বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস

’৭৫-এর ৭ নভেম্বর একটি পর্যালোচনা

হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৭ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর। স্বাধীনতা লাভের চার বছরের মাথায় এ বছরটিতে উপর্যুপরি পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যার প্রত্যেকটিই ছিল জাতীয় ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী। যার প্রথমটি হলো, ২৪ জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয়টি হলো, ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা, তৃতীয়টি হলো, ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান, চতুর্থটি হলো, এদিন রাতে জেলখানায় বন্দি চার নেতা হত্যা ও পঞ্চমটি হলো, ৭ নভেম্বরের ঘটনা যা জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে সিপাহী-জনতার বিপ্লব নামে আখ্যায়িত। এক হিসেবে ৭ নভেম্বরের আগের ঘটনাগুলোকে এ দিনটির পশ্চাৎপট বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তার অর্থ এই যে, এসব ঘটনার প্রতিটিই পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত কিংবা একটির ফলশ্রুতিতে আরেকটি সংঘটিত হয়েছে। আরেক হিসেবে বলা যায় যে, প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে আকস্মিকভাবে যে কারণে এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র খোঁজা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতোই অর্থহীন।

তবে প্রকৃত সত্য যাই হোক না কেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৭ নভেম্বর একটি ঐতিহাসিক দিন। আমরা সাধারণভাবে জানি যে, এ ঐতিহাসিক দিনটির স্রষ্টা সেনাবাহিনির সদস্যরা , আর সেদিন তাদের সমর্থন দিতে তাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন প্রয়াসী রাজধানীবাসী বহু সংখ্যক মানুষ। সেদিন সৈনিকদের সাথে তাদের সামরিক যানে যারা আরোহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে জাসদের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও বর্তমানে সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন বলে জানা যায়। তবে সৈনিকদের সরাসরি সমর্থনকারী জনতার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কতজন জাসদ সমর্থক ও কতজন ভারতবিরোধী মানসিকতা সম্পন্ন সাধারণ মানুষ ছিলেন তার সংখ্যা নিরূপণ আজ আর সম্ভব নয়। যাহোক, সিপাহী-জনতার সেদিনের বিপ্লব মে. জে. জিয়াউর রহমানকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। দেখা যায়, ’৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা ও ধ্বংসকান্ড শুরুর খবর পাওয়ার সাথে সাথে চট্টগ্রামে ‘উই রিভোল্ট’ বলে স্বাধীনতার যুদ্ধে নেমে পড়া এবং ২৭ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজ নেতৃত্বে ও পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারকারী মেজর জিয়া ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় পর্যায়ে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করলেন। এখন যে যাই বলুন না কেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রথমবারের মতো তার দ্বিতীয় অভ্যুদয়ও তার নিজের পরিকল্পিত ছিল না, তা ছিল পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আরেক আকস্মিক ঘটনা।
সবারই জানা যে ঘটনাবহুল ১৯৭৫-এ মে. জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনির উপ-প্রধান। রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো সম্পর্ক তার কখনোই ছিল না। তবে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর আর সবার মতো তিনিও তার সদস্য হন। এ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সরকার অনুগত। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ২৪ আগস্ট তাকে চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করে। নয়া সরকারের নেপথ্য পরিচালক ও ১৫ আগস্ট ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত সেনাবাহিনির কিছু অবসরপ্রাপ্ত ও নিয়মিত সেনা অফিসারের কর্মকান্ডে কিছু সিনিয়র ও জুনিয়র অফিসার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা সেনাবাহিনিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় হন। দেখা যায়, ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারের নিয়ন্ত্রক সামরিক অফিসাররা তাদের গোপন তৎপরতা আঁচ করতে পারেন নি। এমনকি সেনাপ্রধান জিয়াও বিষয়টি অনবহিত ছিলেন। তাই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল প্রমুখের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান খুব সহজেই সফল হয়। মোশতাক সরকারের পতন ঘটে অস্ত্রের মুখে। ১৫ আগস্টের ঘটনার হোতা সামরিক অফিসাররা সবাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগীরা। তারা তাদের ভাষায় সেনাবাহিনিতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার জন্যই এ পদক্ষেপ নেন। এক্ষেত্রে শাফায়াত জামিলের ব্রিগেড ও বিমানবাহিনীর সহায়তা পান তারা যা তাদের প্রাধান্য এনে দেয়। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা ঘটে। আগস্ট ঘটনার সাথে জড়িতরা খালেদ মোশাররফের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে বিমানযোগে সপরিবারে দেশত্যাগ করেন, মোশতাক সরকারের আমলে জেলখানায় বন্দি আওয়ামী লীগের ৪ শীর্ষ নেতাকে হত্যা করা হয়, সেনাপ্রধান জিয়া পদচ্যুত হয়ে গৃহান্তরীণ হন, সেনাপ্রধান হন খালেদ মোশাররফ। এদিকে ১৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে সেনাবাহিনীর আমূল পরিবর্তন সাধনে ইচ্ছুক লে. কর্নেল তাহের ও তার নেতৃত্বাধীন জাসদ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা শুরু করেন। তাতে তিনি বেশ সফলও হন। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর তিনি এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। এ পর্যায়ে যে কোনো কারণেই হোক, জিয়াউর রহমান তার পছন্দের ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। এদিকে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে মোশতাক সরকারের পতনের পর ঢাকার জনগণের সর্বস্তরে খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থি বলে একটি অনাকাক্সিক্ষত শিরোপা লাভ করেন। তার মা ও ভাইয়ের অংশগ্রহণে রাজপথে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বের হওয়া মিছিল এই ধারণার সৃষ্টি করে। সম্ভবত সে সাথে তার বিরুদ্ধে জাসদের একটি প্রচারণাও ছিল। অন্যদিকে সেনাপ্রধান হলেও সরকার গঠনের ব্যাপারে খালেদ মোশাররফের অনিচ্ছা বা অনীহা তার বিরোধী পক্ষের জন্য বিরাট সুযোগ এনে দেয়। উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করার বিষয়টি সেনাবাহিনীর বহু অফিসার ও সৈনিককে ক্ষুব্ধ করে, কিন্তু তারা এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এদিকে কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা মোতাবেক ৬ নভেম্বর রাতে ঢাকা সেনানিবাসের জাসদ অনুগত সৈন্যরা অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়লে তাদের নির্মমতার প্রথম শিকার হন সেনা অফিসাররা। এই সহিংসতা চলার অন্যদিকে কিছু সৈন্য জিয়াউর রহমানের বাসভবনে গিয়ে তাকে মুক্ত করে ও অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে তার পক্ষে অফিসার সৈনিকের সমর্থনের পাল্লা ভারী হয়ে ওঠার পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। মনে হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতি মেজর জেনারেল জিয়াকে চার বছর আগে ‘৭১-এর মেজর জিয়ার অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই টালামাটাল অবস্থা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও তিনি স্বপ্রত্যয়ে উদ্ভাসিত হন। তাই ‘৭১-এর ২৭ মার্চের পর ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর সকালে জাতি আরেকটি বেতার ঘোষণা পেল- আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলছি.....।
এ প্রসঙ্গে ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলার রিপোর্টটির কথা মনে করা যেতে পারে। এতে বলা হয়েছিল- ‘সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চার দিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহীরা। ৭ নভেম্বর শুক্রবার ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’
বাস্তব ঘটনাক্রমের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কর্নেল (অব) তাহেরের পরিকল্পনায় ৬ নভেম্বর রাতে যে লক্ষ্য নিয়ে সেনা বিপ্লব শুরু হয়েছিল, গৃহবন্দি জিয়াকে উদ্ধার করাও তার পরিকল্পনায় ছিল। একপর্যায়ে সম্ভবত জাসদ সমর্থক সৈন্যদের সাথে সাধারণ সৈন্যরাও যোগ দেয় এবং তা হয়ে ওঠে সর্বাত্মক সিপাহী বিদ্রোহ বা সৈনিক বিদ্রোহ। শোনা যায়, জিয়া গৃহবন্দি অবস্থায় তাহেরের সাহায্য চেয়েছিলেন। তবে জিয়াকে উদ্ধার করেন বোধ হয় তাহের অনুগত সৈন্যরা নয়, জিয়ার সমর্থকদের একটি অংশ। তারা তাকে নিয়ে যান ২য় ফিল্ড আর্টিলারি সদর দফতরে। সেখানে পৌঁছনোর পর জিয়া সৃষ্ট বেসামাল পরিস্থিতির হাল ধরার চেষ্টা করেন। শোনা যায় যে, সেনাবাহিনীতে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। তাই পরিস্থিতি খুব দ্রুতই তার নিয়ন্ত্রণে আসে, অন্যদিকে তার চেয়েও দ্রুত কর্নেল তাহেরের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দুজনের মধ্যে ব্যবধান অচিরেই মহাসাগর পরিমাণের রূপ নেয়। পরিণতিতে জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন আর কর্নেল তাহের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
সমকালীন প্রেক্ষিত ও সংবাদপত্রের বিবরণ থেকে দেখা যায়, ৭ নভেম্বর ছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। জাতীয় চেতনাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে সেদিন রাজপথে এক হয়েছিল সিপাহী-জনতা। রাজধানীর কত সংখ্যক মানুষ সেদিন বেরিয়ে এসেছিল তা কেউ গুণে দেখেনি, কিন্তু হাজার মানুষ যে রাজপথে নেমে এসেছিল সে কথা অসত্য নয়। তাতে রচিত হয়েছিল ঐক্য ও সংহতির অপূর্ব উদাহরণ। সম্মিলিত মানুষের স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে উচ্চারিত নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে উচ্চকিত হয়েছিল রাজপথ। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আপ্লুত হয়েছিল রাজধানীর জনসমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ। দেশের বিভিন্ন অংশও প্লাবিত হয়েছিল আবেগের সে জোয়ারে। খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান তথা ক্ষমতা দখলের ঘটনা যে শঙ্কা ও নীরবতার জন্ম দিয়েছিল তার অবসান ঘটে। এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, ৩ নভেম্বরের পদক্ষেপ ছিল জনসমর্থনবিহীন, পক্ষান্তরে ৭ নভেম্বরের ঘটনা ছিল জনসমর্থনপ্রাপ্ত। বাংলাদেশের মানুষের বৃহত্তর অংশের মধ্যে সেদিন ভারতীয় আধিপত্য ও প্রভাব বিরোধী মনোভাবের প্রবল প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়েছিল। যাহোক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার ও কে ফোর্সের প্রধান খালেদ মোশাররফের মর্মান্তিক পরিণতির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার পথে জিয়াউর রহমানের উত্থান ঘটে। নিয়তিই তার জন্য এই পথ রচনা করে দিয়েছিল। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে সারথির ভ‚মিকায় জিয়াউর রহমানের অভিযাত্রা শুরু হয়। তবে নিয়তি তাকে ক্ষমতার শীর্ষদেশে আসীন করলেও স্বপ্ন ও লক্ষ্য পূরণে বেশিদূর এগোতে দেয়নি। উত্থান ও প্রতিষ্ঠা লাভের ৬ বছরের মাথায় তিনি আততায়ীদের নির্মম আক্রোশের লক্ষ্যে পরিণত হন।
৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব সাম্প্রতিক অতীতে ভিন্ন ব্যাখ্যার শিকার হয়েছে। ফলে যা ছিল একদিন সিপাহী-জনতার মিলন ও ঐক্যের প্রতীক ও জাতীয় পর্যায়ে উদযাপিত দিন, তা পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিবর্জিত ও উপেক্ষিত একটি দিনমাত্রে। তারপরও এ কথা সত্য যে, বহু মানুষের কাছেই ৭ নভেম্বর সিপাহী-বিপ্লবের দিনটির মর্যাদা ও মহিমা আজো উজ্জ্বল, অম্লান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন