানে বিরঞ্জিত পবিত্রত্মাগণ এবং শরীয়তের গোপন রহস্যাবলীর ধারকগণ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানানুশীলন মোতাবেক তাঁর অহীর আলো সম্প্রসারণের দায়িত্বকে আঞ্জাম দিয়েছেন এবং দিতে থাকবেন। এ কারণেই মহান আল্লাহ পাক কুরআনুল কারীমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জিম্মাদারীও নিজের উপর সমর্পণ করেছেন। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তাড়াতাড়ি ওহী আয়ত্ত করার জন্য তুমি তোমার জিহবাকে এর সাথে সঞ্চালন করো না। তা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব কেবলমাত্র আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি, তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর। তারপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই।” (সূরা কিয়ামাহ : রুকু-১)
এই বয়ান ও বিশ্লেষণের জিম্মাদারী কখনো অহীর দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে যা আল-কুরআনে বিবৃত রয়েছে। এবং কখনো তা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর কাজ ও কথার দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে, যা অবিচ্ছিন্ন বর্ণনা বিন্যাসের মাধ্যমে আহাদীস ও সুনানের কিতাবসমূহে বিধৃত আছে। প্রকৃতপক্ষে এই বয়ান ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আল্লাহপাকের তরফ হতে রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।” (সূরা নহল : রুকু-৬)
আরবী ভাষায় বয়ান এবং ‘তাবয়ীন’ শব্দদ্বয়ের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, উন্মুক্ত করা এবং সুস্পষ্ট করা। এবং এর ব্যবহার দুটি অর্থে হয়ে থাকে। প্রথমত : ঘোষণা এবং প্রকাশ করার অর্থে। অর্থাৎ যা লুক্কায়িত রাখার বিপরীত। দ্বিতীয়ত : বিশ্লেষণ করা ও ব্যাখ্যা করার অর্থে। আল-কুরআনে ‘তাবয়ীন’ শব্দটিকে দু’টি অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এতে করে এই মর্ম উদঘাটন করা যে, কোন্ আয়াতে কি মর্ম তুলে ধরা হয়েছে? তা পূর্বাপর আয়াতগুলোর মাধ্যমেই নির্ধারণ করা যায়। যেমন আল-কুরআনে বিশেষভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, “হে কিতাবধারীগণ! আমার রাসূল তোমাদের নিকট আগমন করেছেন; তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি তার অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করেন এবং অনেক কিছু উপেক্ষা করেন। ” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-৩)
এই আয়াতে ‘তাবয়ীন’ শব্দটি পরিষ্কারভাবে গোপন করা বা প্রচ্ছন্ন করার বিপরীতে উপস্থাপিত হয়েছে। এ জন্য এই আয়াতে ‘তাবয়ীন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রকাশ করা ও ঘোষণা করা। কিন্তুু আল-কোরাআনের সূরা নহলে শব্দটি এভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “আমি তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এবং মুমিনদের জন্য পথ নির্দেশ ও দয়াস্বরূপ।” (সূরা নহল : রুকু-৮)
বস্তুুত : যেখানে এখতেলাফ বা মত-বিরোধ দেখা দেয়, সেখানে প্রকাশ করা ও ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয়। বরং সেখানে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন আছে। কেননা যে বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়, সে বিষয়ের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের পর মতবিরোধ দূর হয়ে যায়। তাই প্রথমোক্ত আয়াতের উপর চিন্তা করা দরকার যা এই সূরার অন্য একস্থানে বিবৃত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “এবং তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।” (সূরা নহল : রুকু-৬)
তবে এক্ষেত্রে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক যে, এই আয়াতে ‘বয়ান’ করার অর্থ প্রকাশ করা অথবা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা। আমাদের মতে এখানে প্রকাশ করার পরিবর্তে চিন্তা ও গবেষণার যোগসূত্রের আলোকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ কথাটি গ্রহণ করাই যথার্থ হবে। কেননা গোপন কাজের প্রকাশ করাকে শ্রবণ করা ও মেনে নেয়ার উপযোগী বলে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু একে চিন্তা ও গবেষণা বলে ধরে নেয়া যায় না। চিন্তা ও গবেষণা করার জন্য এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু প্রকাশ করা ও ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয়।
এক্ষেত্রে যেহেতু আল-কুরআনে নির্দেশাবলীর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব মহান আল্লাহপাকের তরফ হতে রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে প্রদান করা হয়েছিল, সেহেতু তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের এবং নির্দেশাবলীর পায়রুবী ও অনুসরণ করাও আল্লাহপাকের নির্দেশ প্রতিপালন বলেই সাব্যস্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পাক জবানে যে সকল ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রকাশ পেয়েছে তা মূলত : তাঁর নূরে হেকমতের ফল্গুধারা মাত্র। যার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আমরা আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে পেয়ে থাকি।
মানুষের ভাষা ও শব্দাবলীর মাঝে এই শক্তি ও সামর্থ নেই যে, এগুলোর দ্বারা এমন এক কানুন প্রতিষ্ঠা করা যায় যা একদিকে বুদ্ধি ও বিবেচনার বিরোধ হতে মুক্ত হবে এবং অপরদিকে তার মাঝে এমন এক সঙ্গতি থাকবে যা ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য বিষয়াবলীর বিবরণ পূর্ণভাবে বিদ্যমান পাওয়া যাবে।
এরূপ হওয়া মোটেই সম্ভব নয়। কিন্তু আইন ও বিধানের ক্ষেত্রে মানবিক বুদ্ধি ও বিবেচনাপ্রসূত যে সকল মতপার্থক্য ও দুর্বলতা দেখা যায়, তা যদিও সার্বিকভাবে দূর করা যায় না, তবুও এর মাত্রা ও পরিমাণ অবশ্যই কমানো সম্ভব। ইসলাম স্বীয় কানুনে ইলাহীর দ্বারা যা মানবমুখের ভাষার সাথে সম্পৃক্ত এই বুদ্ধি-বিবেচনাপ্রসূত ত্রুটিসমূহ দূর করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর জবানের দ্বারা ব্যবহারিক জীবনে আল-কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে যদিও মানবিক স্মৃতিশক্তি ও বর্ণনা বিন্যাসের উপকরণাদির ত্রুটি এবং দুর্বলতার দরুন এ সকল ব্যাখা বিশ্লেষণেও বুদ্ধি-বিবেচনাপ্রসূত মত-পার্থক্য দেখা দিয়েছে, তবুও একথা স্বীকার করে নিতে হবে যে, যদি এ সকল ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ না পাওয়া যেত, তাহলে বিরোধপূর্ণ বিষয়াবলীর সমুদ্র গভীর হতে গভীরতর হয়ে উঠত।
এ জন্য ইসলামে প্রাত্যহিক জীবনের ঘটমান বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলীর ফায়সালার ধারা এভাবে উন্মুক্ত করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আদালতে প্রত্যহ ও জাতীয় মোকদ্দমা ও ঘটনাবলী পেশ করা হত এবং তিনি অহীয়ে কিতাবের মৌলিক বিধানের আলোকে দুরদর্শীতা ও প্রজ্ঞা-মনীষার দ্বারা এগুলোর ফায়সালা করতেন। এমনকি খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও সদ্য সমুপস্থিত ঘটনাবলীর ও সমস্যাবলীর ফায়সালার জন্য প্রথমত : কিতাবী অহীকে এবং তারপর রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ঐ সকল ফায়সালা ও সিদ্ধান্তকে মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করতেন যা তাঁর নবুওতী প্রজ্ঞা, দূরদর্শীতা এবং আল্লাহর অনুমোদন সূলভ সম্মতির মাধ্যমে প্রকাশ পেত। আর এটাই ছিল সমস্যা সমাধানের মোক্ষম উপায়।
পরবর্তীকালে ফুকাহা ও মুজতাহেদীনে কেরাম এই নিয়মতান্ত্রিকতাকেই গ্রহণ করেছিলেন এবং আংশিক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর চূড়ান্ত ফায়সালা, কিতাবে ইলাহী ও ফায়সালায়ে নবুবীর সাথে সঙ্গতি রেখে প্রদান করেছেন।
যদি তাদের সামনে এমন কোন সমস্যা পেশ করা হত, যার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না, অথবা যার উদাহরণ লাভ করা খুবই মুস্কিল, এসকল ক্ষেত্রে তারা সাধারণ ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ মোতাবেক এবং উপস্থিত বুদ্ধি-বিবেচনা ও মঙ্গলকর অবস্থার পর্যালোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এই সিদ্ধান্তসমূহের সমষ্টিকেই বর্তমানে ফিকাহ শাস্ত্র বলা হয় যা শরীয়তের একমাত্র মানদন্ড হিসেবে সুপরিচিত।
তাবলীগ ও দাওয়াত :
একজন নবীর সর্বপ্রথম ও অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হচ্ছে তাবলীগ এবং দাওয়াত। অর্থাৎ যে সত্য তিনি আল্লাহর নিকট হতে লাভ করেছিলেন তা অন্যান্যদের নিকট পৌঁছে দেয়া এবং যে জ্ঞান তাঁকে প্রদান করা হয়েছিল, তা সম্পর্কে অন্যান্যদেরকে অবহিত করা। আল্লাহর যে পয়গাম তাঁর নিকট পৌঁছেছিল, তা মানুষকে শুনিয়ে দেয়া। তিনি তাঁকে যে সত্যতা সম্পর্কে বা খবর করেছিলেন, তা সম্পর্কে সমগোত্রীয়দের অবহিত করা। যে সম্পদ, যে প্রাণশক্তি, যে বাকশক্তি, যে চিন্তাশক্তি, যে আত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি তাঁকে দান করা হয়েছিল, সেগুলো দাওয়াত ও তাবলীগের পথে ব্যয় করা এবং এই বুঝানো, শিখানো ও সত্য পথে আনয়নের ক্ষেত্রে সত্যতার অভিব্যক্তিকে গ্রহণ করা। আর এই ঘোষণা ও দাওয়াতের মাঝে যে সকল বেদনা ও কষ্ট প্রতিবন্ধক হোক, তাকে শান্তির পরশ বলে বিবেচনা করা। যে যন্ত্রণাই দেখা দিক, তাকে আরাম মনে করা। এই প্রান্তরের বিষাক্ত কাঁটার আঘাতকে ফুলের পরশ বলে মনে করা। এই সত্য আহবানকে স্তিমিত করার জন্য যে শক্তিই মাথা তুলুক না কেন তা পদদলিত করা। মাল ও দৌলত, পরিবার, পরিজন মোট কথা, যে কোন জিনিস এই সফরে সামনে আসুক তা হটিয়ে দেয়া এবং তাঁর যাবতীয় চেষ্টা ও তদবীরের উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর রেজামন্দি, সৃষ্টিজগতের কল্যাণ সাধন এবং রিসালতের দায়িত্ব নিষ্পন্ন করা ছাড়া কিছুই না হওয়া। আম্বিয়াদের দাওয়াত ও তাবলীগের মূলমর্ম হচ্ছে এই যে, এই পৃথিবীতে যত পয়গাম্বর আগমন করেছেন, তাঁরা নিজেদের দায়িত্বকে এতই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন যে, একটি মুহূর্তের জন্যও তাঁরা এতে শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। কারণ বর্তমান বিশ্বে আল্লাহর মহব্বত, ভ্রাতৃপ্রেম ও ভ্রাতৃস্নেহ, মানবিক সহমর্মিতা, নি:স্বদের সাহায্য করা, গরীবদের সাহায্য করা এবং অন্যান্য পুণ্য কর্মকান্ডের যে বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে নবী ও রাসূলদের দাওয়াত ও তাবলীগ, চেষ্টা ও সাধনার শুভ ফলমাত্র। এই পৃথিবীতে বহু বড় বড় চিন্তাবিদ বড় বড় কবি, নামী-দামী দার্শনিক নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলতে বুঝেন অন্যকে বুঝিয়ে দেয়া, বড় জোর জানিয়ে দেয়া। কিন্তুু আম্বিয়ায়ে কেরাম যে সত্যকে লাভ করেন, তা অন্যান্যদের বুঝানো এবং সম্ভাব্য সকল পন্থায় তা প্রচার করা এবং দুনিয়ার মানুষকে তা বিশ্বাস করানোর জন্য তারা নিজেদের সার্বিক শক্তি নিয়োগ করেন। এমনিভাবে তাঁরা প্রত্যেক বিপদকে উপেক্ষা করে, মূল সত্যকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে প্রাণপণ কাজ করেছেন এবং অন্ধজনকে পথের দিশা দেখিয়েছেন। তাই আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রশংসা করে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করত এবং তাঁকে ভয় করত এবং আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করত না, আর হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা আহযাব : রুকু-৫) হযরত মূসা (আ:)-কে হুকুম দেয়া হয়েছিল, “ফেরাউনের কাছে গমন কর, কেননা সে বিরুদ্ধাচরণ করেছে।” (সূরা ত্বাহা) আর রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পয়গামে রাব্বানীকে নির্ভয়ে প্রচার করুন। দুশমনদের ভয় মোটেই করবেন না। কেননা তাঁর হেফাজতের দায়িত্ব শাহন শাহে দো-আলম আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের নিকট হতে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন। যদি তা না করেন তাহলে আপনি তাঁর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ পাক আপনাকে মানুষ হতে রক্ষা করবেন।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১০)
আম্বিয়ায়ে কেরামের তাবলীগ ও দাওয়াতের মাঝে খোশ-খবরী প্রদান ও ভীতি-প্রদর্শন উভয়টিই থাকে। তাবসীর অর্থাৎ খোশ-খবরী দেয়া, আশার বাণী শোনানো এবং এনজার অর্থাৎ আল্লাহর জালালের প্রতি ভীতি-প্রদর্শন করা, আল্লাহর আজাবের ভয় দেখানো এবং মানুষকে তাদের খারাপ পরিণাম সম্পর্কে সচেতন করা। আম্বিয়াদের আগমন এই দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত হয় এজন্য যে, আল্লাহর প্রমাণ উপস্থাপন বান্দাহদের প্রতি যেন পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, আমি “সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূল আগমন করার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসা : রুকু-২৩)
আম্বিয়ায়ে কেরাম পয়গামে ইলাহী পৌঁছানোর সাথে সাথে নিজেদের মঙ্গলাকাঙ্খা, আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতার ঘোষণাও করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “আমি আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাঙ্খী।” (সূরা আ’রাফ : রুকু-৯) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “তারপর সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছিয়েছিলাম এবং তোমাদেরকে হিতোপদেশ দিয়েছিলাম; কিন্তু তোমরা হিতকাঙ্খীদেরকে পছন্দ কর না।” (সূরা আ’রাফ : রুকু-১০) মহান আল্লাহ পাক আরোও ঘোষণা করেছেন, “এবং হে আমার সম্প্রদায়! আমার প্রতিপালকের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছি, সুতরাং আমি অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য কেমন করে আক্ষেপ করি?” (সূরা আ’রাফ : রুকু-১১) অন্যত্র আরোও ঘোষণা করা হয়েছে, “হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন-সম্পদ কামনা করি না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহরই নিকট সংরক্ষিত।” (সূরা হুদ : রুকু-৩) একই সূরার সামনে অগ্রসর হয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, “হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের কাছে পারিশ্রমিক চাই না, আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট আছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা হুদ : রুকু-৫)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন