লরেন্স লিফশুলৎজ মার্কিন সাংবাদিক। তিনি লেখেন ১৯৭৪ সালের কথা, “আমি যখন তাহেরের সঙ্গে বিদায় জানাতে গেলাম, তখন আমার ধারণাই ছিল না যে, তিনি গোপনে জাসদের একজন সদস্য।... ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের পরে তাহেরের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পারি, তিনিই ছিলেন সেই বিদ্রোহের সামরিক অধিনায়ক। এটা আমাকে বিস্মিত করলেও একই সঙ্গে আমার কাছে তা ছিল যৌক্তিক। তাহের আসলে তার ধারণাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। তাহেরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণরূপে পেশাগত। নভেম্বরের (৭৫) তৃতীয় সপ্তাহ। তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। এ অবস্থায় আমরা পুনরায় আলোচনা করি। ৭ নভেম্বর যদিও তাহের জিয়ার জীবন রক্ষা করেন, জিয়া প্রকাশ্যেই এ কথা উল্লেখ করেছিলেন। জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে তাহের ও জাসদের ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল ভুল; যদিও ঘরোয়াভাবে জিয়া দাবি করেছিলেন যে, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক নীতি বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য ঘোঁচাতে পারে।”
লিফশুলৎজ আরো লেখেন, “আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলে তিনি বলেন, আবার তাকে স্বাগত জানাতে পারলে তিনি খুশি হবেন। তাহের ছিলেন আশাবাদী। তার ভাবনা ছিল, তাদের দিন আসছে। আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, তারা যদি ক্ষমতায় আসেন তা হলে তাকে ও তার সহকর্মীদের ভিড় থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে অবলোকন করব।” পৃ:-২৩-২৪, সূত্র: “লরেন্স লিফশুলৎজ ও ড. পিটার কাসটারের বক্তৃতা এবং অন্যান্য”।
জিয়া সমাজতন্ত্রের পক্ষে কথা বললেও তা বঙ্গবন্ধুর মতো। তারা কেউ উগ্র-বামপন্থী ছিলেন না। জিয়া জানতেন যে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র জনগণ গ্রহণ করবে না।
ড. পিটার কাসটার ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সম্পর্কে লেখেন, “দুপুর বেলা জাসদকর্মী শামসুদ্দিন পিয়ারু শান্তকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন ঢাকা রেডিওতে, যেটি তৎকালে দেশের জনগণের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল যে, সামাজিক পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। দিনের অন্যসময় আরো দেখলাম, এ অভ্যুত্থানের সমর্থনে জাসদের বিভিন্ন সমর্থক গ্রæপ শহরের কেন্দ্রস্থলে মিছিল করছে। তবে যে জনসভার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল এবং যেটিতে কর্নেল তাহের ও জিয়াউর রহমান উভয়েরই ভাষণ দেয়ার কথা ছিল, সেটি আর অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তী দিনগুলোয় ঢাকার আশপাশে বা অন্য শহরে সিপাহীদের বিদ্রোহের গুঞ্জন শোনা যেতে লাগল। যেমন আমার কাছে তথ্য এলো, চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ন্যামপ্লেট বিতরণ হয়েছে বা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদ্রোহী সিপাহীরা ডাকা অভিমুখে মার্চ করতে শুরু করেছে। এসব গুজবের সত্যতা নিরূপণ করা কঠিন হলেও বোঝা যাচ্ছিল যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি স্থবির হয়ে গেছে এবং এত দূর অবধি তাহেরের দুঃসাহসী বৈপ্লবিক প্রয়াস সফল ছিল। বুর্জোয়া শ্রেণী এই পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যেতে সম্মত হয় প্রায় দুই সপ্তাহ পর, যখন কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে এবং জাসদের রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতারে বিশাল অভিযান শুরু করা হয়। (পৃষ্ঠা: ২-৩)।
তাহের ও জিয়ার যে জনসভা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি এই জন্য যে, জিয়া বিপ্লবের বাম চিন্তাধারার বিস্তৃতিতে শঙ্কিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, জনগণ তা গ্রহণ করবে না।
পিটার কাসটার লেখেন, “৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ছিল সিপাহীদের এমন এক বিদ্রোহ, যেটি অন্য অনেক কিছুর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিলোপের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল। আর তাহের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সিপাহীদের বিদ্রোহের দীর্ঘ ঐতিহাসিক নজির থেকে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব এবং ১৯৭৪ সালে পর্তুগালে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের পতন ঘটানো সেনা অভ্যুত্থান তাকে প্রেরণা যুগিয়েছে” (পৃ.৪)।
পিটার লেখেন, “কোনো সন্দেহ নেই যে, বিরোধী দল জাসদ যেটিতে তিনি যোগদান করেছিলেন, এর নেতৃবৃন্দের সাথে এই অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনা করেছেন। তাদের মতো তাহেরের চোখেও ছিল একটি বৃহত্তর সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন, সমাজের দলিত নিপীড়িতের মুক্তির জন্য বিপ্লব। ৭ নভেম্বর তাই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমাদের বিপ্লব- নেতা সরিয়ে নেতা বসানোর বিপ্লব নয়, এ বিপ্লব গরিবদের স্বার্থে।’ তবে এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিল জনতার সেনাবাহিনীর বিষয়ে তাহের ভাবনা। এই অভ্যুত্থানের সামরিক প্রস্তুতি যদিও নেয়া হয়েছিল জাসদের শহরকেন্দ্রিক গেরিলা সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলা সামরিক অঙ্গসংগঠন গণবাহিনীর মাধ্যমে, তবুও এই বিদ্রোহের শুরুতে নিয়মিত সেনাবাহিনীতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি মূলত করেছিল তাহেরের নেতৃত্বে গঠিত বিপ্লবী সংস্থার গোপন ইউনিটগুলো। এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ১২ দফা পেশ করেছিল। (পৃ.৬)।
জাসদই সামরিক বাহিনীতে রাজনীতি ঢুকিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। পিটার লেখেন “কর্নেল তাহের আগাগোড়া ভিন্ন এক থিসিস হাজির করলেন। তার দৃষ্টিতে বামপন্থীদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে, ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, সেটা একটা দুর্বল রাষ্ট্র, এ রাষ্ট্রের সংহত শক্তিমত্তার অভাব। তার মতে, বাংলাদেশের বিপ্লববাদীদের সঠিক সময়ে আঘাত করতে হবে। তাহেরের যুক্তি, এই কাজটা করার জন্য গ্রামাঞ্চলে গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার পথ চেয়ে বসে থাকার দরকার নেই। বাংলাদেশের সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল হতে হবে দেশের রাজধানী, যেখানে একটা সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেয়া সম্ভব। তাহের যুক্তি দেখালেন, দীর্ঘায়িত গণযুদ্ধের কৌশল বাংলাদেশের নিপীড়িতের মুক্তি আনবে না, মুক্তি আসবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কৌশল দিয়ে। আমাদের মধ্যে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাতের সময় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাহের যখন কথা বলতেন, তখন সিপাহী বিদ্রোহের আকারে তিনি যে একটা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এই তথ্যটা সরাসরি প্রকাশ করতে পারেননি। তবে অভ্যুত্থানের কৌশলই যে মোক্ষম কৌশল, এই কথাটা তিনি নির্দ্বিধায় বলতেন। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের শর্টকার্ট রাস্তা বের করা গেলে দীর্ঘমেয়াদী রক্তাক্ত বিপ্লবের পথ বেছে নেয়ার প্রয়োজন নেই- তাহের বলতেন। ... তাহের বিশ্বাস করতেন, সিপাহীদের মধ্যে আন্দোলন সংগঠিত করে রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে ভেতর থেকে পর্যুদস্ত করতে হবে, সেই আন্দোলন সিপাহীদের ভেতরে পুঞ্জিভ‚ত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাবে এবং ঘটিয়েও ছিল।” (পৃ:৭)।
পিটারে মূল্যায়ন আংশিক সত্য। কর্নেল তাহের পূর্ণ বাম-বিপ্লব করার ঘোষণাও করে বিপ্লব করেননি। একজন জনপ্রিয় বন্দী জেনারেলকে মুক্ত ও তথাকথিত ভারতপন্থী অন্য এক জেনারেলকে তথাকথিত ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করতে দিতে তাহের সাধারণ সিপাহীদের বুঝিয়ে একত্র করেছিলেন। তাহেরের লক্ষ্য ও সাধারণ সিপাহীদের লক্ষ্য ছিল আলাদা আলাদা।
পিটার লেখেন, “হায়দার আকবর খান রনো তার আত্মজীবনীতে (পৃ:৩৫৬) উল্লেখ করেছেন, টঙ্গী থেকে শিল্প শ্রমিকদের আনা হয়েছিল ঢাকার রাস্তায় মিছিল করে অভ্যুত্থানের পক্ষে সমর্থন জানাতে। তবু ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, নিপীড়িত শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে দূরত্ব ঘোঁচানো যায়নি। অস্ত্রধারী কৃষক অর্থাৎ সৈন্যদের সহযোগিতায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষকসমাজের মধ্যে কোনো জাগরণ সৃষ্টি হয়নি। তা ছাড়া তাহেরের বিপ্লব প্রচেষ্টার সঙ্গে যোগ দিতে শিল্পশ্রমিকদের অবগত করা হয়নি বা তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়নি। কিন্তু তারপরও ১৯৭৫ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল-আইরিশ ইস্টার অভ্যুত্থান সম্পর্কে লেলিনের দৃষ্টি ধার করে বলতে হয়- এক মহান জনপ্রিয় বিদ্রোহ।” (পৃ:১০)।
৭ই নভেম্বরের বিপ্লবে আমজনতা, আম-সিপাহী সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে সাড়া দেয়নি। এখানেই তাহেরের ব্যর্থতা ও জিয়ার সফলতা।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন