বাংলাদেশে পাল রাজত্ব কায়েম হওয়ার পূর্বে এখানে মাৎস্যন্যায় অবস্থা বিরাজ করেছিল বেশ কয়েক বছর। সেই অরাজক অবস্থার অবসান ঘটায় এখানকার সচেতন জনগণ গোপাল নামে এক ব্যক্তিকে তাদের রাজা হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে। পাল রাজত্বের অবসান ঘটলে এখানে সেন রাজত্বের পত্তন হয়। ব্রাহ্মণবাদী সেন শাসকরা এখানে প্রতিষ্ঠা করে বর্ণবাদ। তারা বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে বলে ফতোয়া জারি করে। তারা বলে, ব্রাহ্মণ হচ্ছে মস্তক। ব্রাহ্মণের সেবায় অন্য সবাইকে নিয়োজিত থাকতে হবে। কৌলিণ্যের দাপটে বাংলার মানুষ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করতে থাকে। ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম সিপাহসালার ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী এই দেশে এসে স্বাধীনতার সুবাতাস প্রবাহিত করলেন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ বণিকরা ছলে-বলে-কৌশলে এ দেশের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করল। ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি প্রয়োগ করে তারা তাদের প্রভুত্ব পাকাপোক্ত করল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহি- জনতার সম্মিলিত উত্থান ঘটল। এ দেশে মহা বিপ্লব সাধিত হলো। মীর কাসিম, ফকির মজনু শাহ, সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ প্রমুখ যে আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন, তার গতিবেগ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহা বিপ্লবে নতুন মাত্রা পেল। শুরু হলো আজাদির লড়াই। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ এ দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলামের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের কক্ষে এক মিটিংয়ে গঠিত হলো তমদ্দুন মজলিস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলন নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হলো। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হলো কয়েকটি তরতাজা প্রাণ। এ দেশের মানুষের আন্দোলনের ফসল ছিল এ দেশের স্বাধীনতা। কিন্তু পশ্চিমা পাঞ্জাবি চক্র সেই স্বাধীনতার সুফল লাভে বঞ্চিত করল এ দেশের মানুষকে। শুরু হলো স্বাধিকার আন্দোলন, যা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা এলো। কিন্তু ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের মাধ্যমে এই দেশের পথ পরিবর্তন ঘটল। এক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হলো। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর বাংলাদেশের ওপর নেমে এলো মাৎস্যন্যায় অবস্থা। সারা বাংলাদেশ থমকে দাঁড়াল। ৩ নভেম্বর ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো। কী যে ঘটছে তা বাইরে কেউ জানতে পারছিল না। বঙ্গভবন ও ঢাকা সেনানিবাসে একটি হেলিকপ্টার আসা-যাওয়া করছিল। পরে জানা গেল, বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে উত্থান ঘটেছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান আটক হয়েছেন। সাধারণ সৈনিকরা ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এনেছে। রাস্তায় রাস্তায় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক বের হয়েছে। সিপাহি-জনতার কণ্ঠে মহা বিপ্লবের ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। বিপ্লব ও সংহতির আওয়াজে মুখরিত হয়েছে মহানগরীর আকাশ-বাতাস। বাংলাদেশের মাৎস্যন্যায় অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছে। বাংলার পাল রাজত্বের পূর্বক্ষণে যে মাৎস্যন্যায় অবস্থায় বাংলার মানুষ নিপতিত হয়েছিল বহু বছর পর আবার আরেক মাৎস্যন্যায় অবস্থা থেকে বাংলার মানুষ যেন মুক্ত হলো। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের মহাবিপ্লবের স্মরণে এক কবিতায় কবি কাজী কাদের নওয়াজ লিখেছেন; মর্গে চমন জাগার আগে তোমরা জাগিলে তরুণ দল/ বাদে সবার মদিরা মন্ডলে জাগল উঠনো সে ধ্বনি চলরে চল/স্কন্ধে আলিফ-লায়লার দেও। চাপে মরে বুঝি সিন্দাবাদ। এমনি সময় পথে পথে শুনি/ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, গবেষক,
সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন